KalerKantho ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ ফাল্গুন ১৪১৬, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৩১, ১২ মার্চ ২০১০
পার্থ সারথি দাস ও হায়দার আলী
পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনার স্বার্থে চাঁদার বদলে মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সমিতির 'পরিচালনা ব্যয়' নির্বাহের জন্য বাসপ্রতি টাকা তোলার হার বেঁধে দেওয়া হয়। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে ঢাকার পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক এ উদ্যোগ নেন। এর পর থেকেই মন্ত্রী বলে দিয়েছেন_ এই অজুহাত তুলে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে, মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে রাজধানীর সড়ক পরিবহনে চাঁদাবাজির 'উৎসব' শুরু হয়ে যায়।
জানা গেছে, টার্মিনাল বা সড়ক থেকে চাঁদা তোলা আইন অনুযায়ী অবৈধ। ১৯৬৯-এর শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ এবং 'শ্রম
আইন ২০০৬' উভয় স্থানেই ইউনিয়নগুলোকে শুধু তাদের সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে। তার পরও শ্রমিক কল্যাণসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে পরিবহনে বেপরোয়াভাবে চাঁদাবাজি হচ্ছে। নৌমন্ত্রী শাজাহান খান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, আগে চাঁদাবাজি ছিল বেপরোয়া। তা বন্ধের জন্যই হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এ অর্থ সবাই দিচ্ছে।
মহানগর পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের জন্য সচেষ্ট রয়েছি। কোনো অভিযোগ আসছে না। এলে তো ব্যবস্থা নেবই।' তাঁর দাবি, পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনতে এ অর্থ তোলা হচ্ছে। এর কোনো আইন আছে কি না জানতে চাইলে তিনি আর কথা বলেননি।
জানা গেছে, গত বছরের ৪ আগস্ট মহানগর পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে এক সভায় পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের জন্য বাসপ্রতি চাঁদার হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকার প্রতিটি বাস মালিক সমিতিকে ৩০ টাকা ও শ্রমিক ইউনিয়নকে ৪০ টাকা করে চাঁদা দেবে।
এ সভার সিদ্ধান্তের বিষয় ও চাঁদাবাজির হার উল্লেখ করে মালিক ও শ্রমিক সমিতি এবং ইউনিয়নগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়। জানা গেছে, চিঠিতে যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মঞ্জুরুল কাদের খান, উপ-কমিশনার মফিজ উদ্দিন খান (ট্রাফিক পশ্চিম), উপ-কমিশনার (ট্রাফিক পূর্ব), তেজগাঁও অঞ্চলের উপ-কমিশনার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীরের স্বাক্ষর ছিল। এসব চিঠি পাঠানো হয় ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মিরপুর চিড়িয়াখানা, পল্লবী, গাবতলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, ফুলবাড়িয়া ও মোহাম্মদপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে।
এর পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন টার্মিনাল ও বাস কাউন্টার থেকে নৌমন্ত্রী ও পুলিশ কমিশনারের দোহাই দিয়ে তোলা হচ্ছে চাঁদা। এই চাঁদা তোলা হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সংগঠনের নামে। এই ফেডারেশনের কার্যকরী কমিটির সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী নিজেই। জানা গেছে, এর সহযোগী সংগঠন 'ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি'র নামে চাঁদাবাজি হচ্ছে বেপরোয়াভাবে। এ সমিতির দপ্তর সম্পাদক সামদানি খন্দকার বলেন, অফিস পরিচালনা, মালিক সমিতির নেতাদের যাতায়াত, সড়কে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা ও মামলা পরিচালনায় এ অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, 'নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও পুলিশ কমিশনার শহীদুল হকের সঙ্গে আলোচনার পরই এ অর্থ তোলার সিদ্ধান্ত হয়। আমাদের উদ্যোগে এ অর্থ তোলা হয় মাত্র।'
রাজধানীতে ৫০টি বাস কম্পানির প্রায় আড়াই হাজার বাস চলাচল করে। এর মধ্যে অ্যাসোসিয়েশন অব বাস কম্পানিজের অধীনেই রয়েছে ৩৬টি কম্পানি। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি থেকে বারবার দাবি করা হলেও এসব কম্পানির মালিকরা এ চাঁদা দেওয়ার বিষয়ে নীরব থাকেন। এক মাস আগে থেকে ফোনে বারবার সড়ক পরিবহন সমিতির বিভিন্ন নেতা কম্পানির মালিকদের চাঁদা দেওয়ার জন্য হুমকিও দেন। কিন্তু মালিকরা তাতে কর্ণপাত করেননি।
অবশেষে গত সোমবার মিরপুর-২ সনি সিনেমা হলের সামনে সন্ত্রাসীরা চাঁদা দিতে অস্বীকারকারীদের ওপর 'জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগান দিয়ে হামলা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি মিরপুর আঞ্চলিক কমিটির নেতা আবুল কাশেম ও দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলে, 'রাজধানীতে বাস চালাতে হলে আমাদের নেতা নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও এনায়েত উল্লাহকে চাঁদা দিতেই হবে।'
সমিতির চিড়িয়াখানা-মিরপুর কমিটির সভাপতি আবুল কাশেম কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ কমিশনার সভা করে অর্থ তোলার কথা বলেছেন। এটা সবাইকেই দিতে হবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব বাস কম্পানিজের সভাপতি রফিকুল ইসলাম কাজল বলেন, 'মন্ত্রী ও পুলিশই চাঁদা আদায়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কিন্তু সরকার নিজে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলে আমরা তা মানতে রাজি আছি। শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য এই চাঁদা তোলার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা আমাদের কম্পানি গঠন করেছি কর্মকর্তা, কর্মচারী-শ্রমিকদের কল্যাণের জন্যই। অন্যরা এদের কল্যাণের জন্য অর্থ তুলবে কেন?'
ঢাকার বিভিন্ন পরিবহনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের অভিযোগ, রাজধানীর পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির প্রত্যক্ষ মদদ দিচ্ছে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও পুলিশ কমিশনারের টাকা তোলার ওই সিদ্ধান্ত।
তাঁর দাপটে চাঁদাবাজির অভিযোগের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, 'আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। দাপটে বিশ্বাস করি না।'
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment