টিএম মিজানুর রহমান শরণখোলা (বাগেরহাট)
সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত শরণখোলায় ভারত সরকারের অনুদানে দেয়া ত্রাণের ঘর পাচ্ছেন বিত্তশালীরা। নির্মাণকাজেও রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও থেকে যাচ্ছে গৃহহীন অবস্থায়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে শরণখোলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ত্রাণের ঘর নিয়ে অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র। উপজেলার রাজৈর গ্রামের একটি দোতালা বিল্ডংয়ের সঙ্গে ভারত সরকারের অনুদানে আরেকটি ত্রাণের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘরটি ওই বিল্ডিংয়ের মালিক নুরুল আমিন হাওলাদার ত্রাণ হিসেবে পেয়েছেন। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এটি এখন রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হবে বলে তার ছেলে আসাদুজ্জামান হিরু জানান। ত্রাণের পাওয়া ঘর এবং নিজস্ব বিল্ডিংয়ের কাজ একই সঙ্গে চলতে দেখা গেছে।
একই এলাকার ইউনুস মোল্লার দোতলা টিনের ঘরের সামনেই আরেকটি ত্রাণের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানের ভাই মনিরুজ্জামানকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে তিনি এ ঘরটি পেয়েছেন বলে সরলভাবে জানালেন গৃহকর্তার স্ত্রী জরিনা বেগম। অথচ পার্শ্ববর্তী কাঠমিস্ত্রি আ. বারেক মল্লিকের ঘর সিডরে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় তার নাম রয়েছে। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় তিনি ত্রাণের ঘর পাননি বলে অভিযোগ করেন। এভাবেই সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলায় ভারত সরকারের অনুদানে ত্রাণের ঘর বিতরণ করা হচ্ছে।
শুধু এখানেই শেষ নয়, খুলনা-বাগেরহাট রুটের বাস মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলবুনিয়া গ্রামের আতিয়ার রহমান খুলনায় বসবাস করেন। বিত্তশালী এ ব্যক্তির নাম ভারতীয় ত্রাণ পাওয়া ঘরের তালিকায় রয়েছে। এ ধরনের অর্থ-বিত্তের মালিক একই গ্রামের সেলিম তালুকদার, মাওলানা লতিফুর রহমান তালুকদার, হেমায়েতউদ্দিন আকন, আলো আকন, মোস্তফা তালুকদার, রায়েন্দা (সদর) ইউনিয়নের বাসিন্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম কালাম, বন ও পরিবেশ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনসহ অনেকের নাম ত্রাণের ঘরের তালিকায় রয়েছে। অথচ স্থানীয় প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী সিডরে গৃহহীন ৩ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে এখন পর্যন্ত ঘর দেয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি ভারত সরকারের অনুদানে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কি প্রক্রিয়ায় এ ঘর দেয়া হচ্ছে তা স্থানীয় প্রশাসন জানে না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার জহিরুল ইসলাম জানান, এসব অনিয়মের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কারা কীভাবে এগুলো করছে তা তিনি জানেন না বলে উল্লেখ করেন।
উত্তর কদমতলা গ্রামের মো. দেলোয়ার হোসেন শরণখোলা প্রেসক্লাবে গত ২৫ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে জানান, তাদের গ্রামে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে এরই মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে যারা ঘরসহ অন্যান্য সহায়তা পেয়েছেন সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে তারাই এখন ভারত সরকারের অনুদানে দেয়া ঘর পাচ্ছেন। তিনি জানান, তার এলাকার আফজাল মোল্লা, রতি কান্ত, খোকন তালুকদার, দেলোয়ার ব্র্যাক থেকে এবং আব্বাস তালুকদার, ফরিদা বেগম কেয়ার বাংলাদেশের অনুদানে ত্রাণের ঘর পেয়েছেন, তারাই আবার ভারতের দেয়া অনুদানের ঘরও পেয়েছেন। অথচ তিনিসহ অনেকেই সিডরে গৃহহীন হয়ে এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। রাজৈর গ্রামের ৬৫ বছরের বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম জানান, তিনি ঘর পেলেও ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ অপারগতা প্রকাশ করায় বাধ্য হয়ে নিজেই ভিত করার জন্য মাটি কেটেছেন। আনোয়ারার মতো ওই গ্রামের আলেয়া বেগম, পারুল বেগম, দুলাল হাওলাদার, আবুল ফরাজী, আ. রহিমসহ সবার একই অভিযোগ। এছাড়া নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে ঘরের কাজ করা হচ্ছে। ঠিকাদারের লোকজন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশলী ব্যক্তি হওয়ায় এসবের বিরুদ্ধে কথা বলারও সাহস করে না সুবিধাভোগীরা।
এব্যাপারে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খোকন জানান, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় একাধিকবার উপস্থাপন করা হলেও কোনো কাজ হয়নি। ২৭ ডিসেম্বর ফের সমন্বয় কমিটির সভায় রেজুলেশন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতীয় দূতাবাসের নিয়োগকৃত ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটিং (প্রা.) লিমিটেডের মাধ্যমে শরণখোলায় ১ হাজার ৪০০ এবং মোরেলগঞ্জ উপজেলায় ১ হাজার ৪০০ ত্রাণের ঘর নির্মাণের জন্য ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। এরমধ্যে মিজান কনস্ট্রাকশন ও হোসেন কনস্ট্রাকশনকে শরণখোলায় এবং ভোস্ট কনস্ট্রাকশন ও প্রিয়া কনস্ট্রাকশনকে মোরেলগঞ্জে কার্যাদেশ দেয়া হয়। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ নির্বিঘ্নে করার জন্য স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়। ফলে তারা অধিক লাভের আশায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত কাজ করে যাচ্ছেন। এদিকে ভারতীয় দূতাবাসের নিয়োগকৃত এ প্রকল্পের তদারকি সংস্থা ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটিং (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আ. মাজেদ চৌধুরী এবং ইপিসির ইঞ্জিনিয়ার ফয়েজউদ্দিন ও শঙ্কর কুমার গত ২৬ ডিসেম্বর প্রকল্প এলাকা ঘুরে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন
।