আসাদুজ্জামান সাগর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত আড়াই বছরে ১৯০ জন শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব নিয়োগের বেশিরভাগই হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। আর এটা করতে গিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের ‘বঞ্চিত’ করা হয়েছে। প্রাধান্য পেয়েছেন তুলনামূলক কম মেধাবীরা। এমন ঘটনাও রয়েছে—অনার্স-মাস্টার্সসহ শিক্ষাজীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত প্রার্থী থাকার পরও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৩২তম স্থান, বিএফএ-এমএফএ পাস প্রার্থী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী হওয়ার বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী-এমপি, স্পিকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পুত্র-কন্যা, জামাই ও আত্মীয়দের নিয়োগ দেয়া হয়। এসব নিয়োগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ’৭৩-এর আদেশ পর্যন্তও লঙ্ঘিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-সিন্ডিকেট, শিক্ষক সমিতি-ডিনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকতেই নিয়োগে এমন স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ করা হয়েছে। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষক নয়, ভোটার নিয়োগ দেয়া হয়েছে।জানা গেছে, নিয়োগে বিভিন্ন নেতিবাচক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নানা সময়ে সিলেকশন বোর্ডের সদস্য, ডিন, সিন্ডিকেট সদস্য, বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশেষজ্ঞ সদস্যরা এর প্রতিবাদ করেছেন—দিয়েছেন ‘নোট অব ডিসেন্ট’। বঞ্চিত অথচ মেধাবী ও যোগ্য একাধিক প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিকার চেয়েছেন। দুই বঞ্চিত প্রার্থী ন্যায়বিচার পেতে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা পর্যন্ত ঠুকে দিয়েছেন। শিক্ষকরা প্রতিবাদ জানিয়ে প্রশাসনকে স্মারকলিপি, মানববন্ধন, প্রচারপত্র বিলি এবং প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে কৈফিয়ত তলব করার ঘটনাও রয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।এদিকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সেরা মেধাবীদের বঞ্চিত করায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ মেয়াদে একাডেমিক ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশিষ্টজনরা। নাম প্রকাশ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ইমেরিটাস বলেন, এর ফলে দেশ ও জাতি একদা দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়বে। বুদ্ধিবৃত্তির জগতে সৃষ্টি হবে দেউলিয়াপনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর ও লোকপ্রশাসনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আকা ফিরোজ আহমদ বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে পারে। তখন গোটা জাতিরাষ্ট্রই ধ্বংসের সীমানায় দাঁড়াবে।নিয়োগে অনিয়ম আর দলীয়করণের ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রোভিসি এবং প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক নিয়োগে সিলেকশন বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, এ সবই গতানুগতিক অভিযোগ। মন্ত্রী, এমপি, শিক্ষক বা অন্য কারও বাবার পরিচয় কখনোই নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। একজন যদি যোগ্য হয় আর তাকে বাবার বা দলীয় পরিচয়ের কারণে বাদ দেয়া হয় তাহলে সেটা হবে অন্যায় এবং মৌলিক মানবাধিকার পরিপন্থী। নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত মেধা আর যোগ্যতার বিবেচনা করা হয়। বেশিরভাগ নিয়োগই এই মৌলিক শর্ত মেনে করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। ভোটের রাজনীতিকে সামনে রেখে ভোটার নিয়োগের অভিযোগ নিতান্তই গতানুতিক। বরং এই অভিযোগটিই দলীয় বিবেচনাপ্রসূত।বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের এই ১৯০ শিক্ষক নিয়োগে নানা নিয়ম-অনিয়মের ব্যাপারে আমার দেশের পক্ষ থেকে নিজস্ব অনুসন্ধান চালানো হয়। এছাড়া এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, সিন্ডিকেট সদস্য, বিভাগের চেয়ারম্যান, সিলেকশন কমিটির বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগও পাওয়া গেছে।চারুকলা অনুষদ : বর্তমান প্রশাসনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে চরম দলীয়করণ ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৭ বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭ প্রভাষকের ১৫ জনই তুলনামূলক কম যোগ্য, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও নেতাকর্মী এবং বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রপতির দফতর এ অভিযোগ আমলে নিয়েছে। বঙ্গভবনের নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সম্প্রতি দু’দফা কৈফিয়ত তলব করেছে।অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে ২ জন প্রভাষক পদে আবেদন করেছিলেন ১০ প্রার্থী। তাদের মধ্যে নিয়োগ কমিটির তালিকায় প্রথম ২ জন মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ও মো. আতিকুল ইসলামের অনার্স-মাস্টার্সসহ তিনটিতে প্রথম শ্রেণী ছিল। তাদের বাদ দিয়ে নেয়া হয়েছে তালিকায় তৃতীয় ও চতুর্থ নম্বরে থাকা নাসিমুল কবির ও নাসিমা হক মিতুকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারা এসএসসি ও এইচএসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণী এবং পাস কোর্সে ডিগ্রি এবং প্রিলিমিনারি মাস্টার্স পাস। অবশ্য ডিগ্রি ও মাস্টার্সে তাদের প্রথম শ্রেণী রয়েছে। বিভাগের শিক্ষক ও নিয়োগ প্রার্থীদের অভিযোগ, অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী পাওয়া প্রার্থী থাকার পরও ডিগ্রি পাস প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে জঘন্য ঘটনা। ওই নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করে তিনটিতে প্রথম শ্রেণী পাওয়া এবং ১৯টি পদক পাওয়া প্রার্থী মাহমুদুল হাসান হাইকোর্টে রিট করেছেন। আগামী ১০ আগস্ট এর আদেশ হবে বলে তিনি জানান। এদিকে ওই নিয়োগের বিরোধিতা করে ২৯ জুলাই সিন্ডিকেটের চার সদস্য আপত্তিপত্র দিয়েছেন।ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে ৩ প্রভাষক ও ১ সহকারী অধ্যাপক নিয়োগে প্রার্থীদের যোগ্যতা ও মেধার মূল্যায়ন হয়নি। গুরুত্ব পেয়েছে দলীয় পরিচয়। সিলেকশন কমিটির তালিকার ৩৫ জনের মধ্যে ১ থেকে ৬ নম্বর পর্যন্ত প্রার্থীর এসএসসি, এসএইচসি, অনার্স ও মাস্টার্স—৪টিতেই প্রথম শ্রেণী ছিল। তালিকার ৪ ও ৫ নম্বরে থাকা প্রার্থী সবগুলোতে প্রথম শ্রেণী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ছিলেন। কিন্তু তালিকাবঞ্চিত করে ক্রমিকের ৭ নম্বরের প্রার্থী সহিদ কাজী, ৮ নম্বরে থাকা প্রার্থী আবদুস সাত্তার এবং ৩৩ নম্বরের প্রার্থী দুলাল চন্দ্র গাইনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তালিকার ৩৩ নম্বরে থাকা প্রার্থী দুলাল চন্দ্র গাইনের শিক্ষাজীবনের তিনটিতে দ্বিতীয় শ্রেণী। শুধু মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী রয়েছে। দুলাল চন্দ্র গাইন ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এ অনুষদের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ৭ নম্বরে থাকা প্রার্থী সহিদ কাজী এবং ৮ নম্বরে থাকা প্রার্থী আবদুস সাত্তারের শিক্ষাজীবনে তিনটি প্রথম শ্রেণী রয়েছে। জানা যায়, দুলাল চন্দ্র গাইন বর্তমান সরকারের সময় কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ময়মনসিংহের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান। নিয়োগ কমিটির প্রার্থীদের তালিকায় দুলাল চন্দ্র গাইন আবেদনের সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অভিজ্ঞতার কথা গোপন করেন। তাছাড়া অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রার্থী চাকরি করেন তার অনুমতির প্রয়োজন হয়। তিনি সে অনুমতিও নেননি। ২০১০ সালের ২৯ জুলাই সিন্ডিকেট সভায় ওই নিয়োগের বিরোধিতা করে চার সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন, অধ্যাপক ড. তাজমেরী এসএ ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক লুত্ফর রহমান ও সহকারী অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন। এছাড়া এই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগে এক প্রার্থীকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত করে অন্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়। ওই নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ করে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ প্রার্থী হোসাইন মোহাম্মদ ফারুক হাইকোর্টে রিট করেছেন। বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। প্রিন্ট মেকিং বিভাগে ২ জন প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৭ যোগ্য প্রার্থীকে একইভাবে বঞ্চিত করা হয়। এসএসসি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত ৪টিতে প্রথম শ্রেণী পাওয়া ২ প্রার্থী এবং ৩টি প্রথম শ্রেণী পাওয়া ৬ জনের মধ্যে সবগুলোতে প্রথম শ্রেণী পাওয়া আসমিতা আলম শাম্মীকে নেয়া হলেও বাকি যোগ্যদের বাদ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় জন নেয়া হয়েছে ৩টি দ্বিতীয় শ্রেণী পাওয়া প্রার্থী নাজির হোসেন খানকে। তিনি চারুকলা অনুষদের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। ওই নিয়োগের সময় সিলেকশন কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল হক এ নিয়োগের চরম বিরোধিতা করেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু দলীয় বিবেচনায় নাজির হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ নিয়োগের বিরোধিতা করে বিভাগের চেয়ারম্যান ও আমি সভা ত্যাগ করেছিলাম।’গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগের নিয়োগ নিয়েও সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত ৩ জনের মধ্যে চারটি প্রথম শ্রেণী পাওয়া ভদ্রেশু রিটাকে নেয়া হয়। বঞ্চিত করা হয়েছে দুই যোগ্য প্রার্থীকে। প্রার্থী বিপ্লব কুমার মজুমদারের ৪টি প্রথম শ্রেণী থাকলেও তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। সেখানে নেয়া হয়েছে তিনটিতে প্রথম শ্রেণী পাওয়া সীমা ইসলাম এবং দুটিতে দ্বিতীয় শ্রেণী পাওয়া হারুন-অর-রশীদকে। সীমা ইসলাম ছাত্রলীগ রোকেয়া হল শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক। সিলেকশন বোর্ডে সীমা ইসলামের প্রার্থী বিবরণীতে লেখা ছিল, তিনি অসত্য তথ্য ব্যবহার করেছেন। এ নিয়োগের চরম বিরোধিতা করে সিন্ডিকেট সদস্য তাজমেরী এসএ ইসলাম বলেন, যোগ্য প্রার্থীদের নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হলেও তা আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে সিন্ডিকেটের চার সদস্য আপত্তিপত্র দিয়েছিলাম। কিন্তু সিন্ডিকেট সভাপতি ও ভিসি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ওই নিয়োগ দিয়েছেন। প্রাচ্যকলা বিভাগে বিজ্ঞাপনের শর্ত লঙ্ঘন করে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে হিন্দু প্রার্থী কান্তি দেব অধিকারী ও গোপাল চন্দ্র ত্রিবেদীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বঞ্চিত হয়েছেন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক মাসুদা খাতুন জুঁই। কারুশিল্প বিভাগে এক মেধাবীকে বঞ্চিত করে ফারহানা ও জাহাঙ্গীরকে নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, জাহাঙ্গীরের চেয়ে বঞ্চিত তরুণ নামে প্রার্থী অপেক্ষাকৃত মেধাবী ছিলেন। মৃিশল্প বিভাগে ২ প্রভাষক নিয়োগে মেধার পাশাপাশি দলীয় বিবেচনার বিষয়টি তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের কৈফিয়ত তলব : গত বছর ১১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে প্রভাষক পদে নিয়োগে অনিয়ম’ শিরনামপত্রে অভিযোগের কৈফিয়ত তলব করা হয়। ওই তলবের পর তিন মাস পার হলেও মঞ্জুরি কমিশন ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় কোনো জবাব না পেয়ে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি ফের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে কৈফিয়ত তলব করেছে।কলা অনুষদ : কলা অনুষদের ১৩ বিভাগে ৩৮ প্রভাষক ও ৩ সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলা বিভাগে ৪, পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজে ২, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে ৫, আরবিতে ৫, ইতিহাসে ২, ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে ১, ইংরেজিতে ২, সঙ্গীতে ২, ভাষাবিজ্ঞানে ৩, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতিতে ১, ইসলামিক স্টাডিজে ২, দর্শনে ৫ এবং নাট্যকলায় ৪ জন। ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে নিয়োগ পাওয়া ৩ প্রভাষকের মধ্যে খন্দকার খায়রুন্নাহার নামে জনৈক প্রার্থীর নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রেও যোগ্যদের বঞ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে। পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজে জগন্নাথ বড়ুয়াকে বঞ্চিত করে নীরু বড়ুয়াকে নেয়া হয়েছে। নীরু বড়ুয়া ওই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিমান চন্দ্র বড়ুয়ার স্ত্রী। যার অনার্সে মাত্র ৪৬ শতাংশ নম্বর রয়েছে। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে মামুনুর রশীদ, আবু সাঈদের মতো বেশ ক’জন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও তাদের বাদ দিয়ে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৩২তম স্থান পাওয়া মো. আবদুর রহিমকে নেয়া হয়েছে। নিয়োগ পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি আবার সহকারী অধ্যাপক পদে প্রমোশনও পেয়েছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৩২তম এবং ১৯৯৭ সালে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী পেয়েছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, শুধু দলীয় পরিচয় না থাকায় মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরা বাদ পড়েছেন। ওই নিয়োগের প্রতিবাদে সিলেকশন বোর্ডে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন।ইতিহাস বিভাগে ফলাফলের দিক থেকে বেলাল হোসেন ও নাসির উদ্দিন এই ২ জনকে বঞ্চিত করে রেজাউল করিমকে নিয়োগ দেয়া হয়। ইংরেজি বিভাগে এক প্রভাষক ও এক সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি বিভাগে ড. সামসাদ মর্তুজাকে সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আরবি বিভাগে নিয়োগ পাওয়া ৫ শিক্ষকের মধ্যে ৩ জনকে মেধা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুসরণ করে নিয়োগ দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে জহিরুল ইসলাম ও বেলাল হোসাইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও মাস্টার্সে অধ্যয়নরত অবস্থায় একই সময়ে মাদ্রাসা থেকেও ফাজিল ও কামিলে অধ্যয়ন ও পরীক্ষা দেন। আইন অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত অবস্থায় অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করতে বা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না। এক মেধাবীকে বঞ্চিত করে বাংলা বিভাগে ৪ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। দর্শন বিভাগে ৫ প্রভাষক এবং ১ সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে মন্দিরা নামে এক হিন্দুসহ ৩ জনকে দলীয় বিবেচনায় নেয়া হয়। এছাড়া ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ২, নাট্যকলায় ৪, ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নে ১ এবং সংগীত বিভাগে ২ জনকে মেধা ও দলীয় উভয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদ : এ অনুষদের তিন বিভাগে ১৩ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। ৫ যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিকস ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৭ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অজুহাত দিয়ে এমএল পলাশ অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ১৮তম, মাস্টার্সে ১৯তমকে নিয়োগ দেয়া হয়। অনার্সে ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান প্রাপ্ত ফারজানা ফেরদৌস, জাকির হোসেন, সাহারুজ্জামান, তাফসীর উদ্দিন সুমন, নাসিডকে বঞ্চিত করে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে ৩ প্রভাষক দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দলীয় এ বিবেচনায় ভাগ্য নির্ধারণ করে প্রভাষক হন মিঠুন সরকার, তাসলিমা ফেরদৌস ও সুমাইয়া ফারহানা কবির। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ৫ম ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে ২য় ইব্রাহিমকে বাদ দিয়ে ৩ প্রভাষক নেয়া হয়েছে। জীববিজ্ঞান অনুষদ : এ অনুষদের ৬টি বিভাগে ১৬ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ২য়, মাস্টার্সে ১ম স্থান প্রাপ্ত প্রার্থীকে বঞ্চিত করে মত্স্য বিজ্ঞান বিভাগে দলীয় বিবেচনায় ৩ জনকে প্রভাষক নিয়োগ নেয়া হয়েছে। প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে ৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনার্সে চতুর্থ এবং মাস্টার্সে প্রথমস্থান অধিকারী প্রার্থীকে বঞ্চিত করে অনার্সে ১৭তম ও মাস্টার্সে চতুর্থতম সনিয়া তামান্নাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ নিয়োগের বিরোধিতা করে সিলেকশন কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য অধ্যাপক লায়লা নুর ইসলাম আপত্তিপত্র দেন। জিন প্রকৌশল ও জীব-প্রযুক্তি বিভাগে ৩টি প্রভাষক পদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকজনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি মেধার অনুসরণ হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। মনোবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত ছন্দা কর্মকারকে বঞ্চিত করে পুরোপুরি দলীয় বিবেচনায় ২ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। অনুজীববিজ্ঞানে ২ শিক্ষককে দলীয় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। প্রাণীবিদ্যায় ৩ জনকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হলেও তারা যোগ্যতা সম্পন্ন ছিল। আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদ : এ অনুষদের দুটি বিভাগে ৫ জন শিক্ষক নিয়োগ পান। ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ২ জনকে প্রভাষক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়। এক যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে ভূতত্ত্ব বিভাগে একটি হল শাখার ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ ৩ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। বিজ্ঞান অনুষদ : এ অনুষদের ৬ বিভাগে ১৬ প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়। পদার্থ বিজ্ঞানে ৪; গণিতে ৩; পরিসংখ্যানে ৫; তাত্ত্বিক পদার্থে ২; বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ১ এবং রসায়নে ১ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। পদার্থ বিজ্ঞানে ২ প্রভাষক ও ২ সহকারী অধ্যাপককে সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়। অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ১ম, মাস্টার্সে ৩য় রুহুল আমিন; অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ৩য়, মাস্টার্সে ৪র্থকে বাদ দিয়ে নেয়া হয়েছে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ৮ম, মাস্টার্সে ৬ষ্ঠ স্থান প্রাপ্ত কাজী হানিয়াম এবং অনার্সে ৩য়, মাস্টার্সে ৪র্থ রতন চন্দ্র ঘোষকে। এছাড়া বিজ্ঞাপনের শর্ত লঙ্ঘন করে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে স্বপন কুমার ঘোষকে। বিজ্ঞাপনের শর্তে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগ্যতা হিসেবে সাত বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও ঘোষের একদিনেরও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিল না। এক্ষেত্রে বিভাগের অভ্যন্তরীণ প্রার্থী সাদত হোসেন, সাহাবুল আলম শর্ত পূরণ করলেও তাদের বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নেয়া হয়েছে। গণিত বিভাগে এক যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে ৩ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম মুহিবুজ্জামানকে বঞ্চিত করে সোহানা জাহানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফার্মেসি অনুষদ : এ অনুষদের দু’টি বিভাগে ৮ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগে দু’জনকে বঞ্চিত করে ৫ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ২য়, মাস্টার্সে ১ম আবদুল্লাহ আল মারুফ এবং অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ৩য়, মাস্টার্সে ২য় ইসরাত জাহানকে বাদ দিয়ে নেয়া হয়েছে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ১১তম, মাস্টার্সে ২য় আব্দুল মুহিত এবং অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ৮ম, মাস্টার্সে ৬ষ্ঠ আহসানুল আকবরকে। ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ৪র্থ, মাস্টার্সে ১ম মো. গিয়াস উদ্দিন এবং অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে ৫ম, মাস্টার্সে ১ম সাদিয়া আফরিনকে বঞ্চিত করে ৩ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ : এ অনুষদের ৬ বিভাগে ২১ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অর্থনীতিতে ৬, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ৪, নৃবিজ্ঞানে ৫, উইমেন জেন্ডার স্টাডিজে ৩, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে ২ প্রভাষক এবং লোক প্রশাসনে ১ সহকারী অধ্যাপক।অর্থনীতি বিভাগে ৬ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়। এরমধ্যে অর্চি মধুবীমা বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আতিউর রহমানের মেয়ে। অর্চি মধুবীমা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পেলেও শেষ পর্যন্ত যোগদান করেননি বলে জানা গেছে। লোক প্রশাসন বিভাগে নুসরাত জাহান চৌধুরীকে সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও অন্য যোগ্য প্রার্থীরা বাদ পড়েছেন। এর প্রতিবাদে সিলেকশন বোর্ডে নোট অব ডিসেন্ট দেন বিভাগের চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্য। বঞ্চিত হন তার চেয়ে যোগ্য প্রার্থী শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের প্রভাষক সাইফুদ্দিন আহমদ ও সাবের আহমেদ চৌধুরী। নৃবিজ্ঞান বিভাগে ৫ প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সিলেকশন কমিটির সদস্যদের অভিযোগ, নিয়োগপ্রাপ্ত সৈয়দ আরমান হোসেন, ফারিবা আলমগীর ও জোবাইদা নাসরীনের চেয়ে ৩/৪ জন অধিক মেধাবী প্রার্থী ছিল। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীনগর থেকে পাস করা ও সাবেক এনজিও কর্মী জোবাইদা নাসরীনকে নেয়া হয়। ওই নিয়োগের বিরোধিতা করেছেন সিলেকশন কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য ও শিক্ষকরা।। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে খাতির থাকায় তিনি এ নিয়োগ পান। নিয়োগের পর তিনি বিভাগে এতোই প্রভাব বিস্তার করছেন যে, সিনিয়র শিক্ষকরা পর্যন্ত অস্বস্তিতে রয়েছেন।ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ : এই অনুষদের ৮ বিভাগে ৩৫ প্রভাষক ও ২ সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে মার্কেটিং-এ ২ সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্টে প্রভাষক ৩, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে ৬, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে ৪, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমে ৬, ফাইনান্সে ৯ এবং ব্যাংকিং-এ ৪ প্রভাষক নিয়োগ পেয়েছেন। মার্কেটিং বিভাগে ২ সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ কোটায় আতাউর রহমানকে নিয়োগের শর্তই লঙ্ঘন করা হয়। নিয়োগের শর্তে চার বছর মেয়াদি বিবিএ এবং এমবিএ চাওয়া হলেও আতাউর রহমান ছিলেন বিকম ও এমকম পাস। বিকমে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২৪তম স্থানে ছিলেন। ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ৩ প্রভাষক ও ১ সহকারী অধ্যাপককে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে সহকারী অধ্যাপক পদে ফুলব্রাইট তাহমিনা খানমকে সুপারসিট করে সুমন দাসকে নেয়া হয়েছে। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে জাতীয় সংসদের বর্তমান স্পিকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদের আত্মীয় বদরুজ্জামানসহ ৬ প্রভাষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাকি ৫ জন হলেন সালমা আক্তার, নুসরাত জাহান, মোহাম্মদ রুহুল আমিন, সন্তোষ কুমার দেব ও মো. কামরুল হাসানকে মেধার পাশাপাশি দলীয় বিবেচনায় ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত ৬ জনের মধ্যে একজনকে চরমভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। অনার্সে সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে ৪ এবং মাস্টার্সে ৩. ৯৬ পাওয়া বঞ্চিত প্রার্থী ইশতার মহল প্রতিকার চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে বিচার দিয়েছে। তার বিচার আবেদনের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে ৪ প্রভাষকের ৩ জন দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে আশীষ তালুকদার হিন্দু, কেএম সালাউদ্দিন ছাত্রজীবনে একটি হল শাখার ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। মো. আকরাম হোসেনও দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পান। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসে ৩, ফিন্যান্সে ৯ এবং ব্যাকিং-এ ৩ প্রভাষকের ক্ষেত্রে মেধার সঙ্গে দলীয় বিবেচনা নিয়োগপ্রাপ্তদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে।শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট : শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে ১১ জনকেই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গোপালগঞ্জ এলাকার বলে নিজেকে পরিচয় দেয়া মোহাম্মদ আশরাফ সাদেক, কুমিল্লার একটি কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহরিয়ার হায়দার, প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের আত্মীয় পরিচয়ে সুমেরা আহসান, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে ইনস্টিটিউট থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা মাহাবুব রহমান পুরোপুরি দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন। এছাড়া শিক্ষাজীবনে ৪টিতে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত শিল্পী হালদার ও বদরুল আলমকে বাদ দিয়ে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণী প্রাপ্ত তাপস কুমার বিশ্বাস, অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণী প্রাপ্ত দেবদাস হালদারকে নিয়োগ দেয়া হয়। বিজ্ঞানে কম্পিউটার সায়েন্সের একটি পদে নিয়োগের কথা থাকলেও তা না নিয়ে বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তি পদের ১টি করে পদের জায়গায় ২ জন নেয়া হয়। এরা হলেন শারমিন কবীর ও তামান্না সুলতানা। ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের অভিযোগ, বোর্ড অব গভর্নিং (বিওজি) বডি থেকে ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকদের সরিয়ে দিয়ে দলীয়ভাবে তা গঠন করে এ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউট : সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটে ৩ প্রভাষক এবং ১ সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং গোল্ড মেডেল পাওয়া মুস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন প্রার্থীকে বঞ্চিত করে প্রভাষক পদে মইনউদ্দিন মোল্লা, অনুরাধা বর্ধন ও আশরাফুল ইসলাম এবং সহকারী অধ্যাপক সাহানা নাসরীনকে নেয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, মইনউদ্দিন ও অনুরাধাকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের মাস্টার্সের ফলাফল দু্রত প্রকাশ করতে শিক্ষকদের চাপ প্রয়োগ করে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদসহ কয়েকজন প্রভাবশালী শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করিয়ে নেন। সাহানা নাসরীন পরিচালকের ঘনিষ্ঠ লোক ছিলেন। শিক্ষকদের অভিযোগ, সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটে দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে বোর্ড অব গভর্নর (বিজি) বডিকে পুরো দলীয়ভাবে গঠন করা হয়। এছাড়া ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটে ৪, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে ২ প্রভাষক নিয়োগে মেধার সঙ্গে দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ : নিয়োগে অনিয়ম, দলীয়করণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত প্রশাসনের প্রো-ভিসি ও সিলেকশন বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ ফ ম ইউসুফ হায়দার বলেন, আমি যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে শিক্ষক নিয়োগে মেধার চেয়ে দলীয় বিবেচনাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় ছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে যে সিলেকশন কমিটি করা হয়েছে, তা কট্টর দলীয় সদস্যের সমন্বয়ে করা হয়েছে। অনিয়ম বন্ধে সক্রিয় ও কার্যকর প্রতিবাদ না হওয়ায় এ অনিয়ম হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তার প্রশাসনের সময় দলীয়করণের অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যাপক হায়দার বলেন, দলীয় বিবেচনায় একটা নিয়োগও হয়নি। আমরা নিয়োগ দিয়েছি মেধার ভিত্তিতে। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি প্রার্থীর কোনো দলীয় মতাদর্শ থাকে, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ বিষয়ে কলা অনুষদের ডিন ও সিন্ডিকেট অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন বলেন, অযোগ্যদের দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের একমাত্র কারণ ভোটের রাজনীতি। পরিকল্পিতভাবে নিয়োগের আগে প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজা হয় এবং নিয়োগ পরবর্তীতে ৯০ শতাংশকে দলের কট্রোলে নিয়ে আসা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রশাসন মেধাবীদের প্রতি অবিচার করে তাদের আশা ও স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। তিনি অতীত ইতিহাস স্মরণ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন ’৭০-এর দশকে ফিরে গেছেন। ’৭৩-এ প্রচুর দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। গত প্রশাসনের সময় দলীয়করণের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, অতীতে অনিয়ম হয়ে থাকলে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক। ভিসি’র বক্তব্য : নিয়োগে অনিয়ম ও দলীয়করণের অভিযোগ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও সিলেকশন বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান নবায়নের ক্ষেত্র। এই নবায়ন মেধাবী, নবীন ও তরুণ গবেষকরাই করবে। বিশ্বে ও সব বিশ্ববিদ্যালয়েই একই সংস্কৃতি। আর এ দর্শনকে সামনে রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ও বিধি-বিধান অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রশাসনের আড়াই বছরে যেসব নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই হয়েছে।