Sunday, 1 January 2012

বছরের আলোচিত উক্তি










এমরান হোসাইন

সদ্য বিদায় নেয়া বছরে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের কয়েকটি উক্তি বছরজুড়েই ছিল আলোচিত। এসব উক্তি ছিল মানুষের মুখে মুখে, টক অব দ্য কান্ট্রি। গণমাধ্যম এসব আলোচিত উক্তি নিয়ে আকর্ষণীয় কার্টুনও প্রকাশ করেছে।
টাকা থাকলে ঢাকাকে চার ভাগ করতাম : প্রধানমন্ত্রী
সরকার সম্প্রতি চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী শহর ঢাকাকে দুটি সিটি করপোরেশনে বিভক্ত করেছে। গত ৩০ নভেম্বর মাত্র চার মিনিটে এ সংক্রান্ত বিল বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে পাস হয়। ঢাকা সিটিকে দুই ভাগ করার বিল পাসের আগে-পরে সংসদের বাইরে বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিল পাসের পরদিন ৩০ নভেম্বর সংসদের সমাপনী ভাষণে এসব সমালোচনার জবাব দেন। ওইদিন তিনি বলেন, সরকার নগরবাসীর দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে ঢাকা সিটিকে দুই ভাগ করেছে। ডিসিসি ভাগের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দেয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, ঢাকা সিটিকে দু’ভাগ করেছি। আমাদের যথেষ্ট টাকা থাকলে চার ভাগ করতাম।
বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
গত বছরের বহুল আলোচিত উক্তি ছিল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও বর্তমানে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। বাঘে ধরে কাউকে ছাড়লেও শেখ হাসিনা কাউকে ধরলে ছাড়েন না বলে তিনি মন্তব্য করেন। সরকার নোবেল শান্তি বিজয়ী ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের পর সুরঞ্জিত এ ধরনের উক্তি করেন। গত ২৪ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রজন্ম একাত্তরের এক আলোচনা সভায় বিরোধী দল বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখবেন—বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে কাউকে ছাড়ে না। ছাড়ছে? ছাড়ছে? ছাড়ছে ইউনূস মিয়াকে?’
আমি হিন্দু নই মুসলমানও নই : আশরাফ
গত ১৩ জুলাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বের সম্মানে আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ওই অনুষ্ঠানে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীসহ সাম্প্রতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়। অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানান সৈয়দ আশরাফ। এ সময় তিনি স্বীকার করেন, সংশোধিত সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এ সময় জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজের ধর্মবিশ্বাসের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমি মুসলমানও নই, হিন্দুও নই।’ মুসলিম পরিবারের ছেলে ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্য দলের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক ঝড় তোলে।
কম খান : ফারুক খান
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বর্তমানে বেসরকারি বিমান চলাচলমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানের কম খাওয়ার পরামর্শ বিষয়ের উক্তিটিও কম উপভোগ্য ছিল না। গত ৪ আগস্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে মন্ত্রী বলেন, আমি বললে তো আপনারা রাগ করবেন। কম খান। একবেলা কম খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে আর ব্যবসায়ীদের মুনাফা কমে যাবে। ফলে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াবে না। মন্ত্রী নিজেও কম খান বলে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।
সিপিডির বক্তব্য টোটালি রাবিশ : অর্থমন্ত্রী
গত ৫ জুন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বক্তব্যকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, সিপিডির বক্তব্য অত্যন্ত অন্যায়, দুষ্ট এবং ‘টোটালি রাবিশ, বোগাস’।
এর আগেরদিন ৫ জুন এক অনুষ্ঠানে সরকারের ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হারের প্রাক্কলন ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশকে সিপিডি প্রশ্নসাপেক্ষ উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রী অপর এক অনুষ্ঠানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে সপ্তাহে একদিন বাজারে কম যাওয়ার পরামর্শ দেন।
ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে ফি চাওয়া হবে অসভ্যতা : ড. মসিউর রহমান
ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার মাধ্যমে ফি আদায়ের প্রসঙ্গ এলে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বিনা ফি’তে ট্রানজিট দেয়ার কথা জানান। ট্রানজিটের বিনিময়ে ফি আদায় নাকি অসভ্যতা (!) বলে মন্তব্য করেন এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা ট্রানজিট দেয়ার বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে কোনো ফি দাবি করতে পারি না। ট্রানজিট চুক্তি বিষয়ে আমার বক্তব্য সবসময় একটাই। আমরা এখন সিভিলাইজড (সভ্য) কান্ট্রিগুলোর অন্তর্ভুক্ত। সেই হিসেবে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিনিময়ে আমরা কোনো ফি দাবি করতে পারি না। এটা করলে আমরা আনসিভিলাইজড (অসভ্য) কান্ট্রিগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। বাংলাদেশ যদি অসভ্য ও অশিক্ষিত দেশ হতো, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা যদি অসভ্য ও অশিক্ষিত হতেন, তাহলে ট্রানজিটের জন্য ফি চাওয়া যেত।’ পরে ১২ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে এই উপদেষ্টা বলেন, আমাদের লোকজন অভিজ্ঞ না হওয়া পর্যন্ত ভারত থেকে ফি নেয়া হবে না। এর আগে গত বছরের প্রথমদিকে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রভাবশালী উপদেষ্টা শেয়ারবাজার বিপর্যয় নিয়ে মন্তব্য করেন। গত বছর ২০ জানুয়ারি খুলনার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে ধসের জন্য সরকারের মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই; কারণ কতকগুলো লোক (শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী) যদি অর্থনীতিতে অবদান না রেখে লাভবান হতে চায়, তাদের কষ্টে আমার হৃদয় কাঁদে না।
টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের বরং ভালোই হবে : গওহর রিজভী
টিপাইমুখে ভারত বাঁধ ও জলবিদ্যুত্ প্রকল্প নির্মাণে চুক্তি করার খবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও ড. গওহর রিজভীকে দিল্লি পাঠান বাস্তব পরিস্থিতি জানতে। দিল্লি সফর শেষে গত ৩ ডিসেম্বর দেশে ফেরেন এই দুই উপদেষ্টা। দেশে ফিরে বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে সফরের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রতিক্রিয়াকালে ড. গওহর রিজভী সাংবাদিকদের বলেন, ‘টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না; বরং ভালোই হবে। আমরা একেবারেই সেটিসফাইড হয়ে এসেছি। এ নিয়ে ভারত যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এ নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।’
গরু-ছাগল চিনলেই লাইসেন্স দেয়া যায় : নৌপরিহনমন্ত্রী
গত বছর একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে দেশবাসী যখন সোচ্চার, পরীক্ষা ছাড়া (অশিক্ষিত ব্যক্তিদের) ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার বিরুদ্ধে যখন সামাজিক সংগঠনগুলোর আন্দোলন তুঙ্গে, তখনই নৌপরিবহনমন্ত্রী ও পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। গত ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে তার মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, দেশে চালকের সঙ্কট আছে। এজন্য অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেয়া দরকার। আর চালকরা সিগন্যাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, ভেড়া-মহিষ-মানুষ চেনে। সুতরাং তাদের লাইসেন্স দেয়া যায়।’ এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর নিজ নির্বাচনী এলাকায় একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে অশিক্ষিত ও অপ্রশিক্ষিত চালকদের পক্ষ নিয়ে নৌমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ড্রাইভারও ফাইভ পাস। সে-ও ভালো গাড়ি চালায়।’
আমি গণক নই যে বলব, কবে তিস্তা চুক্তি হবে : দীপু মনি
সরকারের দৃঢ়বিশ্বাস থাকলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ক্ষমতাসীন সরকার। গণমাধ্যম কর্মীসহ বিভিন্ন স্তরের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের। গত ৪ অক্টোবর এ ধরনের একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ওইদিন তার মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘কবে তিস্তা চুক্তি হবে’ সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বেশ ক্ষুব্ধ হন দীপু মনি। তিনি বলেন, ‘আপনারা কেন হতাশ হচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি না। আমি গণক নই যে বলতে পারব, তিস্তা চুক্তি কবে হবে।’ এ ব্যাপারে উভয় দেশের সম্মতি আছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সমুন্নত রেখেই চুক্তিটি হবে। ভবিষ্যতে কবে তিস্তা চুক্তি হবে, এমন সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ বলতে পারছি না। গত ৪০ বছর এটা নিয়ে কেউ কিছু করেনি। আমরা এখন করছি। আওয়ামী লীগ সরকার এ চুক্তি করবে।
সন্তু লারমার শান্তিতে নোবেল পাওয়া উচিত ছিল : অ্যাটর্নি জেনারেল
নোবেল শান্তি বিজয়ী ড. ইউনূসের রিট আবেদনের ওপর উচ্চ আদালতে শুনানিকালে গত ৮ মার্চ নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আপনারা নোবেল প্রাইজটাকে এত বড় করে দেখছেন কেন? বাংলাদেশে যদি শান্তির জন্য নোবেল প্রাইজ পেতে হয় তাহলে আমি বলব, দু’জনের পাওয়া উচিত ছিল— শেখ হাসিনা আর সন্তু লারমার। কারণ একটি বিরাট এলাকা সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। যেখানে সেনাবাহিনী ছাড়া আমাদের যাওয়ার অবস্থা ছিল না। সেখানে আজ আমরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করছি। শান্তি ফিরে এসেছে। এই শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য দু’জন কাজ করেছেন, শেখ হাসিনা আর সন্তু লারমা। তারা নোবেল প্রাইজ পাননি বলে কি শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের যে কাজ, তা কম হয়ে যাবে?’
এদিকে সরকার ও দলের বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের আলোচিত-সমালোচিত মন্তব্য করেন। জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদও সংসদকে মাছের বাজার বলে মন্তব্য করেছিলেন। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শওকত মোমেন গত ১৭ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিখ্যাত কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে (বীর উত্তম) যুদ্ধাপরাধী উল্লেখ করে তার বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ভয়াবহ চুরির পর ৬ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে মন্দিরে চুরি হয়েছে।

অলীক স্বপ্ন মিথ্যাচারে হতাশ জনগণ










মাহাবুবুর রহমান

তিন বছরের শাসনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে ও মিথ্যাচার করে জনগণকে হতাশ করেছে বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। তাদের মতে, পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এলেও সরকার কোনো ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সরকার দেশকে অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিয়েছে। জিনিসপত্রের দাম কমানোর অঙ্গীকার থাকলেও লাগামহীনভাবে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। দুর্নীতিতে আন্তর্জাতিকভাবে এ সরকার নতুন সার্টিফিকেট এনেছে। বাগাড়ম্বর কূটনীতিতে আন্তর্জাতিক বন্ধু কমেছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে বিশেষ কোনো সাফল্য নেই। জনশক্তি রফতানিতে ধস নেমেছে আশঙ্কাজনক হারে। পদ্মা সেতু নির্মাণ, ঘরে ঘরে চাকরি, বিনামূল্যে সার এবং সুশাসন ও মানবাধিকারের আশার আলো দেখা যায়নি। রাস্তাঘাটসহ নতুন কোনো যোগাযোগ অবকাঠামো যোগ হয়নি এ সরকারের আমলে। উপরন্ু্ত আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে গুপ্তহত্যা চলছে, জনমনে চরম নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিতে চলমান অস্থিরতা নিরসন এ সরকারের দ্বারা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা কাটাতে না পারলে রাষ্ট্রব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
সরকারের তিন বছরের শাসনের মূল্যায়নে আমার দেশ-এর সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট চিন্তক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এরা হলেন—বদরুদ্দীন উমর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান, বিবিসি খ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ও দৈনিক আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান।
বিশিষ্ট চিন্তক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদরুদ্দীন উমর বলেন, ঢেঁকিকে জিজ্ঞেস করলে বলে—আমরা স্বর্গে যাচ্ছি। সরকারও কেবল বলছে—দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছি। বস্তুতপক্ষে তিন বছরে সবক্ষেত্রেই ভয়াবহ নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। জনগণেরও কিছু করার নেই। কোন দিকে যাবে। বিকল্পও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। আশাপ্রদ কিছু পেলে এভাবে দেশ শাসন করে তিন বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেত না এ সরকার। তিনি বলেন, দেশে একটি অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অপরাধের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। সবাই পার পেয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে অরাজকতা ও নৈরাজ্য হবেই। এটাই এখন সবচেয়ে বড় সঙ্কট। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক দিকটিই সবচেয়ে বেশি খারাপ। একদিন বলছে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। আরেক দিন বলছে—হবে না। এভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না।
তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ পুরোপুরি অকার্যকর। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকার পড়ে আছে অন্য দেশের ওপর। সরকার ও বিরোধীদলের নির্ভরতায় ভারত, আমেরিকা ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে ব্যবহার করে। বিরোধীদলের যে দায়িত্ব পালন করা দরকার, তাও তারা করে না। সরকারের মতোই জনগণের প্রতি সামান্যতম দায়িত্ববোধ তাদের নেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, তিন বছরে সরকার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কাছাকাছিও যেতে পারেনি। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী কাজ করেছে। ১০ টাকা কেজি চাল দিতে চেয়েছে, বিনা টাকায় সার দিতে চেয়েছে। দ্রব্যমূল্য পাগলা ঘোড়ার মতো বিপরীতমুখী হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি এমন একটি অবস্থায় গেছে অপহরণ গুম-খুন এখন অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। অর্থনৈতিক ব্যর্থতা আকাশ ছুঁয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারেনি। বিদেশে ভাবমূর্তি ভয়ঙ্কর ক্ষুণ্ন হয়েছে। দুর্নীতি বেড়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্নীতির নতুন সার্টিফিকেট পেয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের সুযোগটাও তারা নষ্ট করেছে। তত্ত্বগতভাবে না থাকলেও বাস্তবে তারা একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে। তবে একদিকে তারা সফল—সেটা হলো ভারতবান্ধব হয়ে ভারত যা চেয়েছে, তার চেয়েও বেশি তারা দিয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে তাদের কোনো শক্ত বক্তব্য নেই। ভারতের আচরণে মনে হয়, বাংলাদেশ যেন একটি করদরাজ্য।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খান বলেন, সরকারের তিন বছরের মূল্যায়ন করাটা কঠিন। এটা অনেক পরিসংখ্যানের বিষয়। মূল্যায়নে সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ানই তুলে ধরা হয়। এ সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আবার কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। আরও হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো—কোনো সরকারই সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে না। এ সরকারও পারেনি। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য কমানো তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সর্বপ্রধান অঙ্গীকার ছিল। সেটা সম্ভব হয়নি। দ্রব্যমূল্য আরও বেড়ে গেছে। এটা উদ্বেগের। তিনি বলেন, সরকারের শাসনামল মূল্যায়নে এককেন্দ্রিক পর্যালোচনা বা তালিকা তুলে ধরা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তবে তিন বছরে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি। এটা সরকারের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, উন্নয়নশীল দেশে ৫ বছর মেয়াদি সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রথম তিন বছরই গুরুত্বপূর্ণ। এটিই অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নের মূল সময়। সার্বিক বিবেচনা করলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এ সময়ে সফলতা দেখাতে পারেনি। নির্বাচনী ইশতেহার বিবেচনায়ও তারা অসফল। পদ্মা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন, চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সারের দাম কমানো, বেকারত্ব নিরসন, গুপ্তহত্যা না হওয়া, সংসদ কার্যকর ও আগামীতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আস্থাজনক পরিস্থিতির সুযোগ রাখলেও সরকারের প্রতি জনগণের অবিশ্বাস এবং অনাস্থা কম থাকত। সাধারণ মানুষ দূরে থাক, মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও সরকারকে বিশ্বাস করছে না। পরিবর্তনের স্লোগান কেবল সরকারি দলের নেতাকর্মীদের অর্থ, চাকরি ও বিত্তবৈভবে ঘটেছে। নাগরিকদের জীবনে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে।
বিবিসি খ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ বলেন, ১৯৪৮ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখে এসেছি এবং ’৯০-এর এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তার প্রতিফলন হয়নি। কেবল সংসদীয় সরকার ছাড়া দেশের মানুষ কিছুই পায়নি। তিনি বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সংসদে গেলেই বা কি, না গেলেই বা কি? কিন্তু বিএনপি প্রথম থেকেই সংসদে যাচ্ছে। সেই বিরোধীদলকে সরকার সংসদে থাকতে দেয়নি। জনগণের মতামত ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। মানুষ তো সরকারকে বিশ্বাস করছে না। কোনো কিছুই গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে। দুর্নীতির জন্য প্রায়ই আমরা সারাবিশ্বে আলোচিত। প্রত্যেক দিনই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। অন্যদিকে, উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না কৃষক। অর্থনীতি নিয়ে কথা বলারও সুযোগ নেই। সমস্যাগুলো এত স্পষ্ট যে, সেগুলো নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্দশার জন্য নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে। এ সরকারের দ্বারা বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। তিন বছরে সরকার চলেছে অলীক স্বপ্ন ও মিথ্যা কথার ওপর। কূটনীতিও চলছে বাগাড়ম্বের ওপর। সামগ্রিকভাবে সরকারি কর্মকাণ্ডই দেশকে সঙ্কটে ফেলেছে।
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফীতি ও বাজেট অর্থায়নে সঙ্কট, ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট, ব্যাংক থেকে ব্যাপক ঋণ গ্রহণ, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে আমদানি ও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে সঙ্কট, বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, গুপ্তহত্যা-গুম-খুন, নির্যাতন, মামলা, সংসদ কার্যকর রাখতে ব্যর্থতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ, সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল এবং এর ফলে চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি, গণতান্ত্রিক মূল্যাবোধের অবক্ষয়, ভারত সরকারের কাছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের বিসর্জনসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য না থাকায় পদ্মা সেতু করতে পারবে বলে জনগণ মনে করছে না। তিনি বলেন, খাদ্যশস্য উত্পাদনে সফলতা ছিল। তাও এ বছর ভুল শস্যনীতির কারণে কৃষকরা দাম পাচ্ছেন না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের একটি সফলতা আছে। সেটি হলো—অসংখ্য ব্যর্থতার মাঝেও ক্ষমতায় থেকে যে কোনো উপায়ে বিরোধীদলকে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে সরকার।
সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বলেন, বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতির এক বিশাল বহর নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। নির্বাচনে জয়লাভের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নাতীত না হলেও তারা এ বিজয়কে জনগণের রায় হিসেবে দাবি করে। সে বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। জরুরি হলো—তিন বছরের মূল্যায়ন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যতটুকু সাফল্য তা উল্লেখযোগ্য নয়। যেহেতু সরকার ভালো কিছু করতেই ক্ষমতায় আসে। কিন্তু তিন বছরে বিরোধীদল ও মতের দমন, দুষ্টের লালন, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি, নিজের দুষ্কর্ম ঢাকতে গুম-খুন, দলীয় কর্মীদের দ্বারা শিক্ষকদের নির্যাতন ও টেন্ডারবাজি, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে দলীয়করণ, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধ, বিনা কারণে আমার দেশ সম্পাদককে ৬ মাস কারাদণ্ড, রাজনৈতিক বিতর্ককে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে রায় নেয়া, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা না জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, আন্তর্জাতিক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া এবং মন্ত্রিসভার দক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সে প্রশ্ন গত তিন বছরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া রাজধানী ও বাইরে যানজট, দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় অত্যাচার মানুষকে বিব্রত এবং ব্যথিত করেছে। দু’টি, তিনটি বা চারটি ক্ষেত্রে ভালো কাজ করে থাকলেও তা খারাপ কাজের অন্ধকারের কাছে নিষ্প্রভ হয়ে গেছে।
মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, তিন বছরে সরকার নানা চ্যালেঞ্জে ছিল। গত দু’বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সমানে আছে, চলছে। অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আর্থিক সঙ্কট চরমে। কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সফলতা দেখাতে পারেনি। উপরন্তু বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের স্বার্থ নষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হয়েছে। ড. ইউনূস প্রসঙ্গে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে বিশেষ কোনো সাফল্য নেই। জনশক্তি রফতানিতে চরমভাবে ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের চেষ্টা রাজনীতিকে অস্থির করেছে। যে কারণে অন্য ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ, ঘরে ঘরে চাকরি, মানবাধিকার রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। মানবাধিকার কমিশন গঠন হলেও ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যা যা কিছু করা যায় সবই তারা করেছে। খুন-খারাবি গুপ্তহত্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়নি। দুর্নীতি বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। তিনি বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের সফলতা আছে। খাদ্যে স্থিতিশীল অবস্থা। জঙ্গিবাদ দমনে মোটামুটি সফলতার দিকে রয়েছে।
দৈনিক আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, প্রথম কথা হলো সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি যেটা ছিল ‘পরিবর্তন’। রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন করবে। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিতে প্রচুর মানুষ আপ্লুত হয়েছিল। আমরা এক-এগারোর তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে পরিবর্তন জরুরি মনে করেছিলাম। এক-এগারোর কারণে রাষ্ট্র কাঠামো, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ জায়গাতেই মূলত হতাশা। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। বিদ্যুতের ঘাটতি, ঢাকায় পানি সরবরাহ, ট্রেনের সিস্টেম, যোগাযোগের ঘাটতি, বড় ও ছোট রাস্তার স্বল্পতা, জাতীয় অর্থনীতির লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন করার ঘাটতি এবং পদ্মা সেতু করা দূরে থাক এ সরকারের সময়ে কাজ শুরু হওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা জনগণের জন্য ভালো খবর নয়। তিনি বলেন, ক্ষমতার শুরুতে বিদ্যুত্ উত্পাদনে উদ্যোগ না নিয়ে সময়ক্ষেপণের পর তড়িঘড়ি করে কুইক পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন, আবার তাতে ইনডেমনিটি আইন করা হলো। শুরু থেকে করলে সবকিছু করা সম্ভব ছিল। অনেকেই এটা ভালো চোখে দেখছেন না। অনেকেই বলছেন, এতে দুর্নীতির উত্সাহ ছিল কি না, তাদের এ বলার পেছনে যুক্তি আছে।
নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে বড় বিষয়। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তনের অনিশ্চয়তা তৈরি করা হয়েছে। এটা করতে জনগণের মতামত তো নেয়া হয়-ই-নি, বরং মহাজোটও এতে একমত হয়নি। আওয়ামী লীগের সবাইও একমত ছিল না, আওয়ামী লীগের একক সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হলো। সবকিছু মিলে সরকারের তিন বছরে যা কিছু পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল তার কিছুই দেখছি না। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ, পিএসসি, পুলিশ, চিকিত্সক, সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি প্রশাসনে পরিবর্তনের প্রত্যাশা ছিল। এটা হয়নি। তিন বছরে ব্যর্থতার জায়গাটায় এগুলোই বেশি।
সরকারের সফলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের মতো মারাত্মক ঘটনার পরও গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখাটা বিশাল সফলতা। তাছাড়া তিস্তার পানি না দিলে ট্রানজিটের আনুষ্ঠানিক চুক্তি না করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন করে চুক্তি কিন্তু সরকার এভয়েড করেছে। মানুষের সম্মিলিত চাপে বা তাদের সদিচ্ছায় তারা কিছু পজেটিভ ধারণা সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও গণতান্ত্রিক সমাজে আলোচনার উদ্যোগ তারা নিয়েছে। মৌলিক না হলেও কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ আছে। যেমন—সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বিরোধী দলকেও পদ দেয়া হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন কার্যকর না হলেও তারা পাশ করেছে। সাংবাদিকদের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি না করে সমন করতে হবে। এসব অগ্রগতি হিসেবে দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বললেও নির্বাচিতদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ফাঁক রেখেছেন। অসংখ্য হতাশার মধ্যেও এসবকে আশা হিসেবে দেখা যেতে পারে।