Sunday 1 January 2012

বছরের আলোচিত উক্তি










এমরান হোসাইন

সদ্য বিদায় নেয়া বছরে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের কয়েকটি উক্তি বছরজুড়েই ছিল আলোচিত। এসব উক্তি ছিল মানুষের মুখে মুখে, টক অব দ্য কান্ট্রি। গণমাধ্যম এসব আলোচিত উক্তি নিয়ে আকর্ষণীয় কার্টুনও প্রকাশ করেছে।
টাকা থাকলে ঢাকাকে চার ভাগ করতাম : প্রধানমন্ত্রী
সরকার সম্প্রতি চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী শহর ঢাকাকে দুটি সিটি করপোরেশনে বিভক্ত করেছে। গত ৩০ নভেম্বর মাত্র চার মিনিটে এ সংক্রান্ত বিল বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে পাস হয়। ঢাকা সিটিকে দুই ভাগ করার বিল পাসের আগে-পরে সংসদের বাইরে বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিল পাসের পরদিন ৩০ নভেম্বর সংসদের সমাপনী ভাষণে এসব সমালোচনার জবাব দেন। ওইদিন তিনি বলেন, সরকার নগরবাসীর দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে ঢাকা সিটিকে দুই ভাগ করেছে। ডিসিসি ভাগের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দেয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, ঢাকা সিটিকে দু’ভাগ করেছি। আমাদের যথেষ্ট টাকা থাকলে চার ভাগ করতাম।
বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
গত বছরের বহুল আলোচিত উক্তি ছিল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও বর্তমানে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। বাঘে ধরে কাউকে ছাড়লেও শেখ হাসিনা কাউকে ধরলে ছাড়েন না বলে তিনি মন্তব্য করেন। সরকার নোবেল শান্তি বিজয়ী ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের পর সুরঞ্জিত এ ধরনের উক্তি করেন। গত ২৪ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রজন্ম একাত্তরের এক আলোচনা সভায় বিরোধী দল বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখবেন—বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে কাউকে ছাড়ে না। ছাড়ছে? ছাড়ছে? ছাড়ছে ইউনূস মিয়াকে?’
আমি হিন্দু নই মুসলমানও নই : আশরাফ
গত ১৩ জুলাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বের সম্মানে আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ওই অনুষ্ঠানে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীসহ সাম্প্রতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়। অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানান সৈয়দ আশরাফ। এ সময় তিনি স্বীকার করেন, সংশোধিত সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এ সময় জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজের ধর্মবিশ্বাসের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমি মুসলমানও নই, হিন্দুও নই।’ মুসলিম পরিবারের ছেলে ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্য দলের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক ঝড় তোলে।
কম খান : ফারুক খান
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বর্তমানে বেসরকারি বিমান চলাচলমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানের কম খাওয়ার পরামর্শ বিষয়ের উক্তিটিও কম উপভোগ্য ছিল না। গত ৪ আগস্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে মন্ত্রী বলেন, আমি বললে তো আপনারা রাগ করবেন। কম খান। একবেলা কম খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে আর ব্যবসায়ীদের মুনাফা কমে যাবে। ফলে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াবে না। মন্ত্রী নিজেও কম খান বলে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।
সিপিডির বক্তব্য টোটালি রাবিশ : অর্থমন্ত্রী
গত ৫ জুন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বক্তব্যকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, সিপিডির বক্তব্য অত্যন্ত অন্যায়, দুষ্ট এবং ‘টোটালি রাবিশ, বোগাস’।
এর আগেরদিন ৫ জুন এক অনুষ্ঠানে সরকারের ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হারের প্রাক্কলন ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশকে সিপিডি প্রশ্নসাপেক্ষ উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রী অপর এক অনুষ্ঠানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে সপ্তাহে একদিন বাজারে কম যাওয়ার পরামর্শ দেন।
ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে ফি চাওয়া হবে অসভ্যতা : ড. মসিউর রহমান
ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার মাধ্যমে ফি আদায়ের প্রসঙ্গ এলে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বিনা ফি’তে ট্রানজিট দেয়ার কথা জানান। ট্রানজিটের বিনিময়ে ফি আদায় নাকি অসভ্যতা (!) বলে মন্তব্য করেন এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা ট্রানজিট দেয়ার বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে কোনো ফি দাবি করতে পারি না। ট্রানজিট চুক্তি বিষয়ে আমার বক্তব্য সবসময় একটাই। আমরা এখন সিভিলাইজড (সভ্য) কান্ট্রিগুলোর অন্তর্ভুক্ত। সেই হিসেবে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিনিময়ে আমরা কোনো ফি দাবি করতে পারি না। এটা করলে আমরা আনসিভিলাইজড (অসভ্য) কান্ট্রিগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। বাংলাদেশ যদি অসভ্য ও অশিক্ষিত দেশ হতো, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা যদি অসভ্য ও অশিক্ষিত হতেন, তাহলে ট্রানজিটের জন্য ফি চাওয়া যেত।’ পরে ১২ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে এই উপদেষ্টা বলেন, আমাদের লোকজন অভিজ্ঞ না হওয়া পর্যন্ত ভারত থেকে ফি নেয়া হবে না। এর আগে গত বছরের প্রথমদিকে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রভাবশালী উপদেষ্টা শেয়ারবাজার বিপর্যয় নিয়ে মন্তব্য করেন। গত বছর ২০ জানুয়ারি খুলনার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে ধসের জন্য সরকারের মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই; কারণ কতকগুলো লোক (শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী) যদি অর্থনীতিতে অবদান না রেখে লাভবান হতে চায়, তাদের কষ্টে আমার হৃদয় কাঁদে না।
টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের বরং ভালোই হবে : গওহর রিজভী
টিপাইমুখে ভারত বাঁধ ও জলবিদ্যুত্ প্রকল্প নির্মাণে চুক্তি করার খবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও ড. গওহর রিজভীকে দিল্লি পাঠান বাস্তব পরিস্থিতি জানতে। দিল্লি সফর শেষে গত ৩ ডিসেম্বর দেশে ফেরেন এই দুই উপদেষ্টা। দেশে ফিরে বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে সফরের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রতিক্রিয়াকালে ড. গওহর রিজভী সাংবাদিকদের বলেন, ‘টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না; বরং ভালোই হবে। আমরা একেবারেই সেটিসফাইড হয়ে এসেছি। এ নিয়ে ভারত যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এ নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।’
গরু-ছাগল চিনলেই লাইসেন্স দেয়া যায় : নৌপরিহনমন্ত্রী
গত বছর একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে দেশবাসী যখন সোচ্চার, পরীক্ষা ছাড়া (অশিক্ষিত ব্যক্তিদের) ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার বিরুদ্ধে যখন সামাজিক সংগঠনগুলোর আন্দোলন তুঙ্গে, তখনই নৌপরিবহনমন্ত্রী ও পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। গত ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে তার মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, দেশে চালকের সঙ্কট আছে। এজন্য অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেয়া দরকার। আর চালকরা সিগন্যাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, ভেড়া-মহিষ-মানুষ চেনে। সুতরাং তাদের লাইসেন্স দেয়া যায়।’ এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর নিজ নির্বাচনী এলাকায় একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে অশিক্ষিত ও অপ্রশিক্ষিত চালকদের পক্ষ নিয়ে নৌমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ড্রাইভারও ফাইভ পাস। সে-ও ভালো গাড়ি চালায়।’
আমি গণক নই যে বলব, কবে তিস্তা চুক্তি হবে : দীপু মনি
সরকারের দৃঢ়বিশ্বাস থাকলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ক্ষমতাসীন সরকার। গণমাধ্যম কর্মীসহ বিভিন্ন স্তরের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের। গত ৪ অক্টোবর এ ধরনের একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ওইদিন তার মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘কবে তিস্তা চুক্তি হবে’ সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বেশ ক্ষুব্ধ হন দীপু মনি। তিনি বলেন, ‘আপনারা কেন হতাশ হচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি না। আমি গণক নই যে বলতে পারব, তিস্তা চুক্তি কবে হবে।’ এ ব্যাপারে উভয় দেশের সম্মতি আছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সমুন্নত রেখেই চুক্তিটি হবে। ভবিষ্যতে কবে তিস্তা চুক্তি হবে, এমন সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ বলতে পারছি না। গত ৪০ বছর এটা নিয়ে কেউ কিছু করেনি। আমরা এখন করছি। আওয়ামী লীগ সরকার এ চুক্তি করবে।
সন্তু লারমার শান্তিতে নোবেল পাওয়া উচিত ছিল : অ্যাটর্নি জেনারেল
নোবেল শান্তি বিজয়ী ড. ইউনূসের রিট আবেদনের ওপর উচ্চ আদালতে শুনানিকালে গত ৮ মার্চ নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আপনারা নোবেল প্রাইজটাকে এত বড় করে দেখছেন কেন? বাংলাদেশে যদি শান্তির জন্য নোবেল প্রাইজ পেতে হয় তাহলে আমি বলব, দু’জনের পাওয়া উচিত ছিল— শেখ হাসিনা আর সন্তু লারমার। কারণ একটি বিরাট এলাকা সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। যেখানে সেনাবাহিনী ছাড়া আমাদের যাওয়ার অবস্থা ছিল না। সেখানে আজ আমরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করছি। শান্তি ফিরে এসেছে। এই শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য দু’জন কাজ করেছেন, শেখ হাসিনা আর সন্তু লারমা। তারা নোবেল প্রাইজ পাননি বলে কি শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের যে কাজ, তা কম হয়ে যাবে?’
এদিকে সরকার ও দলের বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের আলোচিত-সমালোচিত মন্তব্য করেন। জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদও সংসদকে মাছের বাজার বলে মন্তব্য করেছিলেন। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শওকত মোমেন গত ১৭ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিখ্যাত কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে (বীর উত্তম) যুদ্ধাপরাধী উল্লেখ করে তার বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ভয়াবহ চুরির পর ৬ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে মন্দিরে চুরি হয়েছে।

No comments:

Post a Comment