জাহিদুল ইসলাম
গত অর্থবছরে (২০১০-১১) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সমাপ্ত প্রকল্পগুলোতে প্রাথমিক বরাদ্দের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। সময়মত কাজ শেষ না করে দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়িয়ে এ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এ সময়ে শেষ হওয়া ২৩৯টি প্রকল্পের মধ্যে ১৫৭টিরই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ২০১০-১১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, পরিকল্পিতভাবে এসব প্রকল্পের কাজ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পরে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি, ভূমি অধিগ্রহণে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে প্রকল্পের জন্য বাড়তি অর্থ নেয়া হয়েছে। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও প্রকল্প অনুমোদনে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে লুটপাটের অর্থ ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের প্রতিটিতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে গড়ে ৮৩ শতাংশ সময় বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত লেগেছে ১৩ থেকে ১৪ বছর। এসব প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে ১২ হতে ১৩ গুণ পর্যন্ত।
বাছবিচার না করে লাগামহীনভাবে প্রকল্প অনুমোদন দেয়ায় এসব প্রকল্প সময়মত
বাস্তবায়ন হয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাদের মতে এর ফলে সরকারি প্রকল্প থেকে সেবা পেতে বিলম্ব হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য প্রকল্পও বাধাগ্রস্ত হয়। এ অবস্থার নিরসনে রাজনৈতিক বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না নেয়ার পরামর্শ দেন তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, সঠিক সময়ে অর্থ ছাড় না হওয়া, বরাদ্দের অতিরিক্ত খরচ, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়া, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) দুর্বলতা, কারিগরি দক্ষতার অভাব, রাজনৈতিক কারণে প্রকল্প হাতে নেয়ার কারণে দেশে সরকারি বিনিয়োগের সুফল আসছে না।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১০-১১ অর্থবছরে মূল এডিপিতে ৯১৬টি প্রকল্পের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ১ হাজার ১৯৩টি প্রকল্প। এর বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২৬৮টি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণার জন্য নির্ধারিত ছিল। এর মধ্যে ৩০টি প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় আবার মেয়াদকাল বাড়ানো হয়েছে। তবে এর বাইরে অন্য একটি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করায় গতবছর মোট ২৩৯টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে।
সমাপ্ত প্রকল্পের মধ্যে বাস্তবায়নকাল বেড়েছে ১৫৭টির এবং ব্যয় বেড়েছে ৭৫টি প্রকল্পের। শুধু প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে এমন প্রকল্পের সংখ্যা ১২। আর ব্যয় না বাড়িয়ে শুধু বাস্তবায়নকাল বেড়েছে ৯৪টি প্রকল্পের, যা মোট সমাপ্ত প্রকল্পের ৩৯ শতাংশ। ব্যয় ও বাস্তবায়নকাল উভয়ই বেড়েছে এমন প্রকল্প ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশ প্রকল্পের।
তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে শেষ হওয়া ২৩৯ প্রকল্পের মেয়াদকাল ছিল গড়ে ৩ দশমিক ৫২ বছর। কিন্তু প্রকল্পগুলো শেষ হতে সময় লেগেছে গড়ে ৬ দশমিক ৪৪ বছর। এ হিসেবে প্রতিটি প্রকল্পে অতিরিক্ত সময় লেগেছে ২ দশমিক ৯২ বছর যা, মোট বরাদ্দ সময়ের চেয়ে ৮৩ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে প্রতিটি প্রকল্পের গড় প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ১২৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। কিন্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে লেগেছে গড়ে ১৬৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রতিটি প্রকল্পে গড়ে অতিরিক্ত ব্যয় ৪০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ হিসেবে ২৩৯টি প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের পল্লী সড়কে হালকা যানবাহন চলাচলযোগ্য সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পটি সংশোধন করে কয়েক দফায় মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়। ৯ বছর পর প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়েছে গত জুলাইয়ে। তবে এ প্রকল্পটিতে এরই মধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে ৩৮৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এ হিসেবে প্রকল্পটিতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৩ গুণ।
একই বিভাগের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি ১৯৯৮ সালে শুরু হয়। দুই দফায় সংশোধন করে ১৪ বছর পর এটি শেষ হয় গত জুনে। এ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৮৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। পরে সংশোধন করে বরাদ্দ দেয়া হয় ৭৫৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৫০০ কোটি টাকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পল্লী অঞ্চলে সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ৪০০ কোটি টাকার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়েছে ৪৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ৮২৭ কোটি টাকার বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেট জেলা প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৯৯৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
জানা যায়, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোতে সবচেয়ে বেশি দীর্ঘসূত্রতা অবলম্বন করা হয়েছে। ২০০২ সালে নেয়া ঘোড়াশাল তাপবিদ্যেকন্দ্রের ১ ও ২ নম্বর ইউনিট পুনর্বাসন ও আধুনিকীকরণ প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু প্রকল্পটির ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে সংশোধন করা হয়। দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় গত অর্থবছরে। ফলে ১১৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকার প্রকল্পে ব্যয় হয় ২৫২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
একই মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে আশুগঞ্জ বিদ্যুত্ কেন্দ্র কমপ্লেক্সের ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটের পুনর্বাসন ও আধুনিকায়ন প্রকল্পের জন্য ২০০০ সালে বরাদ্দ ছিল ৮৪৮ কোটি টাকা। কাজ শেষ না হওয়ায় সংশোধন করে এ প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয় ১ হাজার ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। একইভাবে ১৯৯৮ সালে শুরু করা সিলেট ৯০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড বিদ্যেকন্দ্র দুই দফায় সংশোধন করে ৫০৫ কোটি ৯২ লাখ টাকার প্রকল্প বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৭১৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি মাথায় না রেখে লাগামহীনভাবে প্রকল্প অনুমোদন দেয়ায় এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলেছিল এসব প্রকল্প। আর এ সময়ে বড় অঙ্কের মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে। এ অবস্থা নিরসনে রাজনৈতিক বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না নিয়ে চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব মোজাম্মেল হক খান বৃহস্পতিবার আমার দেশ- কে বলেন, কোনো কারণে সময়মত কাজ শেষ না হলে প্রকল্পের মেয়াদকাল বাড়াতে হয়। নতুন করে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির সময় নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য, শ্রমিকদের বেতন, জমি অধিগ্রহণের ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা হয়। এ অবস্থায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়। গত বছরে সমাপ্ত ঘোষিত কোনো প্রকল্পে অসঙ্গতি থাকলে তা দূর করার পাশাপাশি দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হবে বলে জানান আইএমইডি সচিব।
উল্লেখ্য, চরম অর্থ সঙ্কটেও একটার পর একটা উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় ৬৪টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া বিতর্কিত প্রকল্পগুলোতে। অর্থবছরের শুরুতেই সারা বছরের বরাদ্দের তিনগুণের বেশি প্রকল্প অনুমোদন দেয়ায় অন্যান্য প্রকল্পের অর্থায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে চলতি বছরের উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন আশঙ্কায় পড়েছে। এ অবস্থায় অসময়ে এডিপি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)