অর্থনৈতিক রিপোর্টার
কোনো উদ্যোগেই যখন পতন ঠেকানো যাচ্ছে না, তখন অর্থমন্ত্রীর ‘শেয়ারবাজার কীভাবে ঠিক হবে জানি না’—এমন মন্তব্যে আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি এখন শেয়ারবাজারে। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের জের ধরে গতকাল লেনদেনের শুরুতেই বাজারে বড় ধরনের ধস নামে। প্রথম এক ঘণ্টায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচকের পতন ঘটে প্রায় ১৯০ পয়েন্টের মতো। এ সময় ডিএসই সাধারণ সূচক ৫ হাজার ১১৮ পয়েন্টে নেমে আসে। মাত্র ৩টি ছাড়া সব কোম্পানির শেয়ারের দর কমে যায়। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা দরপতনের জন্য অর্থমন্ত্রীকে দায়ী করে অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কয়েকশ’ বিনিয়োগকারী ডিএসই চত্বরে বিক্ষোভ সামবেশ করে। এরপর সোয়া দুইটার দিকে মানববন্ধন কর্মসূচিতে এক হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেন। এর পর সূচক ‘রহস্যজনক’ভাবে বাড়তে শুরু করে। কিন্তু তা কিছু সময়ের জন্য। এরপর সূচকের পতন ঠেকানো যায়নি। আগের দিনের তুলনায় ৪৮ পয়েন্ট কমে দিনশেষে ডিএসই সাধারণ সূচক ৫ হাজার ২৫৮ পয়েন্টে এসে দাঁড়ায়। মঙ্গলবার ‘শেয়ারবাবাজার কীভাবে ঠিক হবে জানি না’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার পর পদে থাকার সব যোগ্যতা অর্থমন্ত্রী হারিয়ে ফেলেছেন বলে বিনিয়োগকারীরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, যে দেশের অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনো কিছু করতে পারেন না, তাকে আর ওই পদে রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনকে ‘রাজনীতিকীকরণ’ করা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তারও তীব্র সমালোচনা করেন ভুক্তভোগীরা। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তারা বলেন, আমরা পুঁজি হারিয়ে গত ১০ মাস আন্দোলন করছি। বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দাবি জানিয়ে আসছি।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি সেলিম চৌধুরী বলেন, অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজার নিয়ে বক্তব্যে তার অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার পর তার পদত্যাগ করা উচিত ছিল। বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনকে রাজনীতিকীকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা কাউকে ডেকে আনিনি। তারা নিজেরাই এসেছিলেন। যে কেউ আমাদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করলে আমরা তাদের স্বাগত জানাতেই পারি। অর্থমন্ত্রী নিজেও যদি আসতেন আমরা স্বাগত জানাতাম।
প্রসঙ্গত, গত রোববার থেকে বিনিয়োগকারীরা ডিএসই চত্বরে অবস্থান নিয়ে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন শুরু করে। কর্মসূচির প্রথম দিনেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, জেএসডির চেয়ারম্যান আ স ম আবদুর রবসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা সংহতি প্রকাশ করেন। এ কারণে এরপর থেকে বিনিয়োগকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। পুলিশের হয়রানিতে কোথাও বসতে না পেরে মঙ্গলবার কর্মসূচি স্থগিত করে বিনিয়োগকারীরা।
ইবিএল সিকিউরিটিজ হাউসে লেনদেনকারী ইকবাল খান রিপন নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, আমাদের এখানে কোনো রাজনীতি নেই। আমরা বাধ্য হয়ে আন্দোলন করছি। গত ৯ থেকে ১০ মাস পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা আন্দোলন করে আসছে। তখন কোনো রাজনৈতিক নেতা আসেননি। কিন্তু এ সময় আপনি (অর্থমন্ত্রী) শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য কী করেছেন। এখন বলছেন, শেয়ারবাজার কীভাবে ঠিক হবে জানি না। শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুট হয়ে যাওয়ার পর এ বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, কারসাজির সঙ্গে অর্থমন্ত্রী জড়িত।
আরপি সিকিউরিটিজ হাউসে লেনদেন করে থাকেন আসলাম ওয়াহিদ নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যারা সংহতি প্রকাশ করেছিলেন তারা তো ব্যবসায়ী নয়, রাজনৈতিক নেতা। আর রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিনিয়োগকারীদের পাশে দাঁড়ানো তো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে আন্দোলনকে রাজনীতিকীকরণ মন্তব্যের অর্থই হচ্ছে, তিনি রাজনৈতিক কালচার সম্পর্কে জানেন না।
ফারইস্ট সিকিউরিটিজে লেনদেনকারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, শেয়ারবাজারের জন্য আগামীতে ৩ কোটি ভোটার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যাবে। আমরা আওয়ামী লীগ করতাম। কিন্তু এখন আমরা আর এ দলকে সমর্থন জানাতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে বিনিয়োগকারীরা মহাসমাবেশের ডাক দিতে বাধ্য হবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা রাজনীতি করতে আসিনি, নেতা হতে আসিনি। বিভিন্ন উত্স থেকে আমরা অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছি। মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। এখন আমাদের ইক্যুয়িটি নেগেটিভ হয়ে গেছে। মার্কেট ঠিক হলে আমরা আন্দোলন করব না, আমরা চলে যাব।
ডিএসইতে আগুন আতঙ্ক : দুপুর ১২টার দিকে ডিএসইর এনেক্স ভবনের ৭ তলায় আনোয়ার সিকিউরিটিজ হাউসের সামনে ঝোলানো ইন্টারনেটের তারে আগুন দেখতে পায় বিনিয়োগকারীরা। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন হাউস থেকে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে আসে। অবশ্য আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে চন্দন নামে ডিএসইর একজন কর্মী অগ্নিনির্বাপণ গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে। এর ফলে কোনো ধরনের ক্ষতি হয়নি। ওই জায়গায় একটি দিয়াশলাইয়ের বাক্স পাওয়া গেছে বলে তিনি জানান।
বিক্ষোভ ও মানববন্ধন : শেয়াবাজারে সূচকের বড় ধরনের পতনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে হাজারখানেক বিনিয়োগকারী অংশ নেয়। বিক্ষোভকারীদের সব ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তুতে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিনিয়োগকারীরা অবিলম্বে তার পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের বিরুদ্ধেও স্লোগান দেন। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরেরও পদত্যাগ দাবি করেন তারা। বেলা সোয়া দুইটার দিকে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। ইত্তেফাক মোড় থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর পর্যন্ত এ মানববন্ধন বিস্তৃত হয়। কর্মসূচি চলাকালে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ ছিল।
পুঁজি হারিয়ে অসুস্থ এক বিনিয়োগকারী : শেয়ারবাজারে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলেও এখন তা মাত্র ৫৩ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাত্ পুঁজিবাজারে লাভের আশায় বিনিয়োগ করলেও তার বিনিয়োগের ৭৭ লাখ টাকাই হাওয়া হয়ে গেছে। লোকশানের এ ধকল সইতে না পেরে গতকাল আনোয়ার হোসেন নামে এ বিনিয়োগকারী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি শেষ হয়ে গেছি। আমাকে গুলি করুন। এক সময় তিনি অসুস্থ হয়ে যান। জানা গেছে, শেয়ারবাজারে পুঁজি হারানোর কারণে তিনমাস ধরে বাসায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। স্ত্রী-সন্তানদেরও খবর নিতে পারছেন না। বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি।
বাজার পরিস্থিতি : গতকাল দিনের শুরুতে সূচকের বড় ধরনের দরপতন হলেও দিনশেষে ৪৮ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট বেড়ে ডিএসই সাধারণ সূচক ৫ হাজার ২৫৮ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৫৫টি কোম্পানির মধ্যে ১০০টির দর বাড়লেও কমেছে ১৪২টির। অপরিবর্তিত ছিল ১৩টির দর। দিন শেষে সূচকের পতন হলেও লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। আগের দিনের তুলনায় ৬৭ কোটি ২০ লাখ টাকা বেড়ে দিন শেষে ২৭৭ কোটি ৭১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে।
মার্জিন ঋণের শর্ত শিথিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ : পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের পথ সুগম করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মার্জিন ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল করার ইঙ্গিত দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কোনো ব্যাংক মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ করলে তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো আপত্তি নেই। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিলের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আবেদন করলে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিবাচকভাবে তা বিবেচনা করবে। তাছাড়া ব্যাংক বা তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলো মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ করলেও এতে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকগুলো বা তাদের সহযোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (সাবসিডিয়ারি) যে মার্জিন ঋণ দেয়, এর সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বিধিনিষেধ নেই। ব্যাংকগুলো নিজস্ব বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদ মওকুফ করতে পারে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগকৃত অতিরিক্ত অর্থ নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনার সময়সীমা ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইনে বর্ণিত নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। আজ বৃহস্পতিবার ব্যাংকাররা বৈঠক করে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে বলে জানা গেছে।
নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাংক তার মোট দায়ের ১০ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। তবে গত বছর ব্যাংকগুলো নিয়ম ভেঙে দুই/তিন গুণ বেশি বিনিয়োগ করে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর গড় বিনিয়োগ তাদের দায়ের ৪ শতাংশের মতো।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কয়েকশ’ বিনিয়োগকারী ডিএসই চত্বরে বিক্ষোভ সামবেশ করে। এরপর সোয়া দুইটার দিকে মানববন্ধন কর্মসূচিতে এক হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেন। এর পর সূচক ‘রহস্যজনক’ভাবে বাড়তে শুরু করে। কিন্তু তা কিছু সময়ের জন্য। এরপর সূচকের পতন ঠেকানো যায়নি। আগের দিনের তুলনায় ৪৮ পয়েন্ট কমে দিনশেষে ডিএসই সাধারণ সূচক ৫ হাজার ২৫৮ পয়েন্টে এসে দাঁড়ায়। মঙ্গলবার ‘শেয়ারবাবাজার কীভাবে ঠিক হবে জানি না’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার পর পদে থাকার সব যোগ্যতা অর্থমন্ত্রী হারিয়ে ফেলেছেন বলে বিনিয়োগকারীরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, যে দেশের অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনো কিছু করতে পারেন না, তাকে আর ওই পদে রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনকে ‘রাজনীতিকীকরণ’ করা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তারও তীব্র সমালোচনা করেন ভুক্তভোগীরা। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তারা বলেন, আমরা পুঁজি হারিয়ে গত ১০ মাস আন্দোলন করছি। বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দাবি জানিয়ে আসছি।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি সেলিম চৌধুরী বলেন, অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজার নিয়ে বক্তব্যে তার অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার পর তার পদত্যাগ করা উচিত ছিল। বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনকে রাজনীতিকীকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা কাউকে ডেকে আনিনি। তারা নিজেরাই এসেছিলেন। যে কেউ আমাদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করলে আমরা তাদের স্বাগত জানাতেই পারি। অর্থমন্ত্রী নিজেও যদি আসতেন আমরা স্বাগত জানাতাম।
প্রসঙ্গত, গত রোববার থেকে বিনিয়োগকারীরা ডিএসই চত্বরে অবস্থান নিয়ে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন শুরু করে। কর্মসূচির প্রথম দিনেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, জেএসডির চেয়ারম্যান আ স ম আবদুর রবসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা সংহতি প্রকাশ করেন। এ কারণে এরপর থেকে বিনিয়োগকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। পুলিশের হয়রানিতে কোথাও বসতে না পেরে মঙ্গলবার কর্মসূচি স্থগিত করে বিনিয়োগকারীরা।
ইবিএল সিকিউরিটিজ হাউসে লেনদেনকারী ইকবাল খান রিপন নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, আমাদের এখানে কোনো রাজনীতি নেই। আমরা বাধ্য হয়ে আন্দোলন করছি। গত ৯ থেকে ১০ মাস পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা আন্দোলন করে আসছে। তখন কোনো রাজনৈতিক নেতা আসেননি। কিন্তু এ সময় আপনি (অর্থমন্ত্রী) শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য কী করেছেন। এখন বলছেন, শেয়ারবাজার কীভাবে ঠিক হবে জানি না। শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুট হয়ে যাওয়ার পর এ বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, কারসাজির সঙ্গে অর্থমন্ত্রী জড়িত।
আরপি সিকিউরিটিজ হাউসে লেনদেন করে থাকেন আসলাম ওয়াহিদ নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যারা সংহতি প্রকাশ করেছিলেন তারা তো ব্যবসায়ী নয়, রাজনৈতিক নেতা। আর রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিনিয়োগকারীদের পাশে দাঁড়ানো তো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে আন্দোলনকে রাজনীতিকীকরণ মন্তব্যের অর্থই হচ্ছে, তিনি রাজনৈতিক কালচার সম্পর্কে জানেন না।
ফারইস্ট সিকিউরিটিজে লেনদেনকারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, শেয়ারবাজারের জন্য আগামীতে ৩ কোটি ভোটার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যাবে। আমরা আওয়ামী লীগ করতাম। কিন্তু এখন আমরা আর এ দলকে সমর্থন জানাতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে বিনিয়োগকারীরা মহাসমাবেশের ডাক দিতে বাধ্য হবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা রাজনীতি করতে আসিনি, নেতা হতে আসিনি। বিভিন্ন উত্স থেকে আমরা অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছি। মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। এখন আমাদের ইক্যুয়িটি নেগেটিভ হয়ে গেছে। মার্কেট ঠিক হলে আমরা আন্দোলন করব না, আমরা চলে যাব।
ডিএসইতে আগুন আতঙ্ক : দুপুর ১২টার দিকে ডিএসইর এনেক্স ভবনের ৭ তলায় আনোয়ার সিকিউরিটিজ হাউসের সামনে ঝোলানো ইন্টারনেটের তারে আগুন দেখতে পায় বিনিয়োগকারীরা। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন হাউস থেকে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে আসে। অবশ্য আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে চন্দন নামে ডিএসইর একজন কর্মী অগ্নিনির্বাপণ গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে। এর ফলে কোনো ধরনের ক্ষতি হয়নি। ওই জায়গায় একটি দিয়াশলাইয়ের বাক্স পাওয়া গেছে বলে তিনি জানান।
বিক্ষোভ ও মানববন্ধন : শেয়াবাজারে সূচকের বড় ধরনের পতনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে হাজারখানেক বিনিয়োগকারী অংশ নেয়। বিক্ষোভকারীদের সব ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তুতে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিনিয়োগকারীরা অবিলম্বে তার পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের বিরুদ্ধেও স্লোগান দেন। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরেরও পদত্যাগ দাবি করেন তারা। বেলা সোয়া দুইটার দিকে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। ইত্তেফাক মোড় থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর পর্যন্ত এ মানববন্ধন বিস্তৃত হয়। কর্মসূচি চলাকালে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ ছিল।
পুঁজি হারিয়ে অসুস্থ এক বিনিয়োগকারী : শেয়ারবাজারে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলেও এখন তা মাত্র ৫৩ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাত্ পুঁজিবাজারে লাভের আশায় বিনিয়োগ করলেও তার বিনিয়োগের ৭৭ লাখ টাকাই হাওয়া হয়ে গেছে। লোকশানের এ ধকল সইতে না পেরে গতকাল আনোয়ার হোসেন নামে এ বিনিয়োগকারী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি শেষ হয়ে গেছি। আমাকে গুলি করুন। এক সময় তিনি অসুস্থ হয়ে যান। জানা গেছে, শেয়ারবাজারে পুঁজি হারানোর কারণে তিনমাস ধরে বাসায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। স্ত্রী-সন্তানদেরও খবর নিতে পারছেন না। বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি।
বাজার পরিস্থিতি : গতকাল দিনের শুরুতে সূচকের বড় ধরনের দরপতন হলেও দিনশেষে ৪৮ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট বেড়ে ডিএসই সাধারণ সূচক ৫ হাজার ২৫৮ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৫৫টি কোম্পানির মধ্যে ১০০টির দর বাড়লেও কমেছে ১৪২টির। অপরিবর্তিত ছিল ১৩টির দর। দিন শেষে সূচকের পতন হলেও লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। আগের দিনের তুলনায় ৬৭ কোটি ২০ লাখ টাকা বেড়ে দিন শেষে ২৭৭ কোটি ৭১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে।
মার্জিন ঋণের শর্ত শিথিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ : পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের পথ সুগম করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মার্জিন ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল করার ইঙ্গিত দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কোনো ব্যাংক মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ করলে তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো আপত্তি নেই। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিলের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আবেদন করলে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিবাচকভাবে তা বিবেচনা করবে। তাছাড়া ব্যাংক বা তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলো মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ করলেও এতে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকগুলো বা তাদের সহযোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (সাবসিডিয়ারি) যে মার্জিন ঋণ দেয়, এর সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বিধিনিষেধ নেই। ব্যাংকগুলো নিজস্ব বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদ মওকুফ করতে পারে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগকৃত অতিরিক্ত অর্থ নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনার সময়সীমা ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইনে বর্ণিত নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। আজ বৃহস্পতিবার ব্যাংকাররা বৈঠক করে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে বলে জানা গেছে।
নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাংক তার মোট দায়ের ১০ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। তবে গত বছর ব্যাংকগুলো নিয়ম ভেঙে দুই/তিন গুণ বেশি বিনিয়োগ করে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর গড় বিনিয়োগ তাদের দায়ের ৪ শতাংশের মতো।