মাত্র কয়েক বছর আগেও দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক ছিল বেসরকারি খাতে বৃহত্ ঋণের বড় জোগানদাতা। দেশের মুদ্রাবাজারেও অর্থের জোগানদাতা হিসেবে এসব ব্যাংকই বড় ভূমিকা রাখত। তবে দিনবদলের পাল্লায় পড়ে এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা এখন খুবই নাজুক।
সরকারি ব্যাংকে গিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তারা টাকা পাচ্ছেন না। আর সরকারি ব্যাংকের বেহাল দশার মধ্যেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এখন দৈন্য দশায়। সরকারি-বেসরকারি গোটা ব্যাংকিং খাতেই ঋণের আকাল শুরু হয়েছে। শিল্পে তো নয়ই, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের স্বল্পমেয়াদে দৈনন্দিন কাজেও অর্থের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। বছরজুড়েই এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন ব্যাংকগুলোর জন্য সামনে আরও বিপদ আসছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সরকার ব্যাংকগুলোর সব টাকাই নিয়ে নিচ্ছে। সরকারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাকাল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়েছে ব্যাংকে নগদ জমার হার শিথিল করতে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে গড়ে প্রতিদিন ৪৮৬ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৪৫৬ কোটি, জনতা ব্যাংক এক হাজার ২৪৬ কোটি ও অগ্রণী ব্যাংক ১ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা ধার করছে। মূলত সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়েই মুদ্রাবাজার থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে এসব ব্যাংককে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে ৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা এবং তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া হয়েছে ৩ হাজার ২২২ কোটি টাকা।
এর আগে চলতি অর্থবছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে মোট ঋণ নেয় ৫ হাজার ২২৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ সময়ে আগে নেয়া ঋণের এক টাকাও পরিশোধ করতে পারেনি সরকার। অথচ গত বছরও একই সময়ে পরিশোধ হয়েছিল ৫৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা ঋণ।
ব্যাংকিং খাত থেকে বেপরোয়া ঋণ গ্রহণ সরকারের অর্থব্যবস্থা ব্যাংক ঋণনির্ভর হওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। পরিচালনা ব্যয় মেটাতে সরকার ব্যাংকিং খাতের ওপর এত বেশি নির্ভরশীলতার নজির অতীতে আর নেই বলেও মনে করেন তারা। আর সরকারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে বেসরকারি খাতে শিল্প বিনিয়োগে বড় আকারের ঋণ দেয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বাড়তি চাহিদা পূরণে ছাপছে নতুন টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তফসিলি ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ কমে আসে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ করলে, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে তা তুলে নিতে না পারে, তবে শেষ পর্যন্ত নতুন টাকা বাজারে বেড়ে যায়। আর এতে বাড়ে দ্রব্যমূল্য।
এদিকে, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলও (আইএমএফ) সরকারের অতিমাত্রায় ব্যাংক ঋণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইএমএফের একটি মিশন সরকারকে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার বাণিজ্যিক ব্যাংক নগদ অর্থের ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোকে ঋণ দিতে গিয়েই এই চাপ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সরকার ১ হাজার ৭৫০ কোটি, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ কোটি ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
এছাড়া দুই মাসে বিভিন্ন মেয়াদি বন্ড প্রাইমারি ডিলারদের মাধ্যমে নিলাম করে সরকার ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত অর্থবছরে বন্ডের মাধ্যমে সরকার ঋণ নিয়েছিল ১৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদায়ন হয়েছে মাত্র ৪৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার বন্ড। জানা গেছে, ঋণ গ্রহণের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ প্রদানও ব্যাংকগুলোর তারল্যে চাপ সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক তদবিরের কারণে ব্যাংকগুলোকে তড়িঘড়ি করে বেশকিছু ঋণ দিতে হয়েছে। ফলে সাধারণ উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। সাধারণ উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ঋণ আবেদন গ্রহণ না করতেও মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শাখাকে।
জানা গেছে, সরকারের সামগ্রিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৯ হাজার ২৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত এক বছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২০ হাজার ৩৯১ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে ২৭ হাজার ২০৮ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উত্স থেকে ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা এবং ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ৮ হাজার ২৫১ কোটি টাকা নেয়া হবে। বর্তমান হারে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিতে থাকলে বছরের অর্ধেক সময়েই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, গত প্রায় দেড় বছর ধরেই সরকারি ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে না। তবে অতিসম্প্রতি ঋণের আবেদন নেয়াও বন্ধ করে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী গতকাল আমার দেশকে জানান, ‘আমরা ব্যাংক ঋণ পাচ্ছি না। ছোট ঋণ প্রাপ্তিতে আগে সমস্যা ছিল না। গত দুই মাস ধরে ঋণের আবেদনও নেয়া হচ্ছে না সরকারি ব্যাংকে। একই অবস্থা বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতেও।’ কারণ জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও ইএবি’র সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘শেয়ারবাজারে ধসের পর অনেক ব্যাংক নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুত্ সঙ্কটের ফলে এতদিন শিল্পে বিনিয়োগ হয়নি, এখন কিছুটা উন্নতির দাবি করা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু এখন আবার সরকার ব্যাংকের সব টাকা নিয়ে নিচ্ছে। ফলে বিনিয়োগে মন্দা স্থায়ী রূপ নিতে পারে।’
এদিকে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক সঙ্কটের কারণে নগদ অর্থের জমার ক্ষেত্রে শর্ত কিছুটা শিথিল করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সিকিউরিটিজে (ট্রেজারি বিল ও বন্ড) বিনিয়োগ করতে পারবে সংশ্লিষ্ট মাসে রক্ষিতব্য সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদের (এসএলআর) ৭৫ শতাংশ। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশন থেকে জারিকৃত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। এ নির্দেশনা আগামী ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সাময়িকভাবে ব্যাংকের সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের পরিমাণ সংশ্লিষ্ট মাসের এসএলআরের ৫০ শতাংশের স্থলে ৭৫ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হলো। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর নগদ টাকা জমা রাখার প্রবণতা কমে যাবে। ফলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা সহজ হবে।
সরকার বেপরোয়া ঋণ নিলেও এই ঋণের টাকা কোথায় যাচ্ছে তার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে সরকারের ভেতরেই প্রশ্ন উঠছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বেহাল দশা চলছে। ফলে ঋণের টাকায় যে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে তা মানতে নারাজ অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজ বলেন, সরকারের ঋণের টাকার হিসাব দেয়া দরকার। এভাবে খরচ করতে থাকলে একসময় ব্যাংকিং খাত যেমন সমস্যায় পড়বে, তেমনি গোটা অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।
সরকারি ব্যাংকে গিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তারা টাকা পাচ্ছেন না। আর সরকারি ব্যাংকের বেহাল দশার মধ্যেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এখন দৈন্য দশায়। সরকারি-বেসরকারি গোটা ব্যাংকিং খাতেই ঋণের আকাল শুরু হয়েছে। শিল্পে তো নয়ই, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের স্বল্পমেয়াদে দৈনন্দিন কাজেও অর্থের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। বছরজুড়েই এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন ব্যাংকগুলোর জন্য সামনে আরও বিপদ আসছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সরকার ব্যাংকগুলোর সব টাকাই নিয়ে নিচ্ছে। সরকারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাকাল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়েছে ব্যাংকে নগদ জমার হার শিথিল করতে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে গড়ে প্রতিদিন ৪৮৬ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৪৫৬ কোটি, জনতা ব্যাংক এক হাজার ২৪৬ কোটি ও অগ্রণী ব্যাংক ১ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা ধার করছে। মূলত সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়েই মুদ্রাবাজার থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে এসব ব্যাংককে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে ৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা এবং তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া হয়েছে ৩ হাজার ২২২ কোটি টাকা।
এর আগে চলতি অর্থবছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে মোট ঋণ নেয় ৫ হাজার ২২৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ সময়ে আগে নেয়া ঋণের এক টাকাও পরিশোধ করতে পারেনি সরকার। অথচ গত বছরও একই সময়ে পরিশোধ হয়েছিল ৫৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা ঋণ।
ব্যাংকিং খাত থেকে বেপরোয়া ঋণ গ্রহণ সরকারের অর্থব্যবস্থা ব্যাংক ঋণনির্ভর হওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। পরিচালনা ব্যয় মেটাতে সরকার ব্যাংকিং খাতের ওপর এত বেশি নির্ভরশীলতার নজির অতীতে আর নেই বলেও মনে করেন তারা। আর সরকারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে বেসরকারি খাতে শিল্প বিনিয়োগে বড় আকারের ঋণ দেয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বাড়তি চাহিদা পূরণে ছাপছে নতুন টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তফসিলি ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ কমে আসে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ করলে, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে তা তুলে নিতে না পারে, তবে শেষ পর্যন্ত নতুন টাকা বাজারে বেড়ে যায়। আর এতে বাড়ে দ্রব্যমূল্য।
এদিকে, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলও (আইএমএফ) সরকারের অতিমাত্রায় ব্যাংক ঋণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইএমএফের একটি মিশন সরকারকে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার বাণিজ্যিক ব্যাংক নগদ অর্থের ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোকে ঋণ দিতে গিয়েই এই চাপ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সরকার ১ হাজার ৭৫০ কোটি, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ কোটি ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
এছাড়া দুই মাসে বিভিন্ন মেয়াদি বন্ড প্রাইমারি ডিলারদের মাধ্যমে নিলাম করে সরকার ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত অর্থবছরে বন্ডের মাধ্যমে সরকার ঋণ নিয়েছিল ১৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদায়ন হয়েছে মাত্র ৪৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার বন্ড। জানা গেছে, ঋণ গ্রহণের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ প্রদানও ব্যাংকগুলোর তারল্যে চাপ সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক তদবিরের কারণে ব্যাংকগুলোকে তড়িঘড়ি করে বেশকিছু ঋণ দিতে হয়েছে। ফলে সাধারণ উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। সাধারণ উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ঋণ আবেদন গ্রহণ না করতেও মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শাখাকে।
জানা গেছে, সরকারের সামগ্রিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৯ হাজার ২৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত এক বছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২০ হাজার ৩৯১ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে ২৭ হাজার ২০৮ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উত্স থেকে ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা এবং ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ৮ হাজার ২৫১ কোটি টাকা নেয়া হবে। বর্তমান হারে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিতে থাকলে বছরের অর্ধেক সময়েই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, গত প্রায় দেড় বছর ধরেই সরকারি ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে না। তবে অতিসম্প্রতি ঋণের আবেদন নেয়াও বন্ধ করে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী গতকাল আমার দেশকে জানান, ‘আমরা ব্যাংক ঋণ পাচ্ছি না। ছোট ঋণ প্রাপ্তিতে আগে সমস্যা ছিল না। গত দুই মাস ধরে ঋণের আবেদনও নেয়া হচ্ছে না সরকারি ব্যাংকে। একই অবস্থা বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতেও।’ কারণ জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও ইএবি’র সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘শেয়ারবাজারে ধসের পর অনেক ব্যাংক নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুত্ সঙ্কটের ফলে এতদিন শিল্পে বিনিয়োগ হয়নি, এখন কিছুটা উন্নতির দাবি করা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু এখন আবার সরকার ব্যাংকের সব টাকা নিয়ে নিচ্ছে। ফলে বিনিয়োগে মন্দা স্থায়ী রূপ নিতে পারে।’
এদিকে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক সঙ্কটের কারণে নগদ অর্থের জমার ক্ষেত্রে শর্ত কিছুটা শিথিল করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সিকিউরিটিজে (ট্রেজারি বিল ও বন্ড) বিনিয়োগ করতে পারবে সংশ্লিষ্ট মাসে রক্ষিতব্য সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদের (এসএলআর) ৭৫ শতাংশ। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশন থেকে জারিকৃত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। এ নির্দেশনা আগামী ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সাময়িকভাবে ব্যাংকের সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের পরিমাণ সংশ্লিষ্ট মাসের এসএলআরের ৫০ শতাংশের স্থলে ৭৫ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হলো। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর নগদ টাকা জমা রাখার প্রবণতা কমে যাবে। ফলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা সহজ হবে।
সরকার বেপরোয়া ঋণ নিলেও এই ঋণের টাকা কোথায় যাচ্ছে তার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে সরকারের ভেতরেই প্রশ্ন উঠছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বেহাল দশা চলছে। ফলে ঋণের টাকায় যে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে তা মানতে নারাজ অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজ বলেন, সরকারের ঋণের টাকার হিসাব দেয়া দরকার। এভাবে খরচ করতে থাকলে একসময় ব্যাংকিং খাত যেমন সমস্যায় পড়বে, তেমনি গোটা অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।
No comments:
Post a Comment