Saturday, 29 January 2011

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ১৯৯৬ বনাম ২০১১ : এবার ৮ দিনে মূলধন হারিয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা


অর্থনৈতিক রিপোর্টার

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হিসেবে এতদিন ১৯৯৬ সাল উদাহরণ হয়ে থাকলেও এবার নতুন করে ইতিহাসে ঢুকে গেল ২০১১। তবে এবারের কেলেঙ্কারি আরও ভয়াবহ ও আধুনিক বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তবে ১৯৯৬-র কেলেঙ্কারির সঙ্গে অনেক অমিল থাকলেও মিল হলো—দুটি ঘটনাই হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। আর সন্দেহভাজন খেলোয়াড়রাও রাঘব বোয়াল। ১৯৯৬ সালে কারসাজির মাধ্যমে বাজার থেকে তখন প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছিল সিন্ডিকেট চক্র। তবে এবার হাতিয়ে নেয়া টাকার পরিমাণ প্রায় ৮৬ হাজার কোটিরও বেশি। আর ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় মামলা হলেও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবারও একই ঘটনায় পুনরাবৃত্তি হবে।
এবারে শেয়ারবাজারের অস্বাভাবিক উত্থান শুরু হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর জোরালো হতে থাকে। বলা হয়, তখন বাজারে প্রচুর কালোটাকা ঢুকতে থাকে। বাজার চাঙ্গা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিনিয়োগকারীরা দলে দলে আসতে থাকে। তখন সরকার ও বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিনিয়োগকারীদের সচেতন বা তাদের স্বার্থ রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেয়ার পরিবর্তে বাজার বৃদ্ধির বাহবা নিতে থাকে। উপরন্তু ব্যাপক কারসাজির কারণে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে বলে অর্থনীতিবিদ বা বাজার অভিজ্ঞরা সতর্ক করলেও সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলে আসছে, বাজার ১৯৯৬ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২৩ জুন সরকার গঠনের দিন ঢাকা শেয়ার মার্কেটে বাজার মূলধন ছিল ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। শেয়ারের সার্বিক মূল্যসূচক ছিল ৯৭৬ পয়েন্ট। সাড়ে চার মাসের মাথায় ৪ নভেম্বর বাজার মূলধন বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৬ হাজার কোটি টাকা। আর শেয়ারের সার্বিক মূল্যসূচক বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬ পয়েন্টে। তখন আওয়ামী লীগ সরকার বলতে থাকে, তাদের প্রতি আস্থা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণেই শেয়ারের মূল্য বাড়ছে। একদিকে সরকারের আশ্বাস, অপরদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাজার চাঙ্গা হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রলুব্ধ হন। তারা জমানো অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, এমনকি জায়গা-জমি বিক্রি-বন্ধক রেখে ও ঋণ করে এনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম দুই শেয়ারবাজার সংলগ্ন আশপাশের রাস্তায়ও ছিল শেয়ার ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। মূলত সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করে বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়াই ছিল এর পেছনের উদ্দেশ্য। সাধারণ মানুষ সেই পাতা ফাঁদেই পা দেয়।
২০০৯-এর জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর ৬ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ২ হাজার ৭৫৬ পয়েন্ট। তখন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ লাখের মতো। সেদিন লেনদেন হয় ৩৭৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। কিন্তু বাজার বাড়তে বাড়তে গত বছর ২৫ আগস্ট হয় ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালের প্রথমদিন বাজার মূলধন ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১১ সালের প্রথম কার্যদিবস রোবরারে সাধারণ মূল্যসূচক হয় ৮ হাজার ৩০৪ দশমিক ৫৮ পয়েন্ট। ওইদিন ডিএসইতে এক হাজার ৬১২ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়।
কিন্তু ৬ জানুয়ারি সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে মূল্যসূচক ২১৩ দশমিক ২১ পয়েন্ট কমে দাঁড়ায় সাত হাজার ৭৩৫ দশমিক ২২ পয়েন্টে। এদিন লেনদেনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯৬৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আর ৯ জানুয়ারি সপ্তাহের শুরুর দিন সূচকের পতন হয় ৬০০ পয়েন্ট। সেদিন লেনদেন হয় ১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। ১০ জানুয়ারি বাজার মূলধন মাত্র ৫০ মিনিটে ৬৩৫ পয়েন্ট কমে যায়। নতুন বছরের সাতদিনের অব্যাহত দরপতনে সব মিলিয়ে বাজার মূলধন হারায় ৬৩ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। আর গত সোমবার বাজার মূলধন কমেছে ২৩ হাজার কোটি টাকা।
শেয়ারবাজার চাঙ্গা থাকায় তখনকার অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি স্থিতিশীলতার কথা বলে বাহবা নিলেও বাজার পড়তে শুরু করলে এর কোনো দায়িত্ব তিনি নেননি। এনিয়ে সংসদে আলোচনা হলে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেন, শেয়ার মার্কেট কি, আমি বুঝি না। সূচক ৩ হাজার ৬৪৮ থেকে ১৫০০তে নেমে এলে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সূচক ১৫০০ হলে বাজার পড়া বলে না।’ আর এবারও শেয়ারবাজার চাঙ্গা হওয়ায় অর্থমন্ত্রী থেকে সরকারের শীর্ষব্যক্তিরা একে সরকারের সাফল্য বলে দাবি করেন। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে। গত ৯ জানুয়ারি শেয়ারবাজারের ইতিহাসে একদিনে রেকর্ড ৬০০ পয়েন্ট সূচকের পতন হলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘শেয়ারবাজারে দরপতন হলে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ মিছিল করে কিন্তু দাম বাড়লে তারা তো মিষ্টি খাওয়ায় না।’
অভিযোগ রয়েছে, শেয়ার কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনে যে তদন্ত এবং মামলা করা হয়েছে তা অনেকটা দায়সারা গোছেই করা হয়েছে। এজন্য এতদিনেও অভিযুক্তরা রয়ে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তখনকার মামলায় বিবাদী পক্ষের আইনজীবী সাবেক এটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিকুল-হক বলেছিলেন, শেয়ারবাজারে ধস নামার দায়িত্ব অন্য কারো ওপর বর্তায় না। এ দায়িত্ব পুরোপুরি সরকার এবং অর্থমন্ত্রীর ওপর বর্তায়।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে ওই সময় ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে দেশের শেয়ারবাজারগুলোকে প্রভাবিত করার ব্যাপক ঘটনা ঘটেছিল। স্বল্পসময়ের ব্যবধানে বাজার প্রচণ্ড বেগে ঊর্ধ্বগতি পেয়ে আবার নিম্নমুখী হয়। হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারী এই ম্যানিপুলেশনে সর্বস্বান্ত হয়। পরে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এ ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালের ২ এপ্রিল এসইসি মোট ১৫টি কোম্পানির ৩২ পরিচালকের বিরুদ্ধে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা দায়ের করে। এসব মামলা খারিজের জন্য অভিযুক্তদের নানা আইনি তত্পরতা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়ায়। পরে আপিল বিভাগে মূল মামলার বিচারকার্য শুরু হলেও তা এখনও নিষ্পন্ন হয়নি।
১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদন : শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি ছিল একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর কারসাজি। এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য, ব্রোকার, ডিলার এবং তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালকরা। নিজেদের মধ্যে ভুয়া লেনদেনের মাধ্যমে এই গোষ্ঠী বাজারে শেয়ারের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে এবং শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেয়ারের মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাজারে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে দেয়াসহ এই গোষ্ঠী সম্ভাব্য সব ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) কাছে এই প্রতিবেদন পেশ করেন। তদন্ত কমিটি বলেছে, স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম পদ্ধতির ত্রুটি-বিচ্যুতির সুযোগ নিয়ে এই গোষ্ঠী একরকম অবাধে বাজারের তেজীভাবে আকৃষ্ট হয়ে হাজার হাজার নিরীহ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে প্রতারিত করেছে। কমিটি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নাম উল্লেখ করে বলে, বাজারে অস্বাভাবিক তেজীভাবে ডিএসইর উচিত ছিল বাজার সংশোধনের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া। কিন্তু ডিএসইর পক্ষ থেকে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা দূরে থাক, উল্টো প্রতিষ্ঠানটির নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তারা নিজেরাই ম্যানিপুলেশনের আশ্রয় নিয়ে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা মুনাফা তুলে নিয়েছে।
সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে বাজার ম্যানিপুলেশনের বিভিন্ন পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে তদন্ত কমিটি বলেছে, এক্ষেত্রে ডেলিভারি ভার্সাস পেমেন্ট (ভিভিপি) পদ্ধতিকে তারা বড় এবং মোক্ষম একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য বা ব্রোকাররা বড় অঙ্কের শেয়ারের লেনেদেনের ক্ষেত্রে এই ভিভিপি পদ্ধতি চালু করে। এর আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিরাট অঙ্কের শেয়ারের ভুয়া লেনদেন দেখানো হয় এবং এর মাধ্যমে বাজারে শেয়ারের সঙ্কট সৃষ্টি করে মূল্য বহুগুণ বাড়ানো হয়।
কমিটি বলেছে, স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য, ব্রোকার বা তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকরা শেয়ারের দাম বাড়ার জন্য সংঘবদ্ধভাবে বাজারে গুজব তৈরি করে শেয়ারের দাম ম্যানিপুলেট করেছে। এই গোষ্ঠী নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির নামে এমন সব তথ্য বাজারে ছেড়েছে, যাতে উল্লিখিত কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে তারা বোনাস বা রাইট শেয়ার ইস্যু কিংবা কোম্পানির কথিত সম্প্রসারণ ইত্যাদির কথা সুপরিকল্পিতভাবে বাজারে ছাড়ে। একই সময়ে এই গোষ্ঠী স্টক এক্সচেঞ্জের ফ্লোরে কোম্পানিগুলোর শেয়ার উচ্চ দামে এবং বেশি সংখ্যায় নিজেদের মধ্যেই কেনাবেচা করে। বাজারে ছাড়া তথ্য গুজবকে বিশ্বাসযোগ্য করাই এমন লেনদেনের উদ্দেশ্য।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যরা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শেয়ার কেনার জন্য টাকা নিয়ে তা দিয়ে নিজেদের নামে শেয়ার কিনেছে। বিনিয়োগকারীদের বলা হতো, শেয়ার পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলে তাদের সরবরাহ করা হবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের টাকায় কেনা শেয়ার বাজারের উচ্চমূল্যের সময় বিক্রি করে দিয়ে সদস্যরা বিশাল অঙ্কের লাভ ঘরে তুলেছে। এরাই আবার পতনশীল বাজার থেকে কম দামে শেয়ার কিনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সরবরাহ করেছে। সবকিছুই সম্পন্ন হতো বিনা বাধায়। কারণ স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা বা স্বচ্ছতার কোনো বালাই ছিল না।
এ চক্রে এসে যোগ দিয়েছে বিভিন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরাও। পরিচালকরা উল্লিখিত উপায়ে বাজারে তেজীভাব তৈরি করে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দিত। কিন্তু মধ্যস্থতাকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসব পরিচালকের পক্ষে কাজ করেছে বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি শেয়ারবাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের সাধারণ মন্তব্যে বলে, ওই পাঁচ মাসে স্বল্পসময়ের মধ্যে বিশেষ কয়েকটি শেয়ারের মূল্য হু হু করে বেড়ে যায় মূলত দ্রুত লাভের আশায় শেয়ারবাজারে ছুটে যাওয়া সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য। এসময় কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য কোনো মৌলভিত্তি ছাড়াই আকাশ ছুঁয়ে যায়। শেয়ারবাজারে ছুটে যাওয়া বিনিয়োগকারীরা বাজারের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে ছিল একবারেই অজ্ঞ। কয়েকটি মহল থেকে এসব অজ্ঞ ও নবিস বিনিয়োগকারীদের নিরপরাধ নাম দেয়া হয়েছে।
তদন্ত কমিটির মন্তব্যে বলা হয়, এটা সবার কাছেই পরিষ্কার যে, ওই সময় যারা পর্দার আড়াল থেকে বাঁশি বাজিয়ে এসব নিরপরাধ বিনিয়োগকারীদের মোহগ্রস্ত করেছিল এবং নতুন প্রজন্মের বিনিয়োগকারীদের সর্বনাশ করে নিজেদের আখের গুছিয়েছিল, তারা নিজেরা ছিল খুবই পাকা খেলোয়াড়। কাজেই ওই পরিস্থিতির জন্য এ জাতীয় কারসাজির নায়করাই দায়ী, যারা বুঝে-শুনে এই সর্বনাশা খেলায় নিরপরাধ বিনিয়োগকারীদের টেনে আনে।
এদিকে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর মাত্র সোয়া এক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ মূল্যসূচক ৫৪৭ পয়েন্ট পড়ে যায়। তবে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভের মুখে পরে বাজার পরিস্থিতি ঘুরে যায়। পুঁজিবাজারের এই ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছিলেন এসইসির চেয়ারম্যান। ঘটনার তদন্তে পর দিন ৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে এসইসি। একমাস সময় বেঁধে দিয়ে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তদন্তের বিষয়ে এসইসি কোনো কিছুই জানায়নি। আদৌ এ তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানা সন্দেহ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ’৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরা যেভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ১৯৯৬ বনাম ২০১১ : এবার ৮ দিনে মূলধন হারিয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা


অর্থনৈতিক রিপোর্টার

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হিসেবে এতদিন ১৯৯৬ সাল উদাহরণ হয়ে থাকলেও এবার নতুন করে ইতিহাসে ঢুকে গেল ২০১১। তবে এবারের কেলেঙ্কারি আরও ভয়াবহ ও আধুনিক বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তবে ১৯৯৬-র কেলেঙ্কারির সঙ্গে অনেক অমিল থাকলেও মিল হলো—দুটি ঘটনাই হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। আর সন্দেহভাজন খেলোয়াড়রাও রাঘব বোয়াল। ১৯৯৬ সালে কারসাজির মাধ্যমে বাজার থেকে তখন প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছিল সিন্ডিকেট চক্র। তবে এবার হাতিয়ে নেয়া টাকার পরিমাণ প্রায় ৮৬ হাজার কোটিরও বেশি। আর ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় মামলা হলেও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবারও একই ঘটনায় পুনরাবৃত্তি হবে।
এবারে শেয়ারবাজারের অস্বাভাবিক উত্থান শুরু হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর জোরালো হতে থাকে। বলা হয়, তখন বাজারে প্রচুর কালোটাকা ঢুকতে থাকে। বাজার চাঙ্গা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিনিয়োগকারীরা দলে দলে আসতে থাকে। তখন সরকার ও বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিনিয়োগকারীদের সচেতন বা তাদের স্বার্থ রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেয়ার পরিবর্তে বাজার বৃদ্ধির বাহবা নিতে থাকে। উপরন্তু ব্যাপক কারসাজির কারণে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে বলে অর্থনীতিবিদ বা বাজার অভিজ্ঞরা সতর্ক করলেও সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলে আসছে, বাজার ১৯৯৬ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২৩ জুন সরকার গঠনের দিন ঢাকা শেয়ার মার্কেটে বাজার মূলধন ছিল ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। শেয়ারের সার্বিক মূল্যসূচক ছিল ৯৭৬ পয়েন্ট। সাড়ে চার মাসের মাথায় ৪ নভেম্বর বাজার মূলধন বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৬ হাজার কোটি টাকা। আর শেয়ারের সার্বিক মূল্যসূচক বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬ পয়েন্টে। তখন আওয়ামী লীগ সরকার বলতে থাকে, তাদের প্রতি আস্থা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণেই শেয়ারের মূল্য বাড়ছে। একদিকে সরকারের আশ্বাস, অপরদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাজার চাঙ্গা হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রলুব্ধ হন। তারা জমানো অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, এমনকি জায়গা-জমি বিক্রি-বন্ধক রেখে ও ঋণ করে এনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম দুই শেয়ারবাজার সংলগ্ন আশপাশের রাস্তায়ও ছিল শেয়ার ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। মূলত সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করে বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়াই ছিল এর পেছনের উদ্দেশ্য। সাধারণ মানুষ সেই পাতা ফাঁদেই পা দেয়।
২০০৯-এর জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর ৬ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ২ হাজার ৭৫৬ পয়েন্ট। তখন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ লাখের মতো। সেদিন লেনদেন হয় ৩৭৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। কিন্তু বাজার বাড়তে বাড়তে গত বছর ২৫ আগস্ট হয় ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালের প্রথমদিন বাজার মূলধন ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১১ সালের প্রথম কার্যদিবস রোবরারে সাধারণ মূল্যসূচক হয় ৮ হাজার ৩০৪ দশমিক ৫৮ পয়েন্ট। ওইদিন ডিএসইতে এক হাজার ৬১২ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়।
কিন্তু ৬ জানুয়ারি সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে মূল্যসূচক ২১৩ দশমিক ২১ পয়েন্ট কমে দাঁড়ায় সাত হাজার ৭৩৫ দশমিক ২২ পয়েন্টে। এদিন লেনদেনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯৬৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আর ৯ জানুয়ারি সপ্তাহের শুরুর দিন সূচকের পতন হয় ৬০০ পয়েন্ট। সেদিন লেনদেন হয় ১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। ১০ জানুয়ারি বাজার মূলধন মাত্র ৫০ মিনিটে ৬৩৫ পয়েন্ট কমে যায়। নতুন বছরের সাতদিনের অব্যাহত দরপতনে সব মিলিয়ে বাজার মূলধন হারায় ৬৩ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। আর গত সোমবার বাজার মূলধন কমেছে ২৩ হাজার কোটি টাকা।
শেয়ারবাজার চাঙ্গা থাকায় তখনকার অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি স্থিতিশীলতার কথা বলে বাহবা নিলেও বাজার পড়তে শুরু করলে এর কোনো দায়িত্ব তিনি নেননি। এনিয়ে সংসদে আলোচনা হলে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেন, শেয়ার মার্কেট কি, আমি বুঝি না। সূচক ৩ হাজার ৬৪৮ থেকে ১৫০০তে নেমে এলে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সূচক ১৫০০ হলে বাজার পড়া বলে না।’ আর এবারও শেয়ারবাজার চাঙ্গা হওয়ায় অর্থমন্ত্রী থেকে সরকারের শীর্ষব্যক্তিরা একে সরকারের সাফল্য বলে দাবি করেন। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে। গত ৯ জানুয়ারি শেয়ারবাজারের ইতিহাসে একদিনে রেকর্ড ৬০০ পয়েন্ট সূচকের পতন হলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘শেয়ারবাজারে দরপতন হলে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ মিছিল করে কিন্তু দাম বাড়লে তারা তো মিষ্টি খাওয়ায় না।’
অভিযোগ রয়েছে, শেয়ার কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনে যে তদন্ত এবং মামলা করা হয়েছে তা অনেকটা দায়সারা গোছেই করা হয়েছে। এজন্য এতদিনেও অভিযুক্তরা রয়ে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তখনকার মামলায় বিবাদী পক্ষের আইনজীবী সাবেক এটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিকুল-হক বলেছিলেন, শেয়ারবাজারে ধস নামার দায়িত্ব অন্য কারো ওপর বর্তায় না। এ দায়িত্ব পুরোপুরি সরকার এবং অর্থমন্ত্রীর ওপর বর্তায়।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে ওই সময় ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে দেশের শেয়ারবাজারগুলোকে প্রভাবিত করার ব্যাপক ঘটনা ঘটেছিল। স্বল্পসময়ের ব্যবধানে বাজার প্রচণ্ড বেগে ঊর্ধ্বগতি পেয়ে আবার নিম্নমুখী হয়। হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারী এই ম্যানিপুলেশনে সর্বস্বান্ত হয়। পরে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এ ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালের ২ এপ্রিল এসইসি মোট ১৫টি কোম্পানির ৩২ পরিচালকের বিরুদ্ধে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা দায়ের করে। এসব মামলা খারিজের জন্য অভিযুক্তদের নানা আইনি তত্পরতা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়ায়। পরে আপিল বিভাগে মূল মামলার বিচারকার্য শুরু হলেও তা এখনও নিষ্পন্ন হয়নি।
১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদন : শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি ছিল একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর কারসাজি। এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য, ব্রোকার, ডিলার এবং তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালকরা। নিজেদের মধ্যে ভুয়া লেনদেনের মাধ্যমে এই গোষ্ঠী বাজারে শেয়ারের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে এবং শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেয়ারের মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাজারে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে দেয়াসহ এই গোষ্ঠী সম্ভাব্য সব ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) কাছে এই প্রতিবেদন পেশ করেন। তদন্ত কমিটি বলেছে, স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম পদ্ধতির ত্রুটি-বিচ্যুতির সুযোগ নিয়ে এই গোষ্ঠী একরকম অবাধে বাজারের তেজীভাবে আকৃষ্ট হয়ে হাজার হাজার নিরীহ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে প্রতারিত করেছে। কমিটি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নাম উল্লেখ করে বলে, বাজারে অস্বাভাবিক তেজীভাবে ডিএসইর উচিত ছিল বাজার সংশোধনের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া। কিন্তু ডিএসইর পক্ষ থেকে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা দূরে থাক, উল্টো প্রতিষ্ঠানটির নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তারা নিজেরাই ম্যানিপুলেশনের আশ্রয় নিয়ে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা মুনাফা তুলে নিয়েছে।
সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে বাজার ম্যানিপুলেশনের বিভিন্ন পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে তদন্ত কমিটি বলেছে, এক্ষেত্রে ডেলিভারি ভার্সাস পেমেন্ট (ভিভিপি) পদ্ধতিকে তারা বড় এবং মোক্ষম একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য বা ব্রোকাররা বড় অঙ্কের শেয়ারের লেনেদেনের ক্ষেত্রে এই ভিভিপি পদ্ধতি চালু করে। এর আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিরাট অঙ্কের শেয়ারের ভুয়া লেনদেন দেখানো হয় এবং এর মাধ্যমে বাজারে শেয়ারের সঙ্কট সৃষ্টি করে মূল্য বহুগুণ বাড়ানো হয়।
কমিটি বলেছে, স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য, ব্রোকার বা তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকরা শেয়ারের দাম বাড়ার জন্য সংঘবদ্ধভাবে বাজারে গুজব তৈরি করে শেয়ারের দাম ম্যানিপুলেট করেছে। এই গোষ্ঠী নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির নামে এমন সব তথ্য বাজারে ছেড়েছে, যাতে উল্লিখিত কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে তারা বোনাস বা রাইট শেয়ার ইস্যু কিংবা কোম্পানির কথিত সম্প্রসারণ ইত্যাদির কথা সুপরিকল্পিতভাবে বাজারে ছাড়ে। একই সময়ে এই গোষ্ঠী স্টক এক্সচেঞ্জের ফ্লোরে কোম্পানিগুলোর শেয়ার উচ্চ দামে এবং বেশি সংখ্যায় নিজেদের মধ্যেই কেনাবেচা করে। বাজারে ছাড়া তথ্য গুজবকে বিশ্বাসযোগ্য করাই এমন লেনদেনের উদ্দেশ্য।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যরা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শেয়ার কেনার জন্য টাকা নিয়ে তা দিয়ে নিজেদের নামে শেয়ার কিনেছে। বিনিয়োগকারীদের বলা হতো, শেয়ার পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলে তাদের সরবরাহ করা হবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের টাকায় কেনা শেয়ার বাজারের উচ্চমূল্যের সময় বিক্রি করে দিয়ে সদস্যরা বিশাল অঙ্কের লাভ ঘরে তুলেছে। এরাই আবার পতনশীল বাজার থেকে কম দামে শেয়ার কিনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সরবরাহ করেছে। সবকিছুই সম্পন্ন হতো বিনা বাধায়। কারণ স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা বা স্বচ্ছতার কোনো বালাই ছিল না।
এ চক্রে এসে যোগ দিয়েছে বিভিন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরাও। পরিচালকরা উল্লিখিত উপায়ে বাজারে তেজীভাব তৈরি করে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দিত। কিন্তু মধ্যস্থতাকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসব পরিচালকের পক্ষে কাজ করেছে বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি শেয়ারবাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের সাধারণ মন্তব্যে বলে, ওই পাঁচ মাসে স্বল্পসময়ের মধ্যে বিশেষ কয়েকটি শেয়ারের মূল্য হু হু করে বেড়ে যায় মূলত দ্রুত লাভের আশায় শেয়ারবাজারে ছুটে যাওয়া সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য। এসময় কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য কোনো মৌলভিত্তি ছাড়াই আকাশ ছুঁয়ে যায়। শেয়ারবাজারে ছুটে যাওয়া বিনিয়োগকারীরা বাজারের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে ছিল একবারেই অজ্ঞ। কয়েকটি মহল থেকে এসব অজ্ঞ ও নবিস বিনিয়োগকারীদের নিরপরাধ নাম দেয়া হয়েছে।
তদন্ত কমিটির মন্তব্যে বলা হয়, এটা সবার কাছেই পরিষ্কার যে, ওই সময় যারা পর্দার আড়াল থেকে বাঁশি বাজিয়ে এসব নিরপরাধ বিনিয়োগকারীদের মোহগ্রস্ত করেছিল এবং নতুন প্রজন্মের বিনিয়োগকারীদের সর্বনাশ করে নিজেদের আখের গুছিয়েছিল, তারা নিজেরা ছিল খুবই পাকা খেলোয়াড়। কাজেই ওই পরিস্থিতির জন্য এ জাতীয় কারসাজির নায়করাই দায়ী, যারা বুঝে-শুনে এই সর্বনাশা খেলায় নিরপরাধ বিনিয়োগকারীদের টেনে আনে।
এদিকে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর মাত্র সোয়া এক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ মূল্যসূচক ৫৪৭ পয়েন্ট পড়ে যায়। তবে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভের মুখে পরে বাজার পরিস্থিতি ঘুরে যায়। পুঁজিবাজারের এই ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছিলেন এসইসির চেয়ারম্যান। ঘটনার তদন্তে পর দিন ৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে এসইসি। একমাস সময় বেঁধে দিয়ে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তদন্তের বিষয়ে এসইসি কোনো কিছুই জানায়নি। আদৌ এ তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানা সন্দেহ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ’৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরা যেভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না

প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে টেন্ডারবাজির রকমফের : সরকার সমর্থকদের কাজ দিতে চলছে, বদলি আর জবরদস্তির পদত্যাগ

মাহাবুবুর রহমান

প্রাণিরোগের গবেষণা ও টিকা উত্পাদনের কাজ করে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ প্রতিষ্ঠানে অ্যানথ্রাক্স, রানিক্ষেত ও খুরারোগের টিকা উত্পাদনের সামগ্রী সরবরাহের তিনটি কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে। স্পর্শকাতর এ তিনটি কাজ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পছন্দের কোম্পানিকে দেয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের দফতর সম্পাদকের মালিকানাধীন ‘ম্যাস কনসোর্টিয়াম লি.’ নামের ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে সেখানে চলছে নীরব টেন্ডার সন্ত্রাস। নিয়ম ভেঙে মহাপরিচালকের নির্দেশনা না মানায় বদলি ও জবরদস্তিমূলক পদত্যাগ করানো হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। পছন্দের প্রতিষ্ঠান কাজ না পাওয়ায় মূল্যায়ন কমিটির রিপোর্ট গ্রহণ না করে তা পাঠানো হচ্ছে পুনর্মূল্যায়নে। কাজ-প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর দু’দফা পেছানো হচ্ছে শিডিউল জমার সময়সীমা। সংশোধনের মাধ্যমে যোগ্যতার শর্তও উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। যোগ্য ও সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানের জমা দেয়া কাগজপত্র ছিঁড়ে গোপন করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অস্ত্রবাজি নয়, এভাবে ক্ষমতাবাজির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে চলছে টেন্ডারবাজির রকমফের। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বদলি ও হয়রানির ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইনস্টিটিউটের দু’জন কর্মকর্তা তাদের নাম প্রকাশ না করতে বারবার অনুরোধ জানান। অবশ্য প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফ আলী এসব অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে বলেন, অধিক স্বচ্ছতা আনার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। সেক্ষেত্রে যে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ পেতে পারে।
সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানির চেয়ে দ্বিগুণ দরদাতা হলেও নানা কৌশলে মহাপরিচালকের নির্দেশনায় ম্যাস কনসোর্টিয়াম লি.কে কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বর্তমানে রানিক্ষেত টিকা শাখার মালামাল কেনার টেন্ডার নিয়ে কর্মকর্তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। এই শাখার গ্লাসওয়ার, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ ও বিবিধ মালামাল কেনার নিমিত্তে গত ২১ নভেম্বর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ২১ ডিসেম্বর টেন্ডারবক্স খোলা হয়। ৫টি কোম্পানি শিডিউল জমা দেয়। জমাকৃত শিডিউলে ইনভেন্ট টেকনোলজি লিমিডেট সর্বনিম্ন দরদাতা সাড়ে ২৮ লাখ ও সাড়ে ২৯ লাখ টাকার প্রস্তাব দেয়। এএসইডিএস ইন্টারন্যাশনাল ৫৪ লাখ ও সাড়ে ৫৭ লাখ টাকা, ম্যাস কনসোর্টিয়াম লি. ৮১ লাখ ৭০ হাজার ও ৮২ লাখ, লিঙ্কার এন্টারপ্রাইজ ৮৪ লাখ ৮০ হাজার ও ৯৪ লাখ ৮০ হাজার এবং বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস ৮৪ লাখ ৯০ হাজার ও ৯৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার প্রস্তাব দেয়।
সূত্র জানায়, শিডিউলগুলো মূল্যায়ন কমিটির হাতে গেলে সর্বনিম্ন দরদাতার প্রতিযোগিতায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা ম্যাস কনসোর্টিয়ামকে কাজ দেয়ার সুপারিশ করার জন্য ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক নির্দেশনা দেন। মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও বাদলটিকা শাখার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুর রশিদ এবং সদস্য পদ থেকে ডা. মো. রফিকুল ইসলাম এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাকে বদলি করার হুমকি দেয়া হয়। অন্যথায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ দেয়া হলে তিনি পদত্যাগ করেন।
পাঁচ সদস্যের মূল্যায়ন কমিটির দুজন পদত্যাগ করলে রানিক্ষেত টিকা শাখার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. বিশ্বনাথ মালাকার গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার পরিচালকের কাছে দেয়া এক চিঠির মাধ্যমে মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও একজন সদস্য নতুন করে নিয়োগ করেন। গত ২ জানুয়ারি (স্মারক নং-রানিক্ষেত/২০১১/০২) চিঠিতে তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালকের মোবাইল ফোনের নির্দেশ অনুসারে ঢাকার ডিএলও মোহাম্মদ আলীকে আহ্বায়ক ও প্ল্যানিং শাখার স্টোর কিপার ডা. মো. সাইদুর রহমানকে সদস্য পদে মূল কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি পুনঃঅনুমোদন এবং পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হল। ওই দিনই এ চিঠি অনুমোদন করে পাল্টা চিঠি পাঠান গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার পরিচালক।
নতুন মূল্যায়ন কমিটি সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানি এনভেন্ট টেকনোলজি লি. এবং দ্বিতীয় অবস্থানের এএসইডিএস ইন্টারন্যাশনালকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দেয়ার অজুহাত দেখিয়ে অযোগ্য করে দেয়। তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও যোগ্য বিবেচনা করে ম্যাস কনসোর্টিয়াম লি.কে কার্যাদেশ দেয়ার জন্য সুপারিশ করে পুনর্গঠিত মূল্যায়ন কমিটি।
প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ অন্য চারটি কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেন, বিজ্ঞপ্তির কপি জমা না দেয়াসহ কিছু অপ্রয়োজনীয় ভুল চিহ্নিত করেছে মূল্যায়ন কমিটি। কিন্তু ম্যাস কনসোর্টিয়াম বিজ্ঞপ্তির গুরুত্বপূর্ণ শর্তই পূরণ করেনি। টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির শর্তে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের ১ কোটি ১০ লাখ টাকার কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। সেখানে ম্যাস কনসোর্টিয়াম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাজের অভিজ্ঞতা জমা দিয়েছে। শর্ত অনুযায়ী দেড় কোটি টাকার লিকুইড অ্যাসেট থাকার ব্যাংক স্টেটমেন্টও এ কোম্পানি জমা দিতে পারেনি। সম্পূর্ণ জবরদস্তিমূলক এ কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
মূূল্যায়ন কমিটির রিপোর্ট দেয়ার পরই গত কয়েকদিন ধরে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অবিলম্বে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে রানীক্ষেত টিকা শাখার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. বিশ্বনাথ মালাকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ওপর নানামুখী চাপ আছে। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
একই কোম্পানিকে খুরা রোগের টিকা শাখার কাজও দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় ৪ কোটি টাকার খুরা রোগের টিকা উত্পাদন সামগ্রী সরবরাহের টেন্ডার শিডিউল জমার তারিখ দু’দফা বাড়ানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত শর্ত ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড পূরণ করতে পারছে না বলে সংশোধন করে শর্ত উঠিয়ে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৪ জানুয়ারি সংশোধনের আদেশ জারি করা হয়। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা কমিয়ে তিন বছর, প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট সামগ্রী সরবরাহের তিন বছরের অভিজ্ঞতা কমিয়ে এক বছর, তালিকাভুক্ত কোম্পানির বাইরেও যে কোনো প্রকৃত উত্পাদন কোম্পানিকে প্রতিযোগিতা করার সুযোগদান এবং লিকুইড মানি দেখানোর ক্ষেত্রে ব্যাংক স্টেটমেন্টের সঙ্গে আয়কর সার্টিফিকেট দেয়ার বিষয়টি তুলে দেয়া হয়েছে।
এদিকে প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে ৬ জানুয়ারি শিডিউল জমার শেষ সময় থাকলেও তা দু’দফায় বাড়িয়ে প্রথমে ১৩ ও এখন ১৯ জানুয়ারি করা হয়েছে।
পছন্দের ও অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে এভাবে শর্ত উঠিয়ে নেয়া এবং দু’দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। অবশ্য এ অভিযোগকে নাকচ করে দিয়ে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. আশরাফ আলী বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ যে কোনো শর্ত উঠিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। অধিকতর স্বচ্ছতা আনতে এমনটি করা হয়েছে।’
এদিকে স্পর্শকাতর ‘অ্যানথ্রাক্স রোগ’-এর টিকা উত্পাদনের কেমিক্যাল ও মালামাল ক্রয়ের কাজও ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড কোম্পানিকে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মূল্যায়ন কমিটির রিপোর্টে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার সুপারিশ করা হলেও তা বাতিল করে দরপত্র পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীন অ্যানথ্রাক্স টিকা উত্পাদন শাখা থেকে ২০১০-১১ অর্থবছরের কেমিক্যাল ও আনুষঙ্গিক মালামাল ক্রয়ের জন্য ওপেন টেন্ডারিং পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গঠিত মূল্যায়ন কমিটি জমাকৃত দরপত্র মূল্যায়ন করে গত ২৩ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়। দরপত্র মূল্যায়ন রিপোর্টে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় আ-শা সায়েন্টিফিক কোং। এ কোম্পানিটি ৭৪ লাখ ৭০ হাজার টাকায় উল্লিখিত কেমিক্যাল ও প্রয়োজনীয় মালামাল কেনার কথা দরপত্রে উল্লেখ করে। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয় সায়মন এন্টারপ্রাইজ। এ কোম্পানিটি ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় উল্লিখিত মালামাল সরবরাহের প্রস্তাব দেয়। ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকার প্রস্তাবনায় দিয়ে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস এবং ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড।
মূল্যায়ন কমিটি সূত্র জানায়, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শুরু থেকেই ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডকে সর্বনিম্ন দরদাতা উল্লেখ করে মূল্যায়ন রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশনা দেন। সর্বনিম্ন অন্য তিনটি কোম্পানির আবেদনে ত্রুটি দেখিয়ে তা বাতিল করতে মৌখিক নির্দেশ দেন তিনি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা, মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. সুলতানা শাহানা বানু, ডা. মো. আবু বকর সিদ্দিক, ডা. মো. রফিকুল ইসলাম ও ডা. হুজ্জত উল্যাহ এ বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা সভায় মিলিত হন। কিন্তু তথ্য ফাঁকি দিয়ে দরপত্র মূল্যায়নে বাদ সাধেন দু’তিন সদস্য। সর্বশেষ নিরপেক্ষ ও বস্তনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন শেষে ২৩ ডিসেম্বর মূল্যায়ন কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়।
নির্দেশনা অনুযায়ী মূল্যায়ন রিপোর্ট না পেয়ে ক্ষেপে যান প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফ আলী। এক কর্মকর্তাকে তিনি ঢাকা থেকে বাঞ্ছারামপুরে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। আরও দু’তিন কর্মকর্তাকে বদলির হুমকি দেয়া হয়।
সর্বনিম্ন দরদাতার বিচারে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডকে কাজ দিতে চান তিনি। এ জন্য দরপত্র মূল্যায়নের রিপোর্ট তদন্তের জন্য তিনি গত ২৭ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে রিপোর্ট জমা দেয়। রিপোর্ট পেয়ে মহাপরিচালক কোনো ধরনের সভা বা আলোচনা ছাড়াই দরপত্র পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে শতাধিক ঠিকাদারের অভিযোগ : যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও জালিয়াতি



জাহিদুল করিম কচি, চট্টগ্রাম

আন্তর্জাতিক ক্রয়ে ব্যাপক দূর্নীতি ও জালিয়াতির ফলে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ রেলওয়ে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত শতাধিক ঠিকাদার প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিতভাবে এসব অভিযোগ জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের দরপত্র আহ্বান, কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন এবং মন্ত্রণালয় পর্যায়ে যাচাই-বাছাই কোনো কিছুতেই সরকারের ক্রয় আইন ও বিধি অনুসরণ করছে না যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব আন্তর্জাতিক দরপত্রই সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপ পদ্ধতিতে আহ্বান করা হয়। অথচ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ) এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলসে (পিপিআর) দরপত্র আহ্বানের স্বীকৃত/অনুসৃত দুটো পদ্ধতি হচ্ছে ‘ওপেন টেন্ডারিং মেথড’ ওটিএম বা উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি এবং ‘টু স্টেজ’ বা দ্বিতীয় পর্যায় পদ্ধতি। পিপিএ’র আন্তর্জাতিক ক্রয় সংক্রান্ত ৩৩ ধারায় সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপ নামের কোনো পদ্ধতি নেই। আর ৩৪ ধারায় রয়েছে টু-স্টেজ বা দ্বিতীয় পর্যায় পদ্ধতি। পিপিএ’র নির্দেশনাগুলো বিস্তারিতভাবে পিপিআর’র ৮৩ ও ৮৪ বিধিতে রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) ওয়েবসাইটে থাকা প্রমিত দরপত্রের ফরমেটেও (স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্ট) আন্তর্জাতিক দরপত্রের ক্ষেত্রে সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপ পদ্ধতি বলে কিছু নেই। এ ফরমেটেই সংবাদপত্রে সব মন্ত্রণালয়ের অসংখ্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় উদ্ভাবিত সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপ পদ্ধতিকে বৈধতা দিতে মন্ত্রিসভা কমিটির জন্য তৈরি প্রস্তাবে সারসংক্ষেপ ক্রয় আইনের অসত্য উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। অনিয়মের জন্য একই সঙ্গে পৃথক দুটি খামে কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এতে পছন্দের প্রতিষ্ঠানের কারিগরি প্রস্তাবকেই কেবল যোগ্য (রেসপনসিভ) এবং অন্যদের (বিশেষ করে যাদের দর কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে) কারিগরি প্রস্তাবকে অযোগ্য (নন রেসপনসিভ) ঘোষণা করে কথিত যোগ্য বা রেসপনসিভ দরদাতাদের আর্থিক প্রস্তাব খুলে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে পাতানো এ প্রক্রিয়ায় পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলোই পর্যায়ক্রমে শত শত কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে।
গত ৫ জানুয়ারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভার আলোচ্যসূচির বাইরে সওজের জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের ৪টি প্যাকেজে ৮৮০ কোটি টাকায় ঠিকাদার ও ২৫ কোটি টাকায় নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব সম্পূরক বিষয় হিসেবে টেবিলে উত্থাপিত ও কোনো আলোচনা ছাড়াই অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়। এজন্য তৈরি সার-সংক্ষেপে নতুন ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কিত ৪টি ক্রয় প্রস্তাব/সার-সংক্ষেপের প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ওয়ান স্টেজ টু ইনভেলাপ পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের নোটিশটি সংযুক্ত করা হয়নি। নয় শতাধিক কোটি টাকার ক্রয় প্রস্তাবের সার-সংক্ষেপ কমিটির সদস্যদের পড়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। সার-সংক্ষেপ তৈরিতে প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কোনো ক্ষেত্রেই নিয়ম নীতিমালা অনুসরণ করছে না।
এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভার আলোচ্যসূচিভুক্ত ৪, ৫, ৬, ৭, ৮নং বিষয়গুলো ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ফরিদপুর ও উত্তরবঙ্গে রেললাইন নির্মাণ সংক্রান্ত। সিপিটিইউ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলাদেশ রেলওয়ের দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে ওপেন টেন্ডারিং মেথড ওটিএম বা উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির উল্লেখ থাকলেও ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রেরিত সার-সংক্ষেপের প্রথম পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপের দরপত্র আহ্বান করার কথা বলা হয়েছে। ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ওই সভায় কয়েকজন সদস্য সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপের বিষয়টি উত্থাপন করলে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা এতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদনের উল্লেখ করে ক্রয় কমিটিকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নেন। যদিও অন্য ৩টি প্রকল্পের সঙ্গে পাচুরিয়া-ফরিদপুর এবং ষোলশহর-দোহাজারী রেললাইনের প্রকল্পের ডিপিপি একনেকের অনুমোদনের আগেই কেবল দরপত্র আহ্বানের অনুমোদন দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, এর আগেও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধু সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ এবং ফাটল মেরামতের দরপত্রসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক দরপত্রেই সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপে প্রস্তাব আহ্বান করে একই ধরনের অসততার আশ্রয় নিয়ে বেআইনি প্রস্তাব ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে সহায়তাকারী সচিবরা, মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্য সিনিয়র মন্ত্রিরা এবং চূড়ান্ত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষসহ সবাই অনিয়মের মামলার ঝুঁকিতে থাকছেন।
এদিকে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিনিয়োগকারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার সিকদার-কেসিসি জয়েন্টভেঞ্চারকে কারিগরি মূল্যায়নে অযোগ্য ঘোষণা করায় বিনিয়োগকারী নির্বাচন প্রতিযোগিতাহীন হয়ে পড়েছে। সিকদার-কেসিসি কারিগরি প্রস্তাবের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন দাবি করে বলেছে, অন্যায়ভাবে তাদের অযোগ্য দেখানো হয়েছে। তাদের দাবি ইটাল-থাইয়ের কোথাও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা নেই। বিষয়টি হাইকোর্টে শুনানি ও সংসদীয় কমিটিতে পরীক্ষাধীন অবস্থায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাড়াহুড়ো করে ইটাল-থাইয়ের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে। ৮ হাজার কোটি টাকার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দেশের প্রথম পিপিপি প্রকল্প। এ প্রকল্পের ২৭ শতাংশ ব্যয় সরকার বহন করবে। ফলে এ নিয়ে তাড়াহুড়ো করলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়াসহ নানা জটিলতা ও ভবিষ্যত্ পিপিপি প্রকল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। তদুপরি বাংলাদেশ রেলওয়ের কোচ, বগি ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়ম করা হচ্ছে। নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে আগেই বিদেশি স্পেশিফিকেশন দিয়ে দেয়া হচ্ছে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে। যাতে করে অন্যরা দরপত্রে অংশ নিলেও কাজ না পায়।
সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো অভিযোগে বলেন, দরপত্রে অনিয়ম তথা অবৈধ ক্রয় প্রস্তাবগুলো বৈধ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেভাবে আপনার নাম ভাঙ্গিয়ে অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীর মতো ব্যক্তিদেরকে ক্রয় কমিটির বৈঠকে ব্ল্যাক মেইল করছেন তাও অকল্পনীয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গতিহীনতা আর বেআইনি, অস্বচ্ছ ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণে ভবিষ্যতে আপনার সরকারের অনেক সাফল্যে জনগণের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে

Saturday, 8 January 2011

নড়াইলে ১৫ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিল ক্ষমতাসীন নেতারা : টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে দলের ২ এমপি ও ৩ চেয়ারম্যান নিয়ে গঠিত কমিটি

নড়াইল প্রতিনিধি

নড়াইলে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক টেন্ডারবাজির অভিযোগ উঠেছে। নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণে গঠিত হয়েছে ৭ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি। কমিটির সদস্যরা হলেন নড়াইলের এমপিদ্বয়, তিন উপজেলা চেয়ারম্যান, নড়াইল পৌরসভার বর্তমান ও একজন সাবেক মেয়র। স্টিয়ারিং কমিটির তত্ত্বাবধানে গঠন করা হয়েছে ২১ সদস্যের টেন্ডার কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বিশিষ্ট ঠিকাদার মো. আজাহার উদ্দিন। অলিখিত এ কমিটির মাধ্যমে সব ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। কোনো বিভাগে দরপত্র আহ্বান করা হলে শুধু কমিটির মনোনীতদেরই দরপত্র কিনতে দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী মতাদর্শের বাইরের কেউই টেন্ডারে অংশ নিতে পারছেন না। দরপত্র দাখিলের আগে সমঝোতা বৈঠকের মাধ্যমে ভাগ-বাটোয়ারা করা হচ্ছে কাজ। উত্সব কমিউনিটি সেন্টার, সার্কেট হাউস ও রূপগঞ্জ টাউন ক্লাবে এসব ভাগ-বাটোয়ারা ও সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ শীর্ষ ও প্রভাবশালী নেতাকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। দরপত্র ক্রয় ও দাখিল নিয়ন্ত্রণ করার ফলে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা না থাকায় নিজেদের সুবিধামতো দর উঠিয়ে দাখিল করা হচ্ছে দরপত্র। এভাবে এরই মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের সাড়ে ১৫ কোটিরও বেশি টাকার কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এর ফলে সরকারের মোটা অংকের রাজস্ব হারারোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পাধীন বিল চেঞ্চুরি উপ-প্রকল্পে চারটি রেগুলেটর সংস্কার ও ৮.৪ কিলোমিটার খাল সংস্কার কাজে ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত মূলের বিপরীতে ১৫ নভেম্বর টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এতে ১২০টি দরপত্র বিক্রি হলেও প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে গড়ে সাড়ে ৯ শতাংশ অতিরিক্ত দর দিয়ে দাখিল করা হয় মাত্র ২০টি দরপত্র। একই প্রকল্পে গত ১ ডিসেম্বর ১০টি খাল সংস্কার ও রেফারেন্স সেকশন নির্মাণে ৯৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের বিপরীতে দরপত্র আহ্বান করা হলে মাত্র ১৫টি দরপত্র বিক্রি হয় এবং গড়ে ৯ শতাংশ অতিরিক্ত দর দিয়ে দাখিল করা হয় ১১টি দরপত্র। একই প্রকল্পে ৭ গ্রুপে ৫ কোটি ৮ লাখ টাকার খাল পুনঃখনন কাজে গত ২৯ ডিসেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হলে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ অতিরিক্ত মূল্যে ২২টি দরপত্র দাখিল করা হয়। কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত যুবলীগের একটি গ্রুপ এদিন দরপত্র জমা দিতে গেলে যুবলীগ নেতা ছালাম প্রতিপক্ষের হাতে প্রহৃত হন এবং দু’গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ঠিকাদার জানান, এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ২০-২২ শতাংশ নিম্নদর দিয়ে কাজ নেয়ার নজির থাকলেও বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে প্রাক্কলিত মূলের চেয়ে অতিরিক্ত দর দেয়া হচ্ছে। গত ৬ ডিসেম্বর সড়ক বিভাগে ৫৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত মূল্যে রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ কাজে দরপত্র আহ্বান করা হলে ৮৫টি দরপত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে সড়ক বিভাগের বিভিন্ন টেন্ডারে প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত নিম্নদর দেয়া হয়েছে জানিয়ে নড়াইল সড়ক বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী কামরুল শেখ বলেন, এবারে গড়ে ৪ শতাংশ অতিরিক্ত দর দিয়ে ৫ গ্রুপে ১৭টি দরপত্র দাখিল করা হয়েছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মনে করেন তিনি। একই দিনে এলজিইডি’র অধীন ১৯ গ্রুপে জেলার তিন উপজেলায় ৩৬.৫২ কিলোমিটার রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের বিপরীতে দরপত্র আহ্বান করা হলে ১৪৫টি দরপত্র বিক্রি হয় এবং গড়ে প্রায় সমমূল্য দিয়ে প্রতি গ্রুপে গড়ে মাত্র ৪টি দরপত্র দাখিল করা হয়। গত ৩ জানুয়ারি এলজিইডির অধীন ২ গ্রুপ বিটুমিনাস কার্পেটিং দ্বারা রাস্তার উন্নয়নে ২ কোটি সাড়ে ৭ লাখ টাকার কাজের দরপত্র আহ্বান করা হলে ৩৬টি দরপত্র বিক্রি হয় এবং প্রায় সমদর দিয়ে দুই গ্রুপে দাখিল করা হয়েছে ৭টি দরপত্র। এলজিইডি নড়াইল বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী হারুনার রশিদ বলেন, প্রতিযোগিতা থাকলে সাধারণত কেউ সমদর দেয় না। বিষয়টি অস্বাভাবিক।
এর আগে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জেলার তিন উপজেলায় কালভার্ট নির্মাণে প্রতিটিতে ১৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকার বিপরীতে গত ১০ নভেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হলে দরপত্র দাখিল নিয়ন্ত্রণ করে সদর ও কালিয়া উপজেলায় কাজ বাগিয়ে নেয়া হয়। এ ছাড়া লোহাগড়ায় শাসক দলের নেতাকর্মীদের মনোনীত ঠিকাদারকে কাজ না দিয়ে দাখিলকৃত ৩৯টি বৈধ দরদাতার মধ্যে নিয়মানুযায়ী লটারি করা হলে তাদের হাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা লাঞ্ছিত হন।
নড়াইল-২ আসনের এমপি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এসকে আবু বাকের ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণে কোনো স্টিয়ারিং কমিটির কথা জানেন না দাবি করে বলেন, কেউ টেন্ডারবাজি করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এমপি ছাত্রলীগ পুলিশের আচরণে ক্ষুব্ধ বরিশালবাসী : চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজিতে উদ্বিগ্ন জাপা নেতাকর্মীরাও

জিএম বাবর আলী বরিশাল

বরিশালে সরকারদলীয় এমপি, ছাত্র সংগঠন এবং পুলিশের একাধিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন নগরবাসী। পাশাপাশি ঠিকাদারি কাজের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রশি টানাটানি চলছে এমপি ও অন্য শীর্ষ নেতাদের মধ্যে। মহাজোটের অন্যতম শরিক দল জাপা নেতাকর্মীরাও ক্ষুব্ধ টেন্ডার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে টেন্ডার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনকালে অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে নগরীর সোহেল চত্বরে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালায়। পুলিশের সামনে ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়া চললেও পুলিশ ছিল সম্পূর্ণ নীরব। দু’গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলাকালে পুলিশ তিন ছাত্রলীগ ক্যাডার আটক করলেও পরে তা অস্বীকার করে। এমনকি ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করলেও সাংবাদিকরা ছবি তোলার সময় তা লুকানোর চেষ্টা করে পুলিশ।
অপরদিকে গত ২৮ নভেম্বর বিনা উস্কানিতে বরিশাল প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জে প্রেস ক্লাব সম্পাদক লিটন বাশার, এটিএন বাংলার স্টাফ রিপোর্টার হুমায়ুন কবির, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত বাবলু, আমার দেশের স্টাফ রিপোর্টার নিকুঞ্জ বালা পলাশ, সমকালের স্টাফ রিপোর্টার সুমন চৌধুরীসহ ২০ সাংবাদিক আহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকরা নগরীতে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন।
সাংবাদিকদের ওপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ করলেও ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সশস্ত্র যুদ্ধের সময় কোতোয়ালি পুলিশ ছিল দর্শকের ভূমিকায়। এ নিয়ে নগরজুড়ে তীব্র সমালোচনা হলেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কারও বিরুদ্ধে।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অধিকাংশ সরকাার, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজগুলো সরকারদলীয় নেতাকর্মী বা ঠিকাদারদের মাঝেই বিতরণ করার অভিযোগ রয়েছে ভুরিভুরি। টেন্ডার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দুই বছরে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মাঝে। কোথাও কোথাও নিজ পছন্দের লোককে কাজ দেয়া নিয়ে রশি টানাটানি চলছে সরকারদলীয় এমপি থেকে শুরু করে অন্য নেতাদের সঙ্গে।
প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকার একটি ঠিকাদারি কাজ নিজের লোকের প্রতিষ্ঠানকে না দেয়ায় বরিশাল-২ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনি ও তার ছেলের হাতে প্রহৃত হয়েছেন বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক নির্বাহী প্রকৌশলী। সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টায় সোমবার বেলা ১১টায় নগরীর বান্দরোডের পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় উপস্থিত ঠিকাদার ও একাধিক যুবলীগ নেতার সঙ্গেও এমপি মনিরের বাকবিতণ্ডা হয়। পুলিশ পাউবো কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং উপস্থিত ঠিকাদারদের রোষানল থেকে উদ্ধার করেন এমপি মনি ও তার ছেলেকে। যদিও এমপি মনিরুল ইসলাম মনি বলেন, তিনি তার এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে আলোচনা করতে নির্বাহী প্রকৌশলীর কক্ষে যান। সেখানে উপস্থিত যুবলীগ নেতা অরুন ও তার সহযোগীরা তাকে লাঞ্ছিত করে। তিনি আরও বলেন, উপজেলা পর্যায়ের সব ঠিকাদারি কাজও ভাগবাটোয়ারা করছেন একাধিক প্রভাবশালী নেতা। এ কারণে উপজেলা পর্যায়ের সাধারণ ঠিকাদাররা সব ধরনের কাজপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এদিকে পুলিশের সামনেই অস্ত্রের মহড়া, সংঘর্ষ এবং বিনা উস্কানিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন নগরবাসী। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য পুলিশের নীরব ভূমিকাকেই দায়ী করেছেন অনেকেই। পুলিশের অতিরিক্ত আওয়ামী লীগ সাজার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে বলে সাধারণ মানুষের মন্তব্য। অভিযোগ রয়েছে, বিএম কলেজ ছাত্র সংসদ বাকসুর কার্যকরী কমিটির সদস্য ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বর্তমান ওসি মো. জাহাঙ্গীরের অতিরিক্ত দলীয়প্রীতির কারণেই নগরীতে এসব ঘটনা ঘটলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
এদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাজ ভাগাভাগি করে নেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মহাজোটের অন্যতম শরিক দল জাপার কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক মহসিন-উল ইসলাম হাবুল আমার দেশকে বলেন, বরিশালের প্রভাবশালী নেতারা পার্সেন্টেজের মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে টেন্ডার ভাগবাটোয়ারা করে দিচ্ছেন। ফলে এসব উন্নয়নমূলক কাজের গুণগত মান খারাপ হচ্ছে। টেন্ডারবাজি ও বিভিন্ন চাঁদাবাজির ঘটনায় জাপা নেতাকর্মীরাও ক্ষুব্ধ বলে জানান তিনি।

Friday, 7 January 2011

আরও দুটি বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ পেল সামিট

স্টাফ রিপোর্টার

বেসরকারি খাতে ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও দুটি বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ পেল বাণিজ্যমন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার। দুটি কেন্দ্র থেকে উচ্চদরে বিদ্যুত্ কিনতে হবে সরকারকে। ১৫ বছর মেয়াদে এ দুই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত্ ক্রয় বাবদ সরকারকে পরিশোধ করতে হবে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করা হবে সৈয়দপুরে এবং ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করা হবে শান্তাহারে। উভয় বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করবে কনসোর্টিয়াম অব সামিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড মার্কেন্টাইল করপোরেশন লিমিটেড অ্যান্ড সামিট পাওয়ার লিমিটেড। গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়।
সভা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানান, বিদ্যুেকন্দ্রের ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা বানাতে হবে। এ নীতিমালায় কারিগরি এবং দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন করা হবে। যাতে দরপ্রস্তাব খোলার পর কারিগরিভাবে অযোগ্যতার সমস্যা দেখা না দেয়।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আজ ১৫০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ দুই বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করবে সামিট পাওয়ার। তারা সর্বনিম্ন দরদাতা এবং যোগ্য কোম্পানি। তাদের আরও ৪টি বিদ্যুেকন্দ্র আছে। এর ৩টি বিবিয়ানায় এবং একটি মদনগঞ্জে।
প্রসঙ্গত, আইপিপির আওতায় সৈয়দপুরে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের প্রাকযোগ্যতার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হলে সর্বশেষ সময়সীমা ২ মে-২০১০ পর্যন্ত ৯টি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। প্রাকযোগ্যতায় ৮টি কোম্পানি টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির কাছে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। এদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হলে ৬টি কোম্পানি দরপ্রস্তাব জমা দেয়। এদের মধ্যে সামিট সর্বনিম্ন দরদাতা বিবেচিত হওয়ায় তা অনুমোদনের জন্য ক্রয় কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়। এ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য সামিটকে পরিশোধ করতে হবে ৬ দশমিক ৯৯ টাকা।
শান্তাহারে ৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাকযোগ্যতায় অংশগ্রহণ করে ১১টি প্রতিষ্ঠান। মূল্যায়ন কমিটির কাছে ৮টি প্রতিষ্ঠান যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। এ ৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে দরপত্র আহ্বান করা হলে ৪টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে কনসোর্টিয়াম অব সামিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড মার্কেন্টাইল করপোরেশন লিমিটেড অ্যান্ড সামিট পাওয়ার লিমিটেড সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের কাছ থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত্ ক্রয় করতে হবে ৭ দশমিক শূন্য ৬৭ টাকায়।

সাড়ে ৯ মাসে সর্বনিম্ন লেনদেন : পুঁজিবাজারে দরপতনে বিক্ষোভ ভাংচুর লাঠিচার্জে আহত ৩০



অর্থনৈতিক রিপোর্টার

পুঁজিবাজারে বড় ধরনের দরপতনে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো গতকালও বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ মিছিল ও ভাংচুর চালিয়েছে। বেলা ৩টায় লেনদেন শেষ হওয়ার পর পরই বিনিয়োগকারীরা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ভবনের সামনের সড়ক অবরোধ করে ভাংচুরের ঘটনা ঘটায়। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ করে। এমনকি বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে ঢুকে বিনিয়োগকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে পুলিশ। পুলিশের এমন আচরণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পুলিশের লাঠিচার্জে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে ৬ বিনিয়োগকারীকে আটক করেছে পুলিশ। দেড় ঘণ্টাব্যাপী বিক্ষোভ শেষে বেলা সাড়ে ৪টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। ব্যাপক দরপতনের কারণে গত বুধবারও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল।
গতকাল ঢাকা শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দিয়ে লেনদেন শুরু হলেও ১০ মিনিটের মধ্যেই অধিকাংশ শেয়ারের দরপতনের কারণে সূচকের ব্যাপক পতন ঘটে। পরবর্তী আধঘণ্টার মধ্যেই সূচক আগের দিনের চেয়ে ৫৭ পয়েন্ট কমে যায়।
এরপর সূচক কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও তা খুব একটা স্থায়ী হয়নি। শেয়ারের বিক্রি চাপ বেড়ে যাওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই সূচকে নিম্নমুখী প্রবণতা তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীরা এতে আরও আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে দ্রুত সূচকের পতন ঘটতে থাকে। পলনদেন পশষে আগের দিনের তুলনায় ডিএসই সাধারণ সূচক কমে যায় ২১৩ পয়েন্ট। এ বছরে এটিই সর্বোচ্চ দরপতন। এর আগে ৩ জানুয়ারি ২০৪ পয়েন্টের পতন হয়েছিল। নতুন বছরে এ নিয়ে টানা চারদিনই শেয়ারবাজারের সূচকের পতন হয়েছে। এ সময়ে ডিএসই সাধারণ সূচক কমেছে ৫৭০ পয়েন্ট। অপরদিকে বাজার মূলধন কমে গেছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গতকাল লেনদেনে অংশ নেয়া ২৪৭টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১৬টি ছাড়া বাকি ২৩১টির শেয়ারের দরপতন ঘটে।
এরই মধ্যে গত ৮, ১২ ও ১৯ ডিসেম্বরের দরপতনের কারণে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজির বড় অংশই হারিয়েছেন। এর মধ্যে গত চারদিনের টানা দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় পড়েছেন। অনেকের এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করতে সরকারের জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তা না হলে শেয়ারবাজারে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। দরপতনের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে তারল্য প্রবাহ ব্যাপক হারে কমে গেছে। ৫ ডিসেম্বর শেয়ারবাজারে একদিনে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। এখন লেনদেনের পরিমাণ কমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে মাত্র ৯৬৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। লেনদেনের পরিমাণ গত সাড়ে ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত ১৯ মার্চ ডিএসইতে সর্বনিম্ন ৯৬৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। বাজারে তারল্য প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারল্য প্রবাহ বাড়াতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) মার্জিন লোন সুবিধা ১ঃ১.৫ হারে বাড়ালেও মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো গ্রাহকদের এ হারে ঋণ দিতে পারছে না। তারাও বড় ধরনের তারল্য সঙ্কটে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাজার পরিস্থিতি বিষয়ে বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এলিয়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের এমডি ওয়ালি উল মারুফ মতিন বলেন, পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা উপায়ান্তর না দেখে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। কিন্তু এতে কোনো লাভ নেই। তবে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় সরকারের হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন। সরকার শেয়ার কিনলে বর্তমান সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। দেশের পুঁজিবাজারকে অসম্পূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। বাজার এখনও শুধু ইক্যুয়িটি বেইজড। বন্ড মার্কেট চালু করা যায়নি। ডেরিভেটিভ নেই। এর ফলে বাজারে ঝুঁকি তৈরি হলেও তা থেকে সহজে উত্তরণ সম্ভব হয় না। তিনি বিনিয়োগকারীদের অহেতুক আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এইমস ফার্স্ট বাংলাদেশের এমডি ও বাজার বিশ্লেষক ইয়াওয়ার সাঈদ বলেন, পুঁজিবাজারে এতদিন আইন ভঙ্গ করে অনেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিল। ধারদেনা করেও অনেক বিনিয়োগকারী বাজারে ফ্রেশ টাকা নিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে তাদের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয় করছে। নতুন করে বিনিয়োগও করছে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখনও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না। ফলে বাজারে শেয়ারের চাহিদা অনেকাংশেই কমে গেছে। এ কারণে বিক্রি চাপ বেড়ে যাওয়ায় শেয়ারের দর সংশোধন হচ্ছে। বর্তমানে শেয়ারের দরপতন হলেও এটি অস্বাভাবিক নয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারই অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় বাজারে দর সংশোধন অনেকটাই অনুমিত ছিল এবং তা-ই হচ্ছে। তবে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যারা মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ার কিনেছেন তাদের উদ্বেগের কারণ নেই। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগে তারা লাভবান হবেন।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ব্যাপক দরপতনের পর লেনদেন শেষে গতকাল বেলা ৩টার দিকে বিক্ষোভ শুরু করে বিনিয়োগকারী। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ভবনের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দেয় এবং একটি বাস ও একটি প্রাইভেট কার ভাংচুর করে। পুলিশ বিনিয়োগকারীদের রাস্তা থেকে হটাতে বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ডিএসই ভবনের সামনের মধুমিতা সিনেমা হল ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে ঢুকে এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ করে পুলিশ। ব্রোকারেজ হাউসে অবস্থানরত বিনিয়োগকারীরা পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হন। এর আগে শেয়ারবাজারে দরপতনের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল করলেও পুলিশ কখনো বিনিয়োগকারীদের ওপর এতটা চড়াও হয়নি। কিন্তু গতকাল পুলিশ অনেকটা বেপরোয়া ছিল। পুলিশের এমন ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পুলিশের আঘাতে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। বিক্ষোভ চলাকালে দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিনিয়োগকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ দুটি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। তবে জলকামান আনলেও তা ব্যবহার করা হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ আটজনকে আটক করে। তাদের মধ্যে দুজনকে ছেড়ে দেয়া হলেও ছয়জনকে আটক করে মতিঝিল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারা হলেন—মামুন (২৮), আলী আকবর (৫৫), মোবারক হোসেন (৩০), বাদশা মিয়া (২৮), ফয়সাল আহমেদ (২৪), মাহমুদুল (২৫)

চাঁদাবাজির প্রতিবাদে পুরনো ঢাকায় ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন

স্টাফ রিপোর্টার

চাঁদাবাজির প্রতিবাদে পুরনো ঢাকার মোটরপার্টস ও টায়ার-টিউব ব্যবসায়ীরা গতকাল মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। বেলা ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকার বাহাদুর শাহ পার্ক রোড পর্যন্ত দোকান বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দাবি চাঁদাবাজি ও ব্যবসায়ীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা বন্ধ না হলে তারা বড় ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। উল্লেখ্য, গত ৩ জানুয়ারি চাঁদাবাজদের গুলিতে মোটরপার্টস ব্যবসায়ী নির্মল চন্দ দত্ত আহত হন। এ সময় মোটরপার্টস ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি আলহাজ নাজিম উদ্দিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। হাজি নাজিম জানিয়েছেন, চাঁদা না দেয়ায় ২ সন্ত্রাসী তার দোকানের সামনে এসে গুলি চালালে কর্মচারী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা জানান, চাঁদাবাজি বন্ধ, সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদ ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা প্রদানের দাবিতে মোটরপার্টস ও টায়ার-টিউব ব্যবসায়ীরা সকাল থেকেই মোটরপার্টস মার্কেটে জমায়েত হন।
পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী শত শত ব্যবসায়ী দোকান-পাট বন্ধ রেখে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তারা দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা মানববন্ধন করেন। এ সময় বাহাদুর শাহ রোড হয়ে লালকুঠি পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তায় কয়েকশ’ দোকান-পাট বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা। এক সপ্তাহের মধ্যে স্থানীয় চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের গ্রেফতার করে ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। আর তা না হলে পুরনো ঢাকার সব ব্যবসায়ীকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য ফোরাম গঠন করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান তারা। মানববন্ধন শেষে এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. আসলাম, সিনিয়র সহ-সভাপতি আলহাজ আনোয়ার হোসেন, আবুল কাশেম মাঝি ও মুজাহিদ।
এ ব্যাপারে সূত্রাপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) সেলিম জানান, চাঁদাবাজির প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরা শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন করেছেন। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী চাঁদাবাজদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

দুর্নীতিবাজদের বিচারের দাবিতে শিক্ষকদের অধিদফতর ঘেরাওয়ের আল্টিমেটাম

স্টাফ রিপোর্টার

অবিলম্বে শিক্ষা অধিদফতরের দুর্নীতি বন্ধের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক- কর্মচারী ঐক্যজোটের নেতারা।
তারা বলেন, শিক্ষা অধিদফতরের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে খুব শিগগিরই শিক্ষকরা অধিদফতর ঘেরাও করবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রকাশ্যে রাজপথে বিচার করা হবে। গতকাল জোটের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে এসব কথা বলেন।
জোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভুইঁয়া, কো-চেয়ারম্যান কাজী আবদুুর রাজ্জাক, মাওলানা এমএ লতিফ, প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম, মহাসচিব চৌধুরী মুগীসউদ্দিন মাহমুদ, অতিরিক্ত মহাসচিব মো. জাকির হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা দেলোয়ার হোসেন এই যুক্ত বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, শিক্ষা অধিদফতরের এমপিওভুক্ত স্কেল পরিবর্তন, শাখা খোলার জন্য ঘুষের রেট অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। একজন শিক্ষকের এমপিওভুক্তির জন্য বর্তমানে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করা হচ্ছে বলে শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন।
তারা বলেন, শিক্ষামন্ত্রী দুর্নীতি বন্ধের কথা বললে রেট বাড়িয়ে দেয়া হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী দাম কমানোর কথা বললে যেমন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, তেমনি শিক্ষামন্ত্রী দুর্নীতি বন্ধের কথা বললেও ঘুষের রেট বেড়ে যায়। শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবকে শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তা ও এক শ্রেণীর কর্মচারী কোনো পরোয়া করেন না।

মরিয়ার্টিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও জ্বালানি উপদেষ্টার অপসারণ দাবি

স্টাফ রিপোর্টার

তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা বলেছেন, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সব কূটনীতিক শিষ্টাচারের নিয়ম ভেঙে বাংলাদেশের কয়লা-গ্যাসসম্পদ লুটপাটে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পক্ষে যেভাবে চাপ প্রয়োগ করছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
কমিটির নেতারা জাতীয় সম্পদসহ নীতিনির্ধারণী বিষয়ে অবৈধ হস্তক্ষেপের দায়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও দেশের স্বার্থবিরোধী অবস্থান গ্রহণকারী জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহীর অপসারণ দাবি করেন।
৭ দফা দাবিতে গতকাল নগরীর মুক্তাঙ্গনে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স ও মোর্শেদ আলী, বাসদ নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা সাইফুল হক, ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা রাগিব হাসান মুন্না প্রমুখ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশবাসীর মতামত উপেক্ষা করে বড় পুকুরিয়ায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন হবে আত্মঘাতী। তারা আইন করে খনিজসম্পদ রফতানি নিষিদ্ধ, জাতীয় সম্পদের ওপর শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করাসহ জাতীয় কমিটির ৭ দফা বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।

রেলের তেলচোর সিন্ডিকেট বেপরোয়া : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিদিন গায়েব হচ্ছে হাজার হাজার লিটার তেল

কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়ের তেল চোর সিন্ডিকেট আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাদের। সম্প্রতি ট্রেন থামিয়ে ইঞ্জিন থেকে তেল নামানোর সময় ঝিনাইদহ-৬-এর র্যাব সদস্যরা সুন্দরপুর রেলস্টেশন এলাকা থেকে পিন্টু নামের এক তেল চোরসহ ৮শ’ লিটার ডিজেল আটক করে। আটক পিন্টু একই এলাকার কাঁঠালিয়া সুন্দরপুর গ্রামের মৃত ইউছুপ আলীর ছেলে। এভাবে পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে বিভিন্ন সময় রেলের চোরাই তেল আটক ও একাধিক মামলা হলেও খোদ রেলের নিরাপত্তা বিভাগের সদস্যরা কিছুই জানে না বলে দাবি করেন। প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার তেল ট্রেন ইঞ্জিন থেকে নামিয়ে চোরাইপথে বিক্রি করছে এই সিন্ডিকেট। ফলে রেলওয়েকে প্রতি বছর লোকসান দিতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সংঘবদ্ধ তেল চোর সিন্ডিকেট ঝিনাইদহ জেলার ঝিনাইদহের সুন্দরপুর, চুয়াডাঙ্গা জেলার হালসা, পোড়াদহ, রাজবাড়ীর পাংশা, দৌলতদিয়াঘাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা ও খুলনার বেজেরডাঙ্গা, চেঙ্গুটিয়া এবং যশোরের সিংড়া ও সিঙ্গিয়া রেলস্টেশনসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ১৫টি স্পটে তেল নামিয়ে বিক্রি করছে।
বিশেষ ধরনের পলিব্যাগ ব্যবহার করে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার ডিজেল তেল যাত্রাবাহী চলন্ত ট্রেন থেকে বের করে নিচ্ছে তারা। বিশেষ ধরনের মজবুত এই পলিথিন ব্যাগে ৩০ থেকে ৩৫ লিটার তেল ভরে নির্দিষ্ট স্থানে ট্রেন থেকে ফেলে দেয় দুর্নীতিবাজ চালকরা।
এছাড়া মালবাহী ট্রেনগুলো ফাঁকা মাঠে থামিয়ে তেল নামানো হয়। গত বছরের ১ মার্চ রাতে সুন্দরপুর স্টেশন এলাকায় একটি মালবাহী ট্রেন থামিয়ে চোরেরা সব তেল নামিয়ে নেয়ার পর ওই ইঞ্জিন বিকল হয়ে
যায়। পরে মোবারকগঞ্জ স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস-৭২৫ আপ ট্রেনের ইঞ্জিন খুলে মালগাড়ি সরিয়ে নিলে আড়াই ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। একইভাবে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ট্রেনচালক আইনুল হোসেন ৬৩০৫ নম্বরের ইঞ্জিনসহ একটি মালবাহী ট্রেন মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে কোটচাঁদপুর স্টেশনে পৌঁছার পথে তেল সরিয়েছিল। একইভাবে ২০০৯ সালের ৫ মার্চ ভোরে সুন্দরপুর এলাকায় একটি মালবাহী ট্রেন থামিয়ে তেল নামানোর সময় ট্রেনে থাকা প্রায় দুইশ’ বস্তা চালও লুট হয়। এ ঘটনায় কালীগঞ্জ থানার পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৯০ লিটার তেল ও বেশ কয়েক বস্তা চাল উদ্ধার করে।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুন্দরপুর বাজারে র্যাব-৬-এর একটি দল অভিযান চালিয়ে ৬টি তেল রাখার কন্টেইনারসহ প্রায় ৩শ’ লিটার ডিজেল উদ্ধার করে। একই অভিযোগে ২০০৭ সালে নাটোরের লালপুর থানায় ঈশ্বরদীর মালবাহী ট্রেনের চালক ইউছুপ আলী, ফায়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাবিলদার আবদুর রাজ্জাক, একজন প্রহরী ও গার্ড জিয়াউর রহমানসহ ৫ জনের নামে পুলিশ মামলা করে।
এদিকে ৬ মাস আগে যশোরের সিংয়া রেলস্টেশন এলাকার তেল চোর সিন্ডিকেট প্রধান মুকুলকে র্যাব ট্রেনের তেলসহ আটক করে। এ ঘটনায় খুলনার অভয়নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করে র্যাব। এরপর জামিনে এসে মুকুল ও রবিউলের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট আবারও বেপরোয়াভাবে শুরু করেছে তেল চুরি। রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তা, কর্মচারী, চালকসহ স্থানীয় পুলিশের দুর্নীতিবাজ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত সংঘবদ্ধ দলটি দীর্ঘদিন ধরে তেল চুরি ও বিক্রি করছে। যে কারণে প্রশাসন কখনও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রেলওয়ের একটি সূত্র জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী রেল ইঞ্জিনে খুলনা, ঈশ্বরদী ও পার্বতীপুর তেল ডিপো থেকে প্রতিদিন তেল দেয়া হয়। চলাচলকারী এসব রেল ইঞ্জিনে ৩৫শ’ লিটার তেল ধরে। নিয়ম রয়েছে প্রয়োজন ছাড়া এক লিটার তেল বেশি খরচ হলে তা চালকদের বেতন থেকে কেটে নেয়ার। সূত্রটি আরও জানায়, এতকিছুর পরও সবার চোখে ধুলা দিয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ ডিপো ইনচার্জ চালকদের সঙ্গে আঁতাত করে প্রতিদিন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল চুরির সুযোগ করে দিচ্ছে।
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর থানার ওসি মামুনুর রশিদ জানান, আমার এলাকায় কোথাও তেল চুরি হয় না। যদি হয়ে থাকে তাহলে সেটা রেলওয়ে পুলিশের ব্যাপার। আমাদের করার কিছু নেই। রেলওয়ে নিরাপত্তা পুলিশের চিফ ইন্সপেক্টর (খুলনা অঞ্চল) শহীদ জানান, ট্রেন ইঞ্জিন থেকে তেল নামানো হয় এটা আমার জানা নেই। তাছাড়া যেসব জায়গায় তেল নামানোর কথা শোনা যাচ্ছে সেখানে আমার কোনো স্থায়ী স্টাফও নেই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখি। প্রয়োজনে লোকজন পাঠিয়ে তেল চুরি বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দুর্নীতি মামলায় হাজী সেলিমের ১৩ বছরের সাজা বাতিল

স্টাফ রিপোর্টার

সম্পদের তথ্য গোপণের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মো. সেলিমের ১৩ বছরের সাজা বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। বিশেষ আদালতে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে হাজী মো. সেলিমের দায়ের করা আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বিচারপতি এমএ হাই ও বিচারপতি মো. আবদুর রাজ্জাকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ৫৯ কোটি ৩৭ লাখ ২৬ হাজার ১৩২ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবে আলম বাদী হয়ে লালবাগ থানায় এ মামলা করেন। পরে বিশেষ আদালত তাকে এ মামলায় ১৩ বছরের সাজা দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর হাইকোর্টে আপিল করলে আদালত রুল জারি করেন এবং তাকে জামিন দেন। গতকাল রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে তার সাজা বাতিল করা হয়। দুদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট এম আজিজ খান ও হাজী সেলিমের পক্ষে অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার শুনানিতে অংশ নেন।

জমিতে অবৈধ স্থাপনা, অফিসে ঘুষ : শিবচরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ



শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি

মাদারীপুরের শিবচর অংশে পদ্মা সেতুর অধিগ্রহণকৃত এলাকায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি এবং ডিসি কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষগ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে গতকাল বিকালে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন এলাকাবাসী। এক ঘণ্টার এ অবরোধে যোগাযোগ সচিবের গাড়িসহ দক্ষিণাঞ্চলের দুইশ’রও বেশি যানবাহন আটকে পড়ে। অবরোধকারীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলএ শাখার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করার দাবি জানান। এর ব্যত্যয় হলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেন তারা।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অবরোধকারীরা জানান, সম্প্র্রতি পদ্মা সেতুর বেড়িবাঁধের শিবচর অংশে ১২০ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর মাদবরচর ইউপি চেয়ারম্যান রাজ্জাক মোল্লা ও দানেশ মোল্লাসহ একটি চক্র অধিগৃহীত অংশে শত শত অবৈধ নতুন ঘরবাড়ি স্থাপন করে। এছাড়াও এরই মধ্যে অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণ দেয়ার সময় ক্ষতিগ্রস্তদের মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলএ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অনিয়মের প্রতিবাদে গতকাল বিকাল ৫টায় উপজেলার মাদবরচর ইউনিয়নের দুই সহস্রাধিক মানুষ মহাসড়কের পাচ্চর স্ট্যান্ড এলাকায় অবরোধ করেন। এসময় সড়ক ও যোগাযোগ সচিব মো. মোজাম্মেল হক অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। স্থানীয় জনগণ আটকেপড়া সচিবের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয় তুলে ধরেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর শিবচর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মিজানুর রহমান ও হাইওয়ে সার্জেন্ট আসাদুজ্জামানের আশ্বাসের ভিত্তিতে স্থানীয়রা অবরোধ তুলে নেন। ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করে বলেন, ‘ডিসি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্তদের চেকপ্রতি শতকরা ১০-১৫ ভাগ টাকা অগ্রিম ঘুষ নেয়। তাই আমরা জেলা প্রশাসকের অপসারণসহ সার্ভেয়ার ফিরোজ আহমেদ, মহিউদ্দিন, ট্রেচার আক্কাস মিয়া, অফিস সহকারী জসিমউদ্দিন, কানুনগো আবদুল জব্বার, চেইনম্যান মানিক সরদার, পিওন শাজাহান সরদারসহ দোষীদের অনতিবিলম্বে বদলি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মিছিল ও অবরোধ করছি।’
ফজলু মুন্সী বলেন, পদ্মা সেতুতে আমরা সর্বস্ব হারিয়েছি। তারপরও আমরা সেতু চাই। কিন্তু ডিসি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি চক্র সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছে।
যোগাযোগ সচিব মো. মোজাম্মেল হক এসময় সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি আমার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নয়। এরপরও আমি পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্টদের জানাব।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, অধিগ্রহণকৃত এলাকায় অবৈধভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণের বিষয়টি আমিও জেনেছি। এরই মধ্যে ওই এলাকায় সতর্কতামূলক সভা করা হয়েছে। তদন্তসাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা নেব।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক শশী কুমার সিংহের মোবাইলে (০১৭২৬৬০৪২২২) বারবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি

স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও প্রশাসনের সমঝোতায় টেন্ডারবাজি : অ্যানথ্রাক্সের টিকার কাজ পাচ্ছে ৩য় সর্বনিম্ন দরদাতা

মাহবুবুর রহমান

এবার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের সঙ্গে জোট বেঁধে প্রশাসনের কর্মকর্তারাও টেন্ডার-সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়েছেন। সর্বনিম্ন দরদাতার প্রতিযোগিতায় তিন-চার নম্বরে থাকা সত্ত্বেও সমঝোতার মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের কোম্পানিকে একের পর এক কাজ দিচ্ছে সরকারের প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। স্পর্শকাতর ‘অ্যানথ্রাক্স রোগে’র টিকা উত্পাদনের কেমিক্যাল ও মালামাল ক্রয়ের কাজও দেয়া হচ্ছে ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামের এক কোম্পানিকে। আর এ কোম্পানিটির পরিচালনায় রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা। প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক আশরাফ আলীর সঙ্গে সমঝোতা করে তারা এসব কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) জমা পড়েছে।
এদিকে মহাপরিচালকের নির্দেশনা অনুযায়ী তথ্য ফাঁকি দিয়ে মূল্যায়ন না করায় প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তাকে ঢাকা থেকে বদলি করে শাস্তিমূলক পোস্টিং দেয়া হয়েছে। ‘অ্যানথ্রাক্স রোগে’র টিকা উত্পাদনের কেমিক্যাল ও মালামাল ক্রয়ের কাজের টেন্ডারের মূল্যায়ন রিপোর্ট স্থগিত করে তা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে অ্যানথ্রাক্স টিকা উত্পাদন শাখা থেকে ২০১০-১১ অর্থবছরে কেমিক্যাল ও আনুষঙ্গিক মালামাল ক্রয়ের জন্য ওপেন টেন্ডারিং পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ বিষয়ে গত ১০ অক্টোবর দৈনিক ভোরের কাগজ ও ৯ অক্টোবর দ্য ডেইলি নিউ নেশন পত্রিকায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। ৬ নভেম্বর কালের কণ্ঠ, ৮ নভেম্বর দ্য ডেইলি স্টার এবং ১৪ অক্টোবর সিপিটিইউ ওয়েবসাইটেও টেন্ডার বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়। দুটি প্যাকেজে উল্লিখিত মালামাল ক্রয়ের নিমিত্তে প্রাপ্ত দরপত্রগুলো গত ২৯ নভেম্বর খোলা হয়।
প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান গঠিত মূল্যায়ন কমিটি এসব দরপত্র মূল্যায়ন করে গত ২৩ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়। দরপত্র মূল্যায়ন রিপোর্টে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় আশা সায়েন্টিফিক কোম্পানি। এ প্রতিষ্ঠানটি ৭৪ লাখ ৭০ হাজার টাকায় উল্লিখিত কেমিক্যাল ও প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয়ের কথা দরপত্রে উল্লেখ করে। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয় সায়মন এন্টারপ্রাইজ। এ কোম্পানি ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় উল্লিখিত মালামাল সরবরাহের প্রস্তাব দেয়। ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকার প্রস্তাবনা দিয়ে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউজ এবং ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড।
মূল্যায়ন কমিটি সূত্র জানায়, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শুরু থেকেই ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডকে সর্বনিম্ন দরদাতা উল্লেখ করে মূল্যায়ন রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশনা দেন। সর্বনিম্ন অন্য তিনটি কোম্পানির আবেদনে ত্রুটি দেখিয়ে তা বাতিল করতে মৌখিক নির্দেশ দেন তিনি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা, মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. সুলতানা শাহানা বানু, ডা. মো. আবু বকর সিদ্দিক, ডা. মো. রফিকুল ইসলাম ও ডা. হুজ্জত উল্যাহ এ বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু তথ্য ফাঁকি দিয়ে দরপত্র মূল্যায়নে বাদ সাধেন দু-তিনজন সদস্য। সর্বশেষ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন শেষে ২৩ ডিসেম্বর মূল্যায়ন কমিটি রিপোর্ট দেয়।
নির্দেশনা অনুযায়ী মূল্যায়ন রিপোর্ট না পেয়ে ক্ষেপে যান প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফ আলী। তিনি বিষয়টি নিয়ে ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের প্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দফতর সম্পাদক সালেহ মো. টুটুলের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং একজন কর্মকর্তাকে বদলির ব্যবস্থা করেন। ঢাকা থেকে তাকে কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। আরও দু-তিনজন কর্মকর্তাকে বদলির হুমকি দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।
সর্বনিম্ন দরদাতার বিচারে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডকে কাজ দিতে চান আশরাফ আলী। এজন্য দরপত্র মূল্যায়নের রিপোর্ট তদন্তের জন্য তিনি গত ২৭ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তিন সদস্যের এ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে তেজগাঁও পোলট্রি ফার্মের উপ-পরিচালক রবার্ট ডিক্লোজকে। অন্য দুই সদস্য হলেন অতিরিক্ত ইন্সট্রাক্টর স্বপন কুমার ও স্টোরকিপার সাইদুর রহমান। তদন্তের বিষয়ে কমিটির সভাপতি রবার্ট ডিক্লোজ বলেন, ‘দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কর্মপ্রক্রিয়া ঠিকভাবে হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা ২৯ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছি। কাজ চলছে। চলতি সপ্তাহেই রিপোর্ট জমা দিতে পারব।’ প্রাথমিক তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দরপত্রের তথ্য নিয়ে আমাদের কোনো কাজ করতে বলা হয়নি, কেবল মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হবে।’
প্রসঙ্গত, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্পর্শকাতর টিকা, খাদ্যসহ বিভিন্ন কাজ অবৈধভাবে সরকারি দলের নেতাদের কোম্পানিকে দেয়ার অভিযোগ গত দেড় বছর ধরে একাধিকবার উঠেছে। বিশেষ করে, ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড কোম্পানির অন্যতম স্বত্বাধিকারী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দফতর সম্পাদক সালেহ মো. টুটুলসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক নেতা প্রতিনিয়ত প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে আসা-যাওয়া করেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ না করলে কর্মকর্তাদের বদলির হুমকিও দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান মহাপরিচালক আশরাফ আলীর চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়ার শর্তে কাজ পাচ্ছে তার কোম্পানি।
কয়েক মাস আগে সাভারে পশুখাদ্য সরবরাহের একটি কাজ দেয়া হয়েছিল ম্যাস কনসোর্টিয়াম কোম্পানিকে। সেখানে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা হয়। পরে স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তে টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত হলে তিনজন কর্মকর্তাকে ঢাকার বাইরে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। এসব বিষয় তুলে ধরে নাম প্রকাশ না করে সম্প্রতি দুদকেও ‘প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মর্যাদা রক্ষা করুন’ শিরোনামে একটি আবেদন পাঠানো হয়েছে।
এসব বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সালেহ মো. টুটুল বলেন, ‘মহাখালী প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে ঘুরে-ফিরে একটি চক্র কাজ করছে। চলতি দরপত্রে আমরাও প্রতিযোগিতায় আছি। প্রশাসন টেন্ডার সিন্ডিকেট ভাঙতে চাচ্ছে। এজন্য তদন্ত কমিটি হয়েছে বলে শুনেছি। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’
প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফ আলীর মোবাইলে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার মহাখালী অফিসের ফোনে দুবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।