খয়রাতি প্রকল্পের ৭ লাখ ৮০ হাজার ভিজিডি কার্ডে ভাগ বসিয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ভাগ্যের জোরে বিধবা আর স্বামী পরিত্যক্তদের স্থানে তালিকায় নাম উঠে আসছে আওয়ামী লীগ নেতার শালা, শালি, বেয়াই, বেয়াইন, শ্বশুর শাশুড়ি, ভাই, বোন, ভাগ্নেদের। প্রাপ্যদের ভিজিডি কার্ড না দেয়ায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এদিকে ভিজিডি প্রকল্পের তালিকা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দিয়ে তৈরি করায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। টাকার বিনিময়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সর্বত্র। কোথাও আবার তালিকা ও পাল্টা তালিকা জমা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাও। বরিশালের হিজলা উপজেলার গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রাশিদা বেগম। স্বামী (মন্টু কবিরাজ) মারা গেছেন অনেক দিন আগে। ৭ ছেলেমেয়ে নিয়ে রাস্তার পাশে ঝুপড়িঘরে বসবাস করেন রাশিদা। সংসার চলে অন্যের বাসায় কাজ করে। একই ওয়ার্ডের রহিমা বেগম (স্বামী মৃত দুলাল সরদার) থাকেন খড়ের ঘরে। জীবিকা নির্বাহ করেন ভিক্ষা করে। অথচ ইউনিয়নে যে ভিজিডির তালিকা হয়েছে সেখানে তাদের কারোরই নাম নেই। ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রহিম হাওলাদার বলেন, এবার তালিকা আমাদের করতে দেয়া হয়নি। যারা ক্ষমতায় আছেন তারা ইচ্ছামত তালিকা তৈরি করেছেন। আমরা তালিকা করলে রহিমাদের মতো অসহায়দের নাম বাদ পড়ত না। ভিজিডির নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে, স্বামী পরিত্যক্ত, বিধবা, যারা ভিক্ষা করে সংসার চালান, স্বামী পঙ্গু এমন মহিলারা ভিজিডির আওতায় আসবেন। এর আগে ভিজিডি প্রকল্পটি ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও এবার সেটি এসেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় এ প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। কার্ডধারীরা দুই বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে পাবেন ৩০ কেজি চাল। এতদিন তালিকা করার দায়িত্ব ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছে থাকলেও নতুন পরিপত্র জারি করে নীতিমালা করা হয়েছে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি হবেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। থাকবেন ২ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি ও একজন এনজিও কর্মী। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক। ওয়ার্ড কমিটিতে সংরক্ষিত মহিলা মেম্বর সভাপতি থাকলেও তালিকা ও টাকার ভাগবাটোয়ারা সবই করছেন ওয়ার্ড নেতারা। মহিলা অধিদফতর সূত্র জানায়, সারাদেশে এ বছর ভিজিডি প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে ৭ লাখ ৮০ হাজার কার্ড। বরাদ্দ করা কার্ডের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৭৮ হাজার ৩৫৪টি, ঢাকা বিভাগে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ লাখ ২ হাজার ৬৫৬টি, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৯৯৮টি এবং খুলনা বিভাগে ৯৬ হাজার ৫৫২টি।
জানা গেছে, কার্ড করার ক্ষেত্রে কোথাও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। টাকা আছে তো কার্ড আছে এমন পরিস্থিতি সর্বত্রই। বিধবা এবং স্বামী পরিত্যক্ত কথাটি উল্লেখ থাকলেও যারা কার্ড পেয়েছেন তাদের কেউই স্বামী ছাড়া নন। গুয়াবাড়ী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে যাদের নাম রয়েছে তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ সভাপতি নুরুল ইসলাম রাড়ীর আত্মীয়। এর মধ্যে আছেন সভাপতির শালা খোকন নলী, ছেলে কাওছার, মিজান, বেয়াই ও শালির নামে একটি করে কার্ড। অথচ ওই এলাকার ভ্যানচালক আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রীর নামটি তালিকায় স্থান পায়নি। একই অবস্থার শিকার হয়েছেন দরিদ্র হাওয়ানুর বেগম। ১নং ওয়ার্ডের রাজ্জাক বেপারীর ২ ছেলে বিদেশে থাকেন, সোনাবালী করেন গাছের ব্যবসা, লুত্ফর রহমান নলীর আছে ২টি টেম্পো, শেকান মল্লিকের সারের ব্যবসা, হিরন সরদার ব্যবসায়ী, মোতালেব সরদার ব্যবসায়ী, ফজলু মল্লিকের আছে অনেক জমি। এতকিছুর পরও তাদের স্ত্রীর নাম আছে ভিজিডির তালিকায়। ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবুল কালাম আজাদ ভুট্টো বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন ২৭৫ জনের নাম এবং ওয়ার্ড কমিটি ২৭৩ জনের নাম পৃথকভাবে জমা দিয়েছেন। অনিয়ম হওয়ায় আমরা (ইউপি সদস্যরা) স্বাক্ষর করিনি। এমন খয়রাতি প্রকল্পে হস্তক্ষেপ থাকলে আমরা প্রয়োজনে আদালত পর্যন্ত যাব। বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নে পাল্টা তালিকা জমা পড়েছে। সংরক্ষিত আসনের মেম্বার পারুল বেগম বলেন, আমি তালিকা তৈরি করে ট্যাগ অফিসারের কাছে জমা দিয়েছি কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে তালিকা করতে বলেছেন। জানতে চাইলে ট্যাগ অফিসার হাফিজুর রহমান বলেন, আমার কাছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও একটি তালিকা দিয়েছেন। ২টি তালিকাই মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। ওই ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডে আ’লীগের নেতা মন্টু সরদারের মা, শালির নাম তালিকায় উঠেছে। রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নে বিধবাদের নাম তালিকায় ওঠেনি। তালিকায় এসেছে আওয়ামী লীগ সভাপতির স্ত্রী আর পুত্রবধূর নাম। ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মৃত সিরাজ হাওলাদারের স্ত্রী জেসমিন, মৃত শাহজাহানের স্ত্রী গোলভানু, মিনারা বেগমের সংসার চলে রীতিমত অন্যের বাসায় কাজ করে, সোনিয়া বেগমের স্বামী রিকশাচালক, হাসিনা বেগম বলতে গেলে ভিক্ষাই করেন। কিন্তু তাদের নাম তালিকায় নেই। অথচ ওই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রব হাওলাদারের স্ত্রী নেহারু বেগম, পুত্রবধূ আসমা বেগমের নাম তালিকায় রয়েছে। একই এলাকার শামিম হাওলাদারের সোনামিয়ার পুল এলাকায় বড় ফার্মেসি, আমিরুল চলে মোটরসাইকেলে, মামুন খন্দকারের অনেক জমিজমা, তারপরও এদের স্ত্রীরা ভিজিডির তালিকায় নাম উঠিয়েছেন। এদিকে ভিজিডি প্রকল্প নিয়ে ২০১০ সালের ২ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট করেছিলেন রংপুর বিভাগের পীরগঞ্জ জেলার মো. মফিজুর রহমান নামে এক ইউপি চেয়ারম্যান। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ জানুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী ও মো. জাহাঙ্গীর হোসাইনের দ্বৈত বেঞ্চ আবেদনকারীর পক্ষে রায় দেন। ভিজিডি প্রকল্পের জন্য নতুন যে নীতিমালা হয়েছে সেটা কেন বাতিল করা হবে না এ মর্মে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। আলাপকালে বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরামের মহাসচিব বুলবুল আহম্মেদ বলেন, আমরা এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি, এমনকি বিশ্ব ব্যাংকেও আবেদন করেছি। তালিকা করার নামে সরকারি লোকজন যে হরিলুট করতে চাইছে সেটা চেয়ারম্যানরা কোনোমতেই মেনে নেবেন না। এরই মধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের করা তালিকায় আমরা কেউ স্বাক্ষর করব না।