আনোয়ার কবির, সখীপুর (টাঙ্গাইল)
প্রজেক্টের ভেতর গিয়ে দেখা যায়, ১১ জন কর্মচারী রয়েছেন। তারা কেউ এ এলাকার নন। প্রকল্পটির ভেতরে অর্ধনির্মিত ৪টি টিনসেড বিল্ডিং, ১টি পুকুর, নামহীন একটি ভিত্তিপ্রস্তর রয়েছে। একটি ভবনের একাংশে মন্টু মিয়াসহ কর্মচারীরা থাকেন। ওই ভবনের ওপরে জাতীয় পতাকা উড়ছিল। একটু পরেই পতাকাটি নামিয়ে ফেলা হয়।
জমির মালিক ও থানা পুলিশের একটি প্রতিবেদন এবং স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার ওয়াসিকহেলা গ্রামের খান মোহাম্মদ হোসেন বিগত জোট সরকারের আমলে ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড ইউনির্ভাসিটি প্রতিষ্ঠার জন্য সখীপুর উপজেলার কালমেঘা গ্রামের আবু আহাম্মদ এবং তার দুই ছেলে আবদুল বারেক ও আবদুল মান্নানের ১৭ একর জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর কেএম হোসেন একর প্রতি ৭ লাখ টাকা হারে ওই তিন জমির মালিকের ১৭ একর জমি কিনবে এই মর্মে ১৫০ টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন। শর্ত ছিল, তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠানের নামে জমি দলিল করে নেবেন এবং জমির মালিকরা ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকবেন। কিছুদিন পর কেএম হোসেন জমির মালিকদের জানান, আমেরিকা, ইরান, আবুধাবি, সৌদিআরবসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে ৫/৭শ’ কোটি টাকা অনুদান পাওয়া যাবে। তবে এর জন্য প্রতিষ্ঠানের ৩০% নির্মাণ কাজ দেখাতে হবে। তার কথামত ওই জমিতে ৪টি টিনসেড বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ ৪০% সম্পন্ন করা হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিল পরিশোধের চাপ দিলে তাদের চেক প্রদান করা হয়। চেকটি ডিজওনার হলে তারা মামলা করেন। ঢাকা জজকোর্টে এ সংক্রান্ত দুটি মামলা রয়েছে।
এক পর্যায়ে কেএম হোসেন নিজেকে বিএনপির প্রথম সারির নেতা দাবি করে জমির মালিকদের স্বাক্ষর করা স্ট্যাম্পে জমির টাকা পরিশোধ করার কথা লিখে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নামে জমি দলিল করে দেয়ার হুমকি দেন। এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে কেএম হোসেন পিছু হটেন। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রতিষ্ঠানটির নাম বদল করে ইন্টারন্যাশনাল রেসিডেন্সিয়াল কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি নাম দেয়া হয়। বিচারপ্রতি হাবিবুর রহমান খানকে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি উদ্বোধন করানো হয়। জমি নিয়ে বিরোধের কারণে কেএম হোসেন পুনরায় প্রতিষ্ঠানটি করতে ব্যর্থ হন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই কেএম হোসেন তৃতীয়বারের মতো প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল রেসিডেন্সিয়াল ক্যাডেট কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটির নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে জমি দখলের চেষ্টা করছেন। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা পরিচয় দিয়ে এই বলে হুমকি দিচ্ছেন যে, সাইনবোর্ড ভাঙলে জমির মালিক ও এলাকাবাসীকে জেল খাটানো হবে।
পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কেএম হোসেন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন জড়িত রয়েছেন বলে এলাকার লোকজনকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
জমিটি নিয়ে মহামান্য হাইকোর্টে একটি মামলা চলছে। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেএম হোসেন দলীয় প্রভাব খাটিয়ে জমি দখলের চেষ্টা করছেন। প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছেন জমির মালিক আ. মান্নান ও আ. বারেককে। নিজের জমি বেহাত হওয়ার পরও এখন তারা প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
আ. মান্নান জানান, তাকে মেরে ফেলার জন্য কয়েকবার সন্ত্রাসী ভাড়া করে আনা হয় কিন্তু তিনি বুঝতে পেরে সরে পড়াতে বেঁচে গেছেন। বিভিন্ন সময় তাকে র্যাব দিয়ে ক্রসফায়ার করানোর ভয় দেখানো হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার নাম করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কেএম হোসেন এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আবু হানিফ মিয়া বলেন, বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন নাম দেয়ায় মনে হচ্ছে প্রতিষ্ঠান নয়, জমি দখলই মূল উদ্দেশ্য। কালমেঘা গ্রামের বাসিন্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কুতুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রথম দিকে মনে হয়েছিল মহত্ উদ্দেশ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠানটি করা হচ্ছে। আসলে কেএম হোসেনের উদ্দেশ্য ভালো নয়। মূলত বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে জমি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে।
জমির মালিক আবদুল মান্নান বলেন, প্রতিষ্ঠান করার নামে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সময় আমাদের জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য বাড়িতে র্যাব-পুলিশ পাঠানো হচ্ছে। কেএম হোসেনসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে তিনি থানায় ডায়েরি করেছেন বলেও জানান।
ওসি মোজাম্মেল হক মামুন বলেন, কেএম হোসেন একজন ভণ্ড, প্রতারক। তিনি অবৈধভাবে জমি দখলের চেষ্টা করছেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
স্থানীয় সংসদ সদস্য কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান বলেন, বিএনপি সরকারের সময় প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করলে আমি পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল রেসিডেন্সিয়াল ক্যাডেট কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি করায় বিষয়টি আমার কাছে গোলমেলে মনে হয়। এজন্য নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। আপনি ওই প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু আমি সম্মতি দেইনি।
ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কেএম হোসেন বলেন, জমির টাকা পরিশোধ করা হলেও মিউটিশন জটিলতায় দলিল করা হয়নি। তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি আমি সরকারকে উপহার দিয়েছি। তিনি আরও জানান, বিচারপতি হাবিবুর রহমান খান, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, স্থানীয় এমপি কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মির্জা আবদুল জলিল, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক কল্যাণ পরিষদের মহাসচিব বিদ্যুত্ চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট সজল আহমেদ এ প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা।