ইলিয়াস খান
অতি দরিদ্রদের ‘কর্মসৃজন প্রকল্প’র এক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। শ্রমিকদের স্থলে নিজেদের নাম ঢুকিয়ে, বেশি সংখ্যক শ্রমিকের জায়গায় হাতেগোনা কয়েকজন দিয়ে কাজ করিয়ে পকেটস্থ করা হচ্ছে এ অর্থ। কাজ না পেয়ে দরিদ্রদের অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়ে পড়ছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্প গ্রহণ করে। এজন্য প্রতি বছর এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১০ সালের বরাদ্দকৃত টাকা লুটপাটের রেশ কাটতে না কাটতেই চলতি বছরের বরাদ্দ এক হাজার কোটি টাকার কাজ শুরু হয়েছে। চলতি মাসের ১০ তারিখ থেকে বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় এ প্রকল্পের কাজ। শুধু দলীয় লোকজন নয়, পকেট ভারী হচ্ছে সরকারি ও ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ।
দেশের ৬৪ জেলার ১৩৩ উপজেলায় এ প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের মোট উপকারভোগীর সংখ্যা ৮ লাখ ৫৫ হাজার। চলতি বছর বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ২০১০ সালে এ বিভাগে বরাদ্দ ছিল ১০০ কোটি টাকা। বরিশাল জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা অফিস সূত্র জানায়, ২০১১ সালে এ জেলায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ১৮ কোটি ৪৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। ভোল জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ভোলা জেলায় বরাদ্দ ৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। এছাড়া বরগুনা জেলায় ৪ কোটি ৫০ লাখ, ঝালকাঠি জেলায় ৩ কোটি, পটুয়াখালী জেলায় ৩ কোটি ৬০ লাখ ৯০ হাজার এবং পিরোজপুর জেলায় ২ কোটি ৬২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এভাবে প্রকল্পভুক্ত সব জেলায়ই নির্দিষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ রয়েছে। সব মিলিয়ে সারাদেশে বরাদ্দের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা।
তালিকায় আছে মাঠে নেই : নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিক সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করে মজুরি পাবেন দৈনিক ১৫০ টাকা। কাজ করবেন ৪০ দিন। নিজের নামে ব্যাংকে একাউন্ট থাকবে। ওই একাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারবেন শ্রমিকরা। তবে সরেজমিন মাঠ পর্যায়ে যে চিত্র পাওয়া গেছে তাতে শ্রমিক নেই বললেই চলে। যদিও হাজিরা
খাতায় শ্রমিকের কোনো অভাব নেই। বরিশাল জেলার সদর উপজেলার ১০ ইউনিয়নে কাজ শুরু হয়েছে ১০ এপ্রিল থেকে। সম্প্রতি কাজ দেখার জন্য সদর উপজেলার জাগুয়া ইউনিয়নে গেলে দেখা যায় ভয়াবহ চিত্র। সকাল সাড়ে ৯টায় ৩নং ওয়ার্ডে গিয়ে ২৮ শ্রমিকের মধ্যে পাওয়া যায় ৯ জনকে। বাকিরা প্যান্ট পরে ঘুরছেন। কেউ নেতা কেউবা আবার আওয়ামী পরিবারের সদস্য হওয়ার সুবাদে কার্ডধারী। ওয়ার্ডের জালাল সরদারের তিন ছেলে যথাক্রমে আলামিন সরদার, জাহিদ সরদার, জামাল সরদার, মুজাহার খানের ছেলে শামিম খান, ইউনিয়নের যুবলীগের সদস্য তারিকুল ইসলাম, গনি হাওলাদারের ছেলে আমিনুল ইসলাম, ইদ্রিস আলী ও তার স্ত্রী মরিয়ম, হোসেন গাজী, আ. হক, হোসেন চাপরাশি, সোহরাব চাপরাশির ছেলে কাশেম চাপরাশি, আমির আলী—এদের সবার নাম তালিকায় আছে অথচ তারা মাঠে নেই। ২৮ জনের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কার্ডধারী ভুয়া। হাজিরা খাতায় সবার উপস্থিতি দেখানো হয়েছে। গত বছরে এ ইউনিয়নে মোট বরাদ্দ ছিল ২১৮টি কার্ড। এ বছর আরও ৭৬টি কার্ড বাড়ানো হয়েছে।
কড়াপুর ইউনিয়নে মোট বরাদ্দ ৬৬৫টি কার্ড। সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ৯টি ওয়ার্ড ঘুরে পাওয়া গেছে মোট ১১৯ শ্রমিক। সকাল ৯.১০ মিনিটের সময় যাওয়া হয় ২নং ওয়ার্ডে। এ ওয়ার্ডে শ্রমিক থাকার কথা ৮৬ জন। বাস্তবে পাওয়া যায় ২৪ জন। সেখানে উপস্থিত ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি কায়কোবাদ রাসেল স্বীকার করলেন তাদের দুর্বলতার বিষয়টিও। তিনি জানান, তালিকায় আমাদের কিছু লোকের নাম আছে সেটা তো দোষের কিছু নয়। এরপর যাওয়া হয় ১নং ওয়ার্ডে। কাজের তদারকিতে আছেন আ’লীগ নেতা আ. গনি। এখানে ৭৬ শ্রমিকের মধ্যে পাওয়া গেল মাত্র ১৪ জনকে। হাজিরা খাতা দেখতে চাইলে অপারগতা প্রকাশ করেন আ. গনি। ৮নং ওয়ার্ডে গিয়ে চোখে পরে ভয়াবহ চিত্র। সেখানে শ্রমিকদের তালিকায় যারা আছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি খোকন, সম্পাদক ফজলুল হক, যুবলীগের সভাপতি কামাল সরদার, সম্পাদক মো. রফিক, যুবলীগ নেতা মন্নান খাঁ, মনিরের নাম শ্রমিকের তালিকায়। এ ওয়ার্ডে মাঠে কাজ করছেন ১২ জন। অন্যান্য ওয়ার্ডে গিয়েও দেখা গেছে একই চিত্র। ২নং ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ২৪ জন ছাড়া কোনো ওয়ার্ডেই ১৪ জনের বেশি শ্রমিক পাওয়া যায়নি। কাশীপুর ইউনিয়নের চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। ৩নং ওয়ার্ডে গিয়ে পাওয়া যায় মাত্র ১১ শ্রমিক। ৬নং ওয়ার্ডে ২৪ জন, ৫নং ওয়ার্ডে ১৯ জন। অথচ এই ইউনিয়নে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৫০০ কার্ড।
গণ্যমান্যরা সবাই আওয়ামী লীগের : কর্মসৃজন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে এবারও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। কোথাও আওয়ামী লীগের বাইরে গণ্যমান্য ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরিশালসহ সব জায়গার পরিস্থিতি একই রকম। সদর উপজেলার রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নের গণ্যমান্য ব্যক্তি মো. আমিনুল ইসলাম টিপু ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্পাদক। অপর গণ্যমান্য মো. আনসার আলী হাওলাদার জেলা কৃষক লীগ নেতা, সমাজসেবী হিসেবে আছেন তাছলিমা বেগম। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মিজানুর রহমানের স্ত্রী। ইমাম মাওলানা মো. মাহফুজ ওলামা লীগ নেতা। জাগুয়া ইউনিয়নে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তালিকায় যারা আছেন তারা হলেন স্কুল শিক্ষক রুস্তম আলী ফরাজী ইউয়িন আওয়ামী লীগের সভাপতি, মো. মনিরুজ্জামান শ্রমিক লীগের সহসভাপতি, মো. নাজমুল হোসেন মনি যুবলীগ সভাপতি। সমাজসেবী মোসা. রেহেনা ইয়াসমিন মহিলা লীগ নেত্রী, ইমাম মাওলানা আ. করিম তালুকদার ওলামা লীগ নেতা। চাঁদপুরা ইউনিয়নে স্কুল শিক্ষক জিএম ফারুক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, গণ্যমান্য মীর বাহাদুর হোসেন কামাল যুবলীগ সভাপতি, মো. সানোয়ার পারভেজ আওয়ামী লীগের সদস্য, সমাজসেবী মাহামুদা বেগম আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুল ইসলামের স্ত্রী এবং ইমাম মাওলানা আনিসুর রহমান ওলামা লীগ সভাপতি। চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের স্কুল শিক্ষক মো. মকবুল আহম্মেদ ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি, সমাজসেবী মোসা. সালমা আক্তার আওয়ামী লীগ সম্পাদক আসাদুজ্জামান লিটনের স্ত্রী, ইমাম সামসুল হক ওলামা লীগ নেতা এবং আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রহমান, ইউনুচ সেরনিয়াবাত গণ্যমান্য ব্যক্তির তালিকায় আছেন। কাশীপুর ইউনিয়নে স্কুল শিক্ষক আবু আহমেদ আল মামুন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, গণ্যমান্য মো. আনিসুল ইসলাম তোতা আওয়ামী লীগের সম্পাদক, আবুল হোসেন নেতা, সমাজসেবী জেসমিন আক্তার মনি মহিলা লীগ নেত্রী। এভাবে প্রত্যেক ইউনিয়নে যে ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি হয়েছে তাতে স্থান পেয়েছেন দলীয় নেতাকর্মী কিংবা তাদের স্ত্রীরা। উল্লেখ্য, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে স্কুল শিক্ষক, মসজিদের ইমামসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের থাকার কথা।
চেয়ারম্যান মেম্বাররা ঠুঁটোজগন্নাথ : এবারে কর্মসৃজন কর্মসূচি বাস্তবায়ন কমিটিতে চেয়ারম্যান মেম্বারদের কোথাও সদস্য পর্যন্ত রাখা হয়নি। ৯ সদস্যের কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও তালিকায় চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ঘর ফাঁকা। ইউনিয়নের উন্নয়নমূলক কাজ অথচ তাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না চেয়ারম্যান, মেম্বাররা। এ বিষয় জানতে চাইলে ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম বরিশাল বিভাগের সভাপতি মো. হোসেন সিকদার বলেন, দুর্নীতি লুটপাট পাকাপোক্তভাবে করার জন্যই আমাদের দূরে রাখা হয়েছে। নির্বাচিত চেয়ারম্যান হয়েও এলাকার কাজে আমাদের কোনো ভূমিকা নেই— এমনটা শুধু দুঃখজনকই নয় লজ্জারও বটে।
ব্যাংক একাউন্টও আ’লীগ নেতাদের নামে : সরকারের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিকের নামে ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। শ্রমিকরা ইচ্ছা করলে প্রতি মাসে কিংবা সপ্তাহ পরপর তাদের টাকা তুলতে পারবেন। কিন্তু দলীয়করণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেই একাউন্টও খোলা হয়েছে আ’লীগ নেতাদের নামে। সত্যতা যাচাইয়ে গতকাল ফোন দেয়া হয় সোনালী ব্যাংক রায়পাশা কড়াপুর শাখায়। ওই ইউনিয়নে অতি দরিদ্রদের জন্য যে হিসাব খোলা হয়েছে (নং-২০০০১০২৭) তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন কমিটির নেতাদের নামে। এমনটা স্বীকার করে ওই ব্যাংকের ম্যানেজার মোতালেব হোসেন বলেন, বিষয়টি আমরা নেতাদের বুঝিয়ে বলেছি। তারা যদি প্রত্যেক শ্রমিকের নামে একাউন্ট না করেন তাহলে টাকা দিয়ে আমরা বিপদে পড়তে রাজি নই। কারণ নিয়ম রয়েছে কেবল শ্রমিকরাই টাকা উঠাতে পারবেন। এখন যদি নেতারা একাউন্ট খোলেন তাহলে তো বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।
সরকারি ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের লুটপাট : প্রত্যেক শ্রমিকের নামে ব্যাংকে একাউন্ট করার কথা থাকলেও তা নেই। একাউন্ট খোলা হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের নামে। বরাদ্দকৃত অর্থ এরাই তুলে থাকেন। এ টাকা তুলতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগিতা নিতে হয়। এজন্য তাদের ঘুষ দিতে হয়। একইভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান একজন সরকারি কর্মকর্তা। কম শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে বেশি শ্রমিকের বরাদ্দ পাস করতে এসব কর্মকর্তার সহযোগিতা নিতে হয়। এজন্য তাদের দিতে হয় বড় অংকের টাকা। একটি সূত্র জানায়, উপজেলা প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তা এ টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন। এভাবেই দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগ আওয়ামী লীগ নেতা, সরকারি ও ব্যাংক কর্মকর্তারা লুটপাট করছেন।
No comments:
Post a Comment