Tuesday, 26 April 2011

ওএমএসে’র চাল কালোবাজারে : ক্ষমতাসীনরা হাতিয়ে নিচ্ছে ভর্তুকির কোটি কোটি টাকা












কাজী জেবেল
নেত্রকোনার মদন উপজেলায় স্থানীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমানের গুদাম থেকে খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) প্রায় দুই হাজার বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়। এসব চাল কালোবাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে রাখা হয় বলে র্যাব জানায়। তিনি ওই এলাকার ওএমএসের ডিলার। এ ঘটনায় সাইদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলার নিকলীতে ওএমএসের চাল কালোবাজারে বিক্রির দায়ে পূর্বগ্রাম বাজারহাটি গ্রামের ডিলার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আল আমিনকে গত ৮ এপ্রিল জরিমানা করা হয়েছে। চট্টগ্রামের বোয়ালমাখালী উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ সেলিমকে চাল কালোবাজারের বিক্রির দায়ে গত ৭ এপ্রিল জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এভাবে প্রায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় খোলাবাজারে বিক্রির জন্য বরাদ্দকৃত চাল কালোবাজারে বিক্রির সময় ধরা পড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলছে। তারা প্রভাবশালী হওয়াতে স্থানীয় প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তাদের মতে, প্রতিদিন কম হলেও শতকরা ১০ ভাগ চাল কালোবাজারে চলে যাচ্ছে। অর্থাত্ দৈনিক এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার কেজি চাল কালোবাজারে যাচ্ছে। এর সিংহভাগ ধরা পড়ে না। যা ধরা পড়ছে তা প্রকৃত পরিমাণের অনেক কম। এসব চাল স্থানীয় বাজারে বেশি দামে বিক্রি হয়। এতে দরিদ্র মানুষের জন্য ওএমএস চালে সরকারের শত শত কোটি টাকা ভর্তুকির অনেকটাই আওয়ামী লীগ নেতাদের পকেটে যাচ্ছে। এসব কাজে খাদ্য অধিদফতর ও স্থানীয় প্রশাসনের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, অবস্থা এমন হয়েছে যে লাভের গুড় পিঁপড়া খাচ্ছে।
খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক কালোবাজারে চাল বিক্রির কথা স্বীকার করে গতকাল আমার দেশকে বলেন, ওএমএস ও ফেয়ার প্রাইসের জন্য বরাদ্দকৃত চাল কালোবাজারে বিক্রি করা ব্যবসায়ীদের এক ধরনের খারাপ প্রবণতা। বাজারে চালের দাম কমে যাওয়ায় ডিলাররা নির্ধারিত চাল প্রতিদিন বিক্রি করতে পারছেন না। উদ্ধৃত চাল অনেকে কালোবাজারে বিক্রি করছেন। এসব রোধ করতে আমরা বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। জেলা ও উপজেলা কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত কমিটি তদারকি করছে। এসব কমিটিতে উপজেলা চেয়ারম্যান ও দলীয় নেতাকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর পরও কালোবাজারি পুরোপুরি বন্ধ করা কঠিন। আমরা সাধ্যমত কালোবাজারি ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। এ বিষয়ে লোকাল কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, ওএমএস ও ফেয়ার প্রাইস কার্ডের মাধ্যমে আগামীতেও কম দামে চাল দেয়া হবে। এখন যারা সরকারি নিয়ম ভেঙে চাল বিক্রি করছে তাদের বাদ দিয়ে তখন নতুন ডিলার নিয়োগ দেয়া হবে।
খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আহমেদ হোসেন খান গতকাল আমার দেশকে বলেন, খোলাবাজারে চাল বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কালোবাজারে চাল বিক্রির প্রবণতা বাড়ছে। আমরা কালোবাজারি বন্ধে কঠোরভাবে মনিটরিং করছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চালের দামের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে খাদ্য মন্ত্রণালয় গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা মহানগরী এবং চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রি শুরু করে। জনপ্রতি ৫ কেজি হারে এ চাল দেয়া হয়। প্রতি কেজি চাল ২৪ টাকা। একই দামে ফেয়ার প্রাইস কার্ডের মাধ্যমে সারাদেশে প্রায় ৬৭ লাখ পরিবারকে চাল দেয়া হচ্ছে। ওএমএস কর্মসূচির আওতায় প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার টন চাল বিক্রির জন্য ডিলারদের দেয়া হয়। গত ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ওএমএসের মাধ্যমে ৪ লাখ ৮৮ হাজার টন এবং ফেয়ার প্রাইস কার্ডের মাধ্যমে ২৩ হাজার টন চাল বিক্রি হয়েছে। এছাড়াও ২২ হাজার ৭০০ টন গম বিক্রি হয়েছে। ৬৬২টি খোলা ট্রাক ও ৭ হাজার ৬০০ জন ডিলার ওএমএসের চাল বিক্রি করেন। এক হিসাবে দেখা গেছে, আগে সংগ্রহ করা এসব চালের অর্থনৈতিক মূল্য প্রতি কেজি ২৭ দশমিক ৮০ টাকা। ডিলারদের দেয়া হচ্ছে ২২ দশমিক ৫০ টাকায়। ডিলাররা ১ দশমিক ৫০ টাকা লাভে তা ২৪ টাকায় বিক্রি করছেন, অর্থাত্ প্রতি কেজিতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ৫ দশমিক ৩০ টাকা। তবে সম্প্রতি সংগৃহীত প্রতি টন চালের দাম পড়েছে ৫০৮ দশমিক ৪০ ডলার। অর্থাত্ প্রতি কেজির দাম কম-বেশি ৩৬ টাকা। এসব চাল বাজারে ছাড়া হলে প্রতি কেজিতে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩ দশমিক ৫০ টাকা।
তৃণমূল পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওএমএস চাল বিক্রির জন্য নিয়োগকৃত ডিলারদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। ক্ষমতাসীন দলে থাকার সুবাদে অনেক অসাধু ডিলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাল ন্যায্যমূল্যে বিক্রি না করে কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রি করছেন। ২৪ টাকা দরের চাল এলাকাভেদে ৩০-৩২ টাকা দরে বিক্রি করেন তারা। এতে স্বল্পআয়ের মানুষ ন্যায্যমূল্যের চাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের বেশি দামে বাজার থেকে চাল কিনতে হচ্ছে। অপরদিকে ক্ষমতাবান এসব ব্যক্তি দলীয় পরিচয় কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছেন। এক্ষেত্রে খাদ্য অধিদফতরের অনেক কর্মকর্তা তাদের সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক ডিলার স্থানীয়ভাবে এত প্রভাবশালী যে স্থানীয় কর্মকর্তারা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে সাহস পান না। নাম গোপন রাখার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, তারা প্রশাসনের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে রাখেন। এ কারণে বাড়তি ঝামেলার আশঙ্কায় সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও কর্মকর্তারা অভিযানে অংশ নিতে অনাগ্রহ দেখান। এছাড়া কালোবাজারের চাল বিক্রির সময় যাতে ধরা না পড়ে সেজন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করের ডিলাররা। তারা খাদ্য অধিদফতরের সিলসংবলিত বস্তা পাল্টিয়ে সাধারণ বস্তায় চাল পরিবহন করে। অনেকে সরকারি গুদাম থেকে চাল নিয়ে দালালদের মাধ্যমে সরাসরি বাজারজাত করে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পরা কয়েকটি ঘটনায় এসব চিত্র দেখা গেছে। কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা আল আমিন এলএসডি খাদ্যগুদাম থেকে ৬ মেট্রিক টন চাল উত্তোলন করার পরই এক মেট্রিক টন চাল দালালদের মাধ্যমে বিক্রি করে দেন। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মজুত পরীক্ষা করে এক মেট্রিক টন চল কম পান। খুলনার খালিশপুরে হাউজিং বাজারের একটি দোকান থেকে ৯২ বস্তা চাল জব্দ করা হয়েছে। দেশের অনেক জায়গা থেকে বিভিন্ন অবস্থায় শত শত বস্তা চাল কালোবাজারের সময় উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ঢাকা মহানগরীর ৫৬ ডিলারের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। সারা দেশে কতটি ডিলার বাতিল এবং কতজনকে জরিমানা বা আটক করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেননি খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা

No comments:

Post a Comment