Tuesday, 16 August 2011

নোয়াখালীতে সরকারি দলের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জমি দখলের হিড়িক



















ইয়াকুব নবী ইমন, সোনাইমুড়ী (নোয়াখালী)
নোয়াখালীতে ক্ষমতাসীন দলের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সরকারি জাগয়া দখলের হিড়িক পড়েছে। প্রকাশ্যে সরকারি কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি দখল হলেও স্থানীয় প্রশাসন রয়েছে একেবারে নীরব। প্রতিবাদ করলে চাকরি হারানোর ভয় থাকে। ফলে সরকারি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী দখলদারদের সঙ্গে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। আর সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।জানা গেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দলের নাম ভাঙিয়ে একটি দখলদার চক্র নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলায় দলীয় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সরকারি জায়গা দখল করছে। তারা আ’লীগ, শ্রকিম লীগ, সেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদসহ দলের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ভূইফোঁড় সংগঠনের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে সরকারি জায়গা দখল করছে। তাদের দখল তালিকায় রয়েছে সরকারি খাস জমি, সড়ক ও জনপথ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদের ও সম্পত্তি। এসব সরকারি জায়গায় প্রথমে খুঁটি দিয়ে দলের বা সংগঠনের জেলা, উপজেলা, শহর নগর ও কলেজ শাখার অফিসের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়। পরে তা দখল করে ঘর নির্মাণ করে অন্যের কাছে পজিশন বিক্রি করা হয়।দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে সরকারি জায়গা সবচেয়ে বেশি দখল হচ্ছে জেলার সোনাইমুড়ী, বেগমগঞ্জ ও সেনবাগে। এরপরই রয়েছে নোয়াখালী সদর, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, চাটখিল ও কবিরহাট উপজেলা।সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল লতিফ দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে জয়াগ বাজারে সরকারি জায়গা দখল করে ভবন নির্মাণ করে। বিষয়টি এলাকাবাসী সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাসিনা বেগম ও এসিল্যান্ডকে জানালেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেননি। চৌমুহনীর চৌরাস্তায় বেগমগঞ্জ উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মামুনুর রশিদ কিরণের নাম ভাঙিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কয়েক কোটি টাকার জায়গা দখল করে রাতারাতি মার্কেট নির্মাণ করছে দখলদার চক্র। বেগমগঞ্জ থানার মাত্র কয়েকশ গজ দূরে প্রকাশ্যে সরকারি জায়গা দখলের ঘটনা ঘটলেও দখল ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ নিয়ে এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এক সময়ের জেএসডি নেতা আবুল খায়ের চৌমুহনীর দক্ষিণ বাজারে সরকারি খাল দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। সাধারণ ব্যবসায়ীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানালেও আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বেগমগঞ্জের কাজিরহাটে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েক নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধু পরিষদ কাজিরহাট আঞ্চলিক অফিস সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ব্যবসায়ী মফিজের বন্দোবস্তের জায়গাটি দখল করে নিয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। চৌমুহনী রেলওয়ে কোয়ার্টারসংলগ্ন সরকারি জলাশয়ের পাড়ে বেগমগঞ্জ থানা শ্রমিক লীগ প্রধান কার্যালয় ও বেগমগঞ্জ থানা, চৌমুহনী পৌর এবং কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে জমি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেনবাগের শ্রমিরমুন্সি বাজারে জেলা আ’লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম মানিক দলীয় সাইনবোর্ডে সংখ্যালঘুদের জায়গা দখল করে নেয়। এ সময় সেনবাগ থানা পুলিশ টহলে থাকলেও তারা সংখ্যালঘুদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এর আগে বেগমগঞ্জ উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ কিরণ দলীয় প্রভাব খাটিয়ে জেলা জাপা সভাপতি সালাহ উদ্দিন আহম্মদের চৌমুহনী-মাইজদী সড়কের পাশের বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে নেয়। এ নিয়ে বর্তমানে আদালতে মামলা চলছে। নোয়াখালীতে একের পর সরকারি খাল, ডোবা, নালা দখল হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে জেলাব্যাপী দেখা দেয় কৃত্রিম বন্যা। নোয়াখালী সওজ’র প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী শ্যামল বাবু জানান, অভিযোগ পেলে আমরা অবিশ্যই ব্যবস্থা নেব। তাছাড়া তাত্ক্ষণিক দখল ঠেকাতে আমাদের যে লোকবল দরকার, তা নেই। নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী হাবিবুর রহমান জানান, খাল আমাদের হলেও খালের পাশের জায়গা জেলা পরিষদের। কেউ পানি প্রবাহের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি।এ ব্যাপারে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি সরকারি সম্পত্তি দখলের কথা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। সহসা দখল উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেয়া হবে

Wednesday, 10 August 2011

সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমি ইজারা নিয়েছেন সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা  জমি কেরুর, লাভের টাকা দলীয় লোকদের পকেটে


















ছবি: প্রথম আলো
কামরুল হাসান ও শাহ আলম | তারিখ: ১১-০৮-২০১১ | ২১৬

দলীয় পরিচয়ের সুবাদে চাকরি হয় কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে। চাকরিতে ঢুকেই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে প্রথম বছর বেনামে ৩৬০ বিঘা জমি ইজারা নেন। এবার নিয়েছেন আরও ১৪১ বিঘা। তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক আবদুল কুদ্দুস। এখন হিজলগাড়ি বাণিজ্যিক খামারের কেরানি। তবে নামমাত্র দরে ইজারা নেওয়া এসব জমি তিনি নিজে আবাদ করেন না। সবই ভাড়া দেন প্রান্তিক চাষিদের কাছে। গত ৩০ জুলাই দুপুরে হিজলগাড়ি খামারে কুদ্দুস নিজের মুখেই বললেন এসব কথা। শুধু কুদ্দুসই নন, তাঁর মতো কেরু অ্যান্ড কোম্পানির অনেক কর্মী এই প্রতিষ্ঠানের জমি ইজারা নিয়ে জমজমাট ব্যবসা ফেঁদেছেন। তবে এসবের কলকাঠি রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। নামে-বেনামে এই নেতা ও কর্মচারীরা নামমাত্র দরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমি ইজারা নিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে তা ভাড়া দিচ্ছেন সাধারণ চাষিদের কাছে। এভাবে তাঁরা কামিয়ে নিচ্ছেন বছরে আড়াই কোটি টাকা। কিন্তু ইজারা নেওয়া জমি ভাড়া দেওয়া বা কারও কাছে হস্তান্তর করা যায় না। এদিকে বছরের পর বছর কাঁচামালের অভাবে লোকসান গুনছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এই অবৈধ ব্যবসার কথা স্বীকার করেছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম আবদার হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কেরু হলো দুর্নীতির আর্কাইভ, অনিয়মের কোনো শেষ নেই। অবশ্য এখন অনিয়ম কিছুটা দূর হয়েছে। কিন্তু এক দিনে সব দূর করা যাবে না।’ কেরু ও এর সম্পদ: চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড একটি ঐতিহ্যবাহী সরকারি প্রতিষ্ঠান। চিনি কারখানা, ডিস্টিলারি কারখানা ও ওষুধ কারখানা—এ তিনটি বিভাগ নিয়ে ১৯৩৮ সালে এ কমপ্লেক্সটি স্থাপিত হয়। তিনটি শাখার মধ্যে ওষুধ কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন ভিনেগার ছাড়া আর কিছু নেই। চিনিকলটি অলাভজনক হয়ে আছে অনেক বছর ধরে। কারখানার খামার বিভাগ সূত্র জানায়, এ প্রতিষ্ঠানের মোট জমির পরিমাণ নয় হাজার ১৬৮ বিঘা (তিন হাজার ৫৫ দশমিক ৮৪ একর)। এর মধ্যে চাষযোগ্য জমি সাত হাজার ৯২ বিঘা। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় অর্ধেক জমি ইজারা এবং অর্ধেক কোম্পানি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চাষ করা হয়। গত বছর ইজারা দেওয়া হয় তিন হাজার ৪৯২ বিঘা। আর এ বছর ইজারা দেওয়া হয়েছে তিন হাজার ৬০০ বিঘা। আগামী বছরের জন্য নতুন করে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ইজারা হয় যে কারণে: বেশি দিন এক জমিতে আখ ভালো হয় না। তাই জমির ভারসাম্য রক্ষায় অন্য ফসল করতে হয়। এ কারণে এসব জমি স্থানীয় চাষিদের কাছে ইজারা দেওয়া হয়। ইজারার মধ্যে যাঁরা ১৮ মাসের জন্য ইজারা নেন, তাঁদের জন্য আখ চাষ বাধ্যতামূলক। আর যাঁরা চার, পাঁচ ও ছয় মাসের জন্য নেন, তাঁরা অন্য ফসল করতে পারেন। শর্তানুসারে মিলের জমিত্রেতামাক, পেঁপে, ভুট্টা ও কলা চাষ করা যায় না। অনিয়ম নেই!: কেরু কোম্পানির জমি ইজারা দেওয়ার আগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তা ছাপাও হয় স্থানীয় পত্রিকায়। সাধারণ বিবেচনায় কোনো অনিয়মই নেই। তবে এ দরপত্রের ব্যাপারে সাধারণ কৃষকেরা কোনো তথ্যই পান না। অভিযোগ আছে, গোপনে এসব ইজারা হয়ে থাকে। তবে মিল কর্তৃপক্ষ গোপন বিজ্ঞপ্তির কথা অস্বীকার করেছে। অস্বীকার করলেও বাস্তবতা হলো, কয়েকজন ক্ষমতাশালী বছরের পর বছর কেরুর কয়েক হাজার বিঘা জমি ইজারা নিয়ে ভোগ করছেন। বিগত চারদলীয় জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভোগ করতেন মূলত কেরু কোম্পানির সিবিএ নেতারা। বর্তমান সরকারের আমলে সিবিএ নেতাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। একজন আল মামুন: সদর উপজেলার ছোট শলুয়া গ্রামের বাসিন্দা ও কেরুর ইক্ষু উন্নয়ন সহকারী (সিডিএ) আবদুল্লাহ আল মামুন এখন সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত বছর তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান এম এ এ এম ট্রেডার্সের নামে নিয়েছেন ৩৪২ বিঘা। এ জমির পুরোটাই তিনি আবার ভাড়া দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর অবৈধ দখল থেকে ১০০ বিঘা জমি উদ্ধার করা হয়েছে। অবৈধ দখলের বিষয়টি চিনি খাদ্য শিল্প সংস্থার তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে বলে সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) নজরুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেরুর কর্মচারী মামুন ২০০৭ সালে সারাবেলা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রথমে তিন বছর মেয়াদে ২৮৫ বিঘা চাষযোগ্য ও ২১০ বিঘা বাগান করার যোগ্য জমি ইজারা নেন। এ জমি তিনি ভাড়া দেন। আর ইজারার বাইরে অনেক জমি দখল করেন। ২০০৮ সালে তিনি মিম এন্টারপ্রাইজের নামে ২১০ বিঘা জমি ইজারা নেন। এ প্রতিষ্ঠানটি তাঁর শ্যালক শামীম আহমেদের নামে। ওই সময় তিনি ৩৩ বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করেন। এ ছাড়া সরকারি জমিতে ভুট্টার চাষ নিষিদ্ধ করা হলেও তিনি পুরো জমি ভুট্টার আবাদের জন্য বিঘাপ্রতি ১০ হাজার টাকায় ভাড়া দেন। কেরুর উপমহাব্যবস্থাপক (খামার) মোহাম্মদ আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চপর্যায়ের একটি দল তদন্ত করে মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মামুন প্রথম আলোকে বলেন, জমি নেওয়ার সময় তিনি কেরুর কর্মচারী ছিলেন না। কর্মচারী হওয়ার পর আর জমি নেননি। জমি অবৈধ দখলে রাখার কথা অস্বীকার করে বলেন, মাপজোকে ভুল হওয়ার কারণে তাঁর শ্যালকের নামে কিছু জমি বেশি ছিল। সে জন্য তিনি বাড়তি টাকাও দিয়েছেন। মূল নিয়ন্ত্রণ কারা করেন: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেরুর জমি ইজারা নিয়ন্ত্রণ করেন চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাংসদ আলি আজগার টগর ও তাঁর লোকজন। সাংসদের অনুপস্থিতিতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত গোলাম ফারুক আরিফ এসব নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সঙ্গে আছেন সাংসদের নিকটাত্মীয় ও দর্শনা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমানসহ দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী। তবে সদর আসনের সাংসদ ছোলাইমান হক জোয়ার্দার সেলুনের লোকজনও এটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। সর্বশেষ গত ২৭ জুলাই দরপত্র জমা দেওয়া নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য দর্শনা, দামুড়হুদা ও চুয়াডাঙ্গায় পৃথক বাক্স রাখা হলেও সেখানে কেউ দরপত্র জমা দিতে পারেন না। দুই সাংসদের লোকজন এসব নিয়ন্ত্রণ করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পরে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দরপত্র জমা করা হয়। কিন্তু অনেকেই আর দরপত্র জমা দিতে পারেনি। সাংসদের ঘনিষ্ঠ গোলাম ফারুক আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন না। তবে সাংসদের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক আছে। এ ব্যাপারে সাংসদ আলী আজগারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি চীন সফরে আছেন। ইজারা পেয়েছেন যাঁরা খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট ইজারা হয়েছে তিন হাজার ৬০০ বিঘা জমি। প্রভাবশালী ৩৮ জন এ জমি ইজারা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাংসদ আলী আজগারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মানিচেঞ্জার ব্যবসায়ী গোলাম ফারুক আরিফ একাই নিয়েছেন তিনটি খামারে ৩১৮ বিঘা। বিঘাপ্রতি তিন হাজার ৩৪৬ টাকা ৫৬ পয়সা দরে তিনি এ জমি ইজারা নেন। এম এম ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয় ১১৫ বিঘা। বিঘাপ্রতি দর মাত্র দুই হাজার ৫০৫ টাকা। জনৈক আবদুর রাজ্জাক নিয়েছেন ৪৬ বিঘা। খালিদ হোসেন নিয়েছেন ১৯ বিঘা। চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান কবির ঘোলদাড়ি বাণিজ্যিক খামারে ৮১ বিঘা জমি এক ফসলের জন্য ইজারা নেন এক হাজার ৬৮৬ টাকা ৮১ পয়সা দরে। যুবলীগের নেতার নামে ওই জমি বরাদ্দ যথাযথ নিয়ম মেনে না দেওয়ার অভিযোগ তোলেন একই খামারের অন্য একজন ইজারাদার। বেগমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত ডিহি গ্রামের আবদুল মান্নান ৩২৭ বিঘা জমি ইজারা নেন। ইজারার জমি তিনি ভাড়া দিয়েছেন বছরে নয় হাজার টাকা বিঘায়। কেরু কোম্পানির চুক্তিভিত্তিক ট্রাক্টরের হেলপার ও বড় শলুয়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম নিজের নামে নিয়েছেন ২৯১ বিঘা। তাঁর ছেলে আবদুল হালিমের নামে নিয়েছেন ১৮ বিঘা। বোয়ালিয়া ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্রের পাহারাদার নেহালপুরের বাসিন্দা মুবারক হোসেন নিয়েছেন ১৯৮ বিঘা। হোগলডাঙ্গার যুবলীগ নেতা শাহীন নিয়েছেন ৯০ বিঘা, তিতুদহের যুবলীগ নেতা আজিজুল হক নিয়েছেন ৬০ বিঘা, সাবেক সিবিএ নেতা ওয়াহিদুর রহমানের ছেলে আলমগীর নিয়েছেন ৫১ বিঘা। আকন্দবাড়ি খামারের কেরানি দর্শনার বাসিন্দা বাবলুর রশিদ ইজারা নিয়েছেন ১১৭ বিঘা। আলমডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা বেলু চৌধুরী নিয়েছেন ১৮৯ বিঘা। প্রথম আলোকে তিনি জানান, এ জমি তিনি চাষিদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। কিছু জমি তাঁর ভাইয়েরা আবাদও করেছেন।

Friday, 5 August 2011

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের দুর্নীতিবাজরা বেপরোয়া : ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা : গণধোলাই

রিয়াজ চৌধুরী
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) দুর্নীতিবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী ঘুষের ৫ লাখ টাকা ফেরত দিয়ে রক্ষা পেলেও সংস্থার সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) বিজয় কুমার ঘোষ গণধোলাই থেকে রেহাই পাননি। বেদম মার খেয়ে সোজা হয়ে হাঁটাই এখন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে না পেরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতেই তিনিই সুখবোধ করছেন বলে জানা গেছে।
ইইডি সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার বেলা ১টায় নিজ দফতরে ঘুষ নিতে গিয়ে সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তার হাতে ধরা পড়েন বিজয় কুমার ঘোষ। এসময় গণধোলাইয়ের শিকার হন তিনি। পরে সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিস্থিতি সামাল দেন। জানা যায়, সম্প্রতি ৩৬ সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। তাদের আবার ঢাকায় আনতে জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা (অগ্রিম ১৫ হাজার ছাড়াও কাজ শেষে ১৫ হাজার) ঘুষ দাবি করেন বিজয় কুমার ঘোষ। এদের একজনের কাছ থেকে অগ্রিম ১৫ হাজার টাকা নিতে গিয়ে অন্য কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়েন তিনি। এর পরই শুরু হয় গণধোলাই। ধোলাই থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি পালানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে কোনো ফায়দা হয়নি।
এর আগে গত জুন মাসে সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী মিজানুল করিম এক ব্যক্তির কাছ থেকে নেয়া ঘুষ ৫ লাখ টাকা ফেরত দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মিজানুল করিম এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেন। পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ পাইয়ে দেয়ার নাম করে তিনি এ টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু লোকটি কাজ না পাওয়ায় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নালিশ করেন। পরে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে ওই ব্যক্তিকে ঘুষের ৫ লাখ টাকা ফেরত দেন তিনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ইইডি’র এ দুই কর্মকর্তাসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, টেন্ডারবাজদের সঙ্গে সখ্য এবং দায়িত্ব পালনে গাফিলতির অসংখ্য অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা বহাল তবিয়বে রয়েছেন। শিক্ষা প্রশাসনের প্রভাবশালী দুই সিন্ডিকেটের সদস্য হওয়ায় সংস্থায় তাদের দাপটের অন্ত নেই। তারা ইইডিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। যারা বেশি দুর্নীতি করতে পারে তাদেরই যোগ্য বলে ধরা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীর পদটি আগামী ২২ আগস্ট শূন্য হচ্ছে। সংস্থার বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মিজানুল করিমের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তৃতীয় বারের মতো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন। এরই মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিতর্কিত চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে মিজানুল করিমকে তৃতীয় বারের মতো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। জানা যায়, মিজানুল করিম ২০০৭ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। পরে প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট তিনি প্রধান প্রকৌশলীর পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ শেষ হলে কিছুদিন ওই পদ শূন্য থাকে। কিন্তু তিনি ওই পদে কাউকে বসতে দেননি। পরে প্রভাবশালীদের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে ২২ আগস্ট আরও একজন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আনেন।
সংস্থার সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) বিজয় কুমার ঘোষের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি গণধোলাইয়ের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, দু’মাস আগে ৩৬ জনকে বদলি করা হয়েছে। তারা বৃহস্পতিবার আমার কাছে এসে দাবি করে, তাদের ঢাকায় আনতে হবে। আমি তাদের বলেছি, প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে। তাদের মধ্যে কয়েকজন আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। তিনি বলেন, আমি কারও কাছ থেকে ঘুষ নেইনি। এটা আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র।
সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী মিজানুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমার দেশকে বলেন, বৃহস্পতিবার আমি অফিসে ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে মিটিং ছিল। সেখানে গিয়েছিলাম। বিজয় কুমারের বিষয়টি নিয়ে আমি এখনও ক্লিয়ার নই। তাছাড়া শুক্রবার ও শনিবার অফিস বন্ধ। রোববারে অফিসে গেলে বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়া যাবে।