ছবি: প্রথম আলোকামরুল হাসান ও শাহ আলম | তারিখ: ১১-০৮-২০১১ | ২১৬
দলীয় পরিচয়ের সুবাদে চাকরি হয় কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে। চাকরিতে ঢুকেই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে প্রথম বছর বেনামে ৩৬০ বিঘা জমি ইজারা নেন। এবার নিয়েছেন আরও ১৪১ বিঘা। তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক আবদুল কুদ্দুস। এখন হিজলগাড়ি বাণিজ্যিক খামারের কেরানি। তবে নামমাত্র দরে ইজারা নেওয়া এসব জমি তিনি নিজে আবাদ করেন না। সবই ভাড়া দেন প্রান্তিক চাষিদের কাছে। গত ৩০ জুলাই দুপুরে হিজলগাড়ি খামারে কুদ্দুস নিজের মুখেই বললেন এসব কথা। শুধু কুদ্দুসই নন, তাঁর মতো কেরু অ্যান্ড কোম্পানির অনেক কর্মী এই প্রতিষ্ঠানের জমি ইজারা নিয়ে জমজমাট ব্যবসা ফেঁদেছেন। তবে এসবের কলকাঠি রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। নামে-বেনামে এই নেতা ও কর্মচারীরা নামমাত্র দরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমি ইজারা নিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে তা ভাড়া দিচ্ছেন সাধারণ চাষিদের কাছে। এভাবে তাঁরা কামিয়ে নিচ্ছেন বছরে আড়াই কোটি টাকা। কিন্তু ইজারা নেওয়া জমি ভাড়া দেওয়া বা কারও কাছে হস্তান্তর করা যায় না। এদিকে বছরের পর বছর কাঁচামালের অভাবে লোকসান গুনছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এই অবৈধ ব্যবসার কথা স্বীকার করেছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম আবদার হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কেরু হলো দুর্নীতির আর্কাইভ, অনিয়মের কোনো শেষ নেই। অবশ্য এখন অনিয়ম কিছুটা দূর হয়েছে। কিন্তু এক দিনে সব দূর করা যাবে না।’ কেরু ও এর সম্পদ: চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড একটি ঐতিহ্যবাহী সরকারি প্রতিষ্ঠান। চিনি কারখানা, ডিস্টিলারি কারখানা ও ওষুধ কারখানা—এ তিনটি বিভাগ নিয়ে ১৯৩৮ সালে এ কমপ্লেক্সটি স্থাপিত হয়। তিনটি শাখার মধ্যে ওষুধ কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন ভিনেগার ছাড়া আর কিছু নেই। চিনিকলটি অলাভজনক হয়ে আছে অনেক বছর ধরে। কারখানার খামার বিভাগ সূত্র জানায়, এ প্রতিষ্ঠানের মোট জমির পরিমাণ নয় হাজার ১৬৮ বিঘা (তিন হাজার ৫৫ দশমিক ৮৪ একর)। এর মধ্যে চাষযোগ্য জমি সাত হাজার ৯২ বিঘা। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় অর্ধেক জমি ইজারা এবং অর্ধেক কোম্পানি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চাষ করা হয়। গত বছর ইজারা দেওয়া হয় তিন হাজার ৪৯২ বিঘা। আর এ বছর ইজারা দেওয়া হয়েছে তিন হাজার ৬০০ বিঘা। আগামী বছরের জন্য নতুন করে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ইজারা হয় যে কারণে: বেশি দিন এক জমিতে আখ ভালো হয় না। তাই জমির ভারসাম্য রক্ষায় অন্য ফসল করতে হয়। এ কারণে এসব জমি স্থানীয় চাষিদের কাছে ইজারা দেওয়া হয়। ইজারার মধ্যে যাঁরা ১৮ মাসের জন্য ইজারা নেন, তাঁদের জন্য আখ চাষ বাধ্যতামূলক। আর যাঁরা চার, পাঁচ ও ছয় মাসের জন্য নেন, তাঁরা অন্য ফসল করতে পারেন। শর্তানুসারে মিলের জমিত্রেতামাক, পেঁপে, ভুট্টা ও কলা চাষ করা যায় না। অনিয়ম নেই!: কেরু কোম্পানির জমি ইজারা দেওয়ার আগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তা ছাপাও হয় স্থানীয় পত্রিকায়। সাধারণ বিবেচনায় কোনো অনিয়মই নেই। তবে এ দরপত্রের ব্যাপারে সাধারণ কৃষকেরা কোনো তথ্যই পান না। অভিযোগ আছে, গোপনে এসব ইজারা হয়ে থাকে। তবে মিল কর্তৃপক্ষ গোপন বিজ্ঞপ্তির কথা অস্বীকার করেছে। অস্বীকার করলেও বাস্তবতা হলো, কয়েকজন ক্ষমতাশালী বছরের পর বছর কেরুর কয়েক হাজার বিঘা জমি ইজারা নিয়ে ভোগ করছেন। বিগত চারদলীয় জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভোগ করতেন মূলত কেরু কোম্পানির সিবিএ নেতারা। বর্তমান সরকারের আমলে সিবিএ নেতাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। একজন আল মামুন: সদর উপজেলার ছোট শলুয়া গ্রামের বাসিন্দা ও কেরুর ইক্ষু উন্নয়ন সহকারী (সিডিএ) আবদুল্লাহ আল মামুন এখন সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত বছর তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান এম এ এ এম ট্রেডার্সের নামে নিয়েছেন ৩৪২ বিঘা। এ জমির পুরোটাই তিনি আবার ভাড়া দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর অবৈধ দখল থেকে ১০০ বিঘা জমি উদ্ধার করা হয়েছে। অবৈধ দখলের বিষয়টি চিনি খাদ্য শিল্প সংস্থার তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে বলে সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) নজরুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেরুর কর্মচারী মামুন ২০০৭ সালে সারাবেলা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রথমে তিন বছর মেয়াদে ২৮৫ বিঘা চাষযোগ্য ও ২১০ বিঘা বাগান করার যোগ্য জমি ইজারা নেন। এ জমি তিনি ভাড়া দেন। আর ইজারার বাইরে অনেক জমি দখল করেন। ২০০৮ সালে তিনি মিম এন্টারপ্রাইজের নামে ২১০ বিঘা জমি ইজারা নেন। এ প্রতিষ্ঠানটি তাঁর শ্যালক শামীম আহমেদের নামে। ওই সময় তিনি ৩৩ বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করেন। এ ছাড়া সরকারি জমিতে ভুট্টার চাষ নিষিদ্ধ করা হলেও তিনি পুরো জমি ভুট্টার আবাদের জন্য বিঘাপ্রতি ১০ হাজার টাকায় ভাড়া দেন। কেরুর উপমহাব্যবস্থাপক (খামার) মোহাম্মদ আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চপর্যায়ের একটি দল তদন্ত করে মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মামুন প্রথম আলোকে বলেন, জমি নেওয়ার সময় তিনি কেরুর কর্মচারী ছিলেন না। কর্মচারী হওয়ার পর আর জমি নেননি। জমি অবৈধ দখলে রাখার কথা অস্বীকার করে বলেন, মাপজোকে ভুল হওয়ার কারণে তাঁর শ্যালকের নামে কিছু জমি বেশি ছিল। সে জন্য তিনি বাড়তি টাকাও দিয়েছেন। মূল নিয়ন্ত্রণ কারা করেন: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেরুর জমি ইজারা নিয়ন্ত্রণ করেন চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাংসদ আলি আজগার টগর ও তাঁর লোকজন। সাংসদের অনুপস্থিতিতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত গোলাম ফারুক আরিফ এসব নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সঙ্গে আছেন সাংসদের নিকটাত্মীয় ও দর্শনা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমানসহ দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী। তবে সদর আসনের সাংসদ ছোলাইমান হক জোয়ার্দার সেলুনের লোকজনও এটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। সর্বশেষ গত ২৭ জুলাই দরপত্র জমা দেওয়া নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য দর্শনা, দামুড়হুদা ও চুয়াডাঙ্গায় পৃথক বাক্স রাখা হলেও সেখানে কেউ দরপত্র জমা দিতে পারেন না। দুই সাংসদের লোকজন এসব নিয়ন্ত্রণ করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পরে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দরপত্র জমা করা হয়। কিন্তু অনেকেই আর দরপত্র জমা দিতে পারেনি। সাংসদের ঘনিষ্ঠ গোলাম ফারুক আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন না। তবে সাংসদের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক আছে। এ ব্যাপারে সাংসদ আলী আজগারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি চীন সফরে আছেন। ইজারা পেয়েছেন যাঁরা খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট ইজারা হয়েছে তিন হাজার ৬০০ বিঘা জমি। প্রভাবশালী ৩৮ জন এ জমি ইজারা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাংসদ আলী আজগারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মানিচেঞ্জার ব্যবসায়ী গোলাম ফারুক আরিফ একাই নিয়েছেন তিনটি খামারে ৩১৮ বিঘা। বিঘাপ্রতি তিন হাজার ৩৪৬ টাকা ৫৬ পয়সা দরে তিনি এ জমি ইজারা নেন। এম এম ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয় ১১৫ বিঘা। বিঘাপ্রতি দর মাত্র দুই হাজার ৫০৫ টাকা। জনৈক আবদুর রাজ্জাক নিয়েছেন ৪৬ বিঘা। খালিদ হোসেন নিয়েছেন ১৯ বিঘা। চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান কবির ঘোলদাড়ি বাণিজ্যিক খামারে ৮১ বিঘা জমি এক ফসলের জন্য ইজারা নেন এক হাজার ৬৮৬ টাকা ৮১ পয়সা দরে। যুবলীগের নেতার নামে ওই জমি বরাদ্দ যথাযথ নিয়ম মেনে না দেওয়ার অভিযোগ তোলেন একই খামারের অন্য একজন ইজারাদার। বেগমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত ডিহি গ্রামের আবদুল মান্নান ৩২৭ বিঘা জমি ইজারা নেন। ইজারার জমি তিনি ভাড়া দিয়েছেন বছরে নয় হাজার টাকা বিঘায়। কেরু কোম্পানির চুক্তিভিত্তিক ট্রাক্টরের হেলপার ও বড় শলুয়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম নিজের নামে নিয়েছেন ২৯১ বিঘা। তাঁর ছেলে আবদুল হালিমের নামে নিয়েছেন ১৮ বিঘা। বোয়ালিয়া ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্রের পাহারাদার নেহালপুরের বাসিন্দা মুবারক হোসেন নিয়েছেন ১৯৮ বিঘা। হোগলডাঙ্গার যুবলীগ নেতা শাহীন নিয়েছেন ৯০ বিঘা, তিতুদহের যুবলীগ নেতা আজিজুল হক নিয়েছেন ৬০ বিঘা, সাবেক সিবিএ নেতা ওয়াহিদুর রহমানের ছেলে আলমগীর নিয়েছেন ৫১ বিঘা। আকন্দবাড়ি খামারের কেরানি দর্শনার বাসিন্দা বাবলুর রশিদ ইজারা নিয়েছেন ১১৭ বিঘা। আলমডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা বেলু চৌধুরী নিয়েছেন ১৮৯ বিঘা। প্রথম আলোকে তিনি জানান, এ জমি তিনি চাষিদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। কিছু জমি তাঁর ভাইয়েরা আবাদও করেছেন।
No comments:
Post a Comment