এম এ নোমান
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে জনবল নিয়োগে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। দলীয় বিবেচনায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়া, এমনকি কোনো ধরনের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বাছবিচার না করে পাইকারি হারে শত শত লোক নিয়োগের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। গ্রামের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত ১৪শ’ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি এখন লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ প্রকল্পে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়োগবিধি অনুসরণ করা হয়নি। নিয়োগের জন্য আবেদন করেননি এমন ব্যক্তিকেও প্রকল্পের কর্মকর্তা হিসেবে শুধু দলীয় যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা দেশের ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি বলে জানান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নিয়োগ জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধানে এরই মধ্যে কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কার্যাবলির কেন্দ্রবিন্দু এবং প্রতিটি গ্রামকে একটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলে ২০০১ সালের ২ জানুয়ারি ২৪৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর আগেই মাঠপর্যায়ে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। ফলে বিগত বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির অভিযোগে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এসে বন্ধ হওয়া এ প্রকল্পটি আবার চালু করে। চার বছর মেয়াদের এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে ৬৪ জেলার ৪৮২ উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। পরে প্রকল্পের জন্য ৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে। একইসঙ্গে এই প্রকল্পের জন্য ৭ হাজার ৩৫৫ জনের জনবল নিয়োগেরও প্রস্তাব করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের আগেই সারা দেশে গণহারে লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়া হয়েছে।
জনবল নিয়োগে জালিয়াতি : প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সারা দেশে উপজেলা সমন্বয়কারী, মাঠসংগঠক ও কম্পিউটার অপারেটর কাম হিসাব সহকারী পদসহ অন্য পদগুলোতে কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই লোকবল নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়। নিয়োগ পাওয়ার জন্য আবেদন করেননি, আবেদন করলেও লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেননি এমন ব্যক্তিরাও শুধু দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পান। জেলা পর্যায় থেকে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ আসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। এসব নিয়োগের সঙ্গে সরকারের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় নিয়োগ অনুমোদনকারী পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের নিয়োগ প্রক্রিয়া বিষয়ে তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। গত ৩ অক্টোবর এ কমিটি প্রকল্পের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠায়।
তদন্তে জালিয়াতি প্রমাণিত : তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্বনির্দেশনা অনুযায়ী একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত উপজেলা সমন্বয়কারী, মাঠসংগঠক ও কম্পিউটার অপারেটর কাম হিসাব সহকারী পদে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থীদের সংরক্ষিত জীবনবৃত্তান্ত, নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষার খাতাপত্র, মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে চূড়ান্ত নিয়োগ তালিকার তুলনা ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এসব কাজ করতে গিয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজনের বিষয়ে খতিয়ে দেখা গেছে যে, তাদের আবেদনপত্র সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে ডকেট হয়ে আসেনি। প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ের রেকর্ডেও তাদের তালিকাভুক্তির কোনো তথ্য নেই। কারও কারও আবেদনের সঙ্গে ফর্ম ক্রয়ের রসিদ সংযুক্ত নেই। লিখিত পরীক্ষার হাজিরায় তাদের স্বাক্ষর নেই। নিয়োগপ্রাপ্তদের কয়েকজনের নাম লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তালিকায় নেই। মৌখিক পরীক্ষার হাজিরায়ও তাদের নাম নেই। মৌখিক পরীক্ষার মূল রেজাল্ট শিটে তাদের নাম নেই। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি যেহেতু স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন, সেহেতু প্রকল্পের জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে এত বড় জালিয়াতির বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা দ্বারা তদন্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মহোদয়কে অনুরোধ করা হলো।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, শুরু থেকেই এ প্রকল্পটি নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। প্রকল্পের পুরো টাকায় সরকারের নিজস্ব ফান্ড থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে। ফলে এতে দাতা গোষ্ঠী বা সংস্থাগুলোরও কোনো হস্তক্ষেপ বা তদারকি নেই। এ সুযোগেই পুরো প্রকল্পটি ঘিরে দুর্নীতির আখড়া তৈরি হয়েছে।