Saturday, 29 January 2011

প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে টেন্ডারবাজির রকমফের : সরকার সমর্থকদের কাজ দিতে চলছে, বদলি আর জবরদস্তির পদত্যাগ

মাহাবুবুর রহমান

প্রাণিরোগের গবেষণা ও টিকা উত্পাদনের কাজ করে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ প্রতিষ্ঠানে অ্যানথ্রাক্স, রানিক্ষেত ও খুরারোগের টিকা উত্পাদনের সামগ্রী সরবরাহের তিনটি কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে। স্পর্শকাতর এ তিনটি কাজ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পছন্দের কোম্পানিকে দেয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের দফতর সম্পাদকের মালিকানাধীন ‘ম্যাস কনসোর্টিয়াম লি.’ নামের ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে সেখানে চলছে নীরব টেন্ডার সন্ত্রাস। নিয়ম ভেঙে মহাপরিচালকের নির্দেশনা না মানায় বদলি ও জবরদস্তিমূলক পদত্যাগ করানো হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। পছন্দের প্রতিষ্ঠান কাজ না পাওয়ায় মূল্যায়ন কমিটির রিপোর্ট গ্রহণ না করে তা পাঠানো হচ্ছে পুনর্মূল্যায়নে। কাজ-প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর দু’দফা পেছানো হচ্ছে শিডিউল জমার সময়সীমা। সংশোধনের মাধ্যমে যোগ্যতার শর্তও উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। যোগ্য ও সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানের জমা দেয়া কাগজপত্র ছিঁড়ে গোপন করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অস্ত্রবাজি নয়, এভাবে ক্ষমতাবাজির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে চলছে টেন্ডারবাজির রকমফের। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বদলি ও হয়রানির ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইনস্টিটিউটের দু’জন কর্মকর্তা তাদের নাম প্রকাশ না করতে বারবার অনুরোধ জানান। অবশ্য প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফ আলী এসব অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে বলেন, অধিক স্বচ্ছতা আনার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। সেক্ষেত্রে যে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ পেতে পারে।
সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানির চেয়ে দ্বিগুণ দরদাতা হলেও নানা কৌশলে মহাপরিচালকের নির্দেশনায় ম্যাস কনসোর্টিয়াম লি.কে কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বর্তমানে রানিক্ষেত টিকা শাখার মালামাল কেনার টেন্ডার নিয়ে কর্মকর্তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। এই শাখার গ্লাসওয়ার, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ ও বিবিধ মালামাল কেনার নিমিত্তে গত ২১ নভেম্বর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ২১ ডিসেম্বর টেন্ডারবক্স খোলা হয়। ৫টি কোম্পানি শিডিউল জমা দেয়। জমাকৃত শিডিউলে ইনভেন্ট টেকনোলজি লিমিডেট সর্বনিম্ন দরদাতা সাড়ে ২৮ লাখ ও সাড়ে ২৯ লাখ টাকার প্রস্তাব দেয়। এএসইডিএস ইন্টারন্যাশনাল ৫৪ লাখ ও সাড়ে ৫৭ লাখ টাকা, ম্যাস কনসোর্টিয়াম লি. ৮১ লাখ ৭০ হাজার ও ৮২ লাখ, লিঙ্কার এন্টারপ্রাইজ ৮৪ লাখ ৮০ হাজার ও ৯৪ লাখ ৮০ হাজার এবং বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস ৮৪ লাখ ৯০ হাজার ও ৯৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার প্রস্তাব দেয়।
সূত্র জানায়, শিডিউলগুলো মূল্যায়ন কমিটির হাতে গেলে সর্বনিম্ন দরদাতার প্রতিযোগিতায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা ম্যাস কনসোর্টিয়ামকে কাজ দেয়ার সুপারিশ করার জন্য ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক নির্দেশনা দেন। মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও বাদলটিকা শাখার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুর রশিদ এবং সদস্য পদ থেকে ডা. মো. রফিকুল ইসলাম এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাকে বদলি করার হুমকি দেয়া হয়। অন্যথায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ দেয়া হলে তিনি পদত্যাগ করেন।
পাঁচ সদস্যের মূল্যায়ন কমিটির দুজন পদত্যাগ করলে রানিক্ষেত টিকা শাখার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. বিশ্বনাথ মালাকার গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার পরিচালকের কাছে দেয়া এক চিঠির মাধ্যমে মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও একজন সদস্য নতুন করে নিয়োগ করেন। গত ২ জানুয়ারি (স্মারক নং-রানিক্ষেত/২০১১/০২) চিঠিতে তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালকের মোবাইল ফোনের নির্দেশ অনুসারে ঢাকার ডিএলও মোহাম্মদ আলীকে আহ্বায়ক ও প্ল্যানিং শাখার স্টোর কিপার ডা. মো. সাইদুর রহমানকে সদস্য পদে মূল কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি পুনঃঅনুমোদন এবং পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হল। ওই দিনই এ চিঠি অনুমোদন করে পাল্টা চিঠি পাঠান গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার পরিচালক।
নতুন মূল্যায়ন কমিটি সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানি এনভেন্ট টেকনোলজি লি. এবং দ্বিতীয় অবস্থানের এএসইডিএস ইন্টারন্যাশনালকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দেয়ার অজুহাত দেখিয়ে অযোগ্য করে দেয়। তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও যোগ্য বিবেচনা করে ম্যাস কনসোর্টিয়াম লি.কে কার্যাদেশ দেয়ার জন্য সুপারিশ করে পুনর্গঠিত মূল্যায়ন কমিটি।
প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ অন্য চারটি কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেন, বিজ্ঞপ্তির কপি জমা না দেয়াসহ কিছু অপ্রয়োজনীয় ভুল চিহ্নিত করেছে মূল্যায়ন কমিটি। কিন্তু ম্যাস কনসোর্টিয়াম বিজ্ঞপ্তির গুরুত্বপূর্ণ শর্তই পূরণ করেনি। টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির শর্তে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের ১ কোটি ১০ লাখ টাকার কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। সেখানে ম্যাস কনসোর্টিয়াম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাজের অভিজ্ঞতা জমা দিয়েছে। শর্ত অনুযায়ী দেড় কোটি টাকার লিকুইড অ্যাসেট থাকার ব্যাংক স্টেটমেন্টও এ কোম্পানি জমা দিতে পারেনি। সম্পূর্ণ জবরদস্তিমূলক এ কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
মূূল্যায়ন কমিটির রিপোর্ট দেয়ার পরই গত কয়েকদিন ধরে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অবিলম্বে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে রানীক্ষেত টিকা শাখার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. বিশ্বনাথ মালাকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ওপর নানামুখী চাপ আছে। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
একই কোম্পানিকে খুরা রোগের টিকা শাখার কাজও দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় ৪ কোটি টাকার খুরা রোগের টিকা উত্পাদন সামগ্রী সরবরাহের টেন্ডার শিডিউল জমার তারিখ দু’দফা বাড়ানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত শর্ত ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড পূরণ করতে পারছে না বলে সংশোধন করে শর্ত উঠিয়ে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৪ জানুয়ারি সংশোধনের আদেশ জারি করা হয়। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা কমিয়ে তিন বছর, প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট সামগ্রী সরবরাহের তিন বছরের অভিজ্ঞতা কমিয়ে এক বছর, তালিকাভুক্ত কোম্পানির বাইরেও যে কোনো প্রকৃত উত্পাদন কোম্পানিকে প্রতিযোগিতা করার সুযোগদান এবং লিকুইড মানি দেখানোর ক্ষেত্রে ব্যাংক স্টেটমেন্টের সঙ্গে আয়কর সার্টিফিকেট দেয়ার বিষয়টি তুলে দেয়া হয়েছে।
এদিকে প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে ৬ জানুয়ারি শিডিউল জমার শেষ সময় থাকলেও তা দু’দফায় বাড়িয়ে প্রথমে ১৩ ও এখন ১৯ জানুয়ারি করা হয়েছে।
পছন্দের ও অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে এভাবে শর্ত উঠিয়ে নেয়া এবং দু’দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। অবশ্য এ অভিযোগকে নাকচ করে দিয়ে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. আশরাফ আলী বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ যে কোনো শর্ত উঠিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। অধিকতর স্বচ্ছতা আনতে এমনটি করা হয়েছে।’
এদিকে স্পর্শকাতর ‘অ্যানথ্রাক্স রোগ’-এর টিকা উত্পাদনের কেমিক্যাল ও মালামাল ক্রয়ের কাজও ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড কোম্পানিকে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মূল্যায়ন কমিটির রিপোর্টে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার সুপারিশ করা হলেও তা বাতিল করে দরপত্র পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীন অ্যানথ্রাক্স টিকা উত্পাদন শাখা থেকে ২০১০-১১ অর্থবছরের কেমিক্যাল ও আনুষঙ্গিক মালামাল ক্রয়ের জন্য ওপেন টেন্ডারিং পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গঠিত মূল্যায়ন কমিটি জমাকৃত দরপত্র মূল্যায়ন করে গত ২৩ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়। দরপত্র মূল্যায়ন রিপোর্টে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় আ-শা সায়েন্টিফিক কোং। এ কোম্পানিটি ৭৪ লাখ ৭০ হাজার টাকায় উল্লিখিত কেমিক্যাল ও প্রয়োজনীয় মালামাল কেনার কথা দরপত্রে উল্লেখ করে। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয় সায়মন এন্টারপ্রাইজ। এ কোম্পানিটি ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় উল্লিখিত মালামাল সরবরাহের প্রস্তাব দেয়। ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকার প্রস্তাবনায় দিয়ে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস এবং ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড।
মূল্যায়ন কমিটি সূত্র জানায়, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শুরু থেকেই ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডকে সর্বনিম্ন দরদাতা উল্লেখ করে মূল্যায়ন রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশনা দেন। সর্বনিম্ন অন্য তিনটি কোম্পানির আবেদনে ত্রুটি দেখিয়ে তা বাতিল করতে মৌখিক নির্দেশ দেন তিনি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা, মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. সুলতানা শাহানা বানু, ডা. মো. আবু বকর সিদ্দিক, ডা. মো. রফিকুল ইসলাম ও ডা. হুজ্জত উল্যাহ এ বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা সভায় মিলিত হন। কিন্তু তথ্য ফাঁকি দিয়ে দরপত্র মূল্যায়নে বাদ সাধেন দু’তিন সদস্য। সর্বশেষ নিরপেক্ষ ও বস্তনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন শেষে ২৩ ডিসেম্বর মূল্যায়ন কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়।
নির্দেশনা অনুযায়ী মূল্যায়ন রিপোর্ট না পেয়ে ক্ষেপে যান প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফ আলী। এক কর্মকর্তাকে তিনি ঢাকা থেকে বাঞ্ছারামপুরে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। আরও দু’তিন কর্মকর্তাকে বদলির হুমকি দেয়া হয়।
সর্বনিম্ন দরদাতার বিচারে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডকে কাজ দিতে চান তিনি। এ জন্য দরপত্র মূল্যায়নের রিপোর্ট তদন্তের জন্য তিনি গত ২৭ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে রিপোর্ট জমা দেয়। রিপোর্ট পেয়ে মহাপরিচালক কোনো ধরনের সভা বা আলোচনা ছাড়াই দরপত্র পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

No comments:

Post a Comment