Friday 7 January 2011

স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও প্রশাসনের সমঝোতায় টেন্ডারবাজি : অ্যানথ্রাক্সের টিকার কাজ পাচ্ছে ৩য় সর্বনিম্ন দরদাতা

মাহবুবুর রহমান

এবার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের সঙ্গে জোট বেঁধে প্রশাসনের কর্মকর্তারাও টেন্ডার-সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়েছেন। সর্বনিম্ন দরদাতার প্রতিযোগিতায় তিন-চার নম্বরে থাকা সত্ত্বেও সমঝোতার মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের কোম্পানিকে একের পর এক কাজ দিচ্ছে সরকারের প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। স্পর্শকাতর ‘অ্যানথ্রাক্স রোগে’র টিকা উত্পাদনের কেমিক্যাল ও মালামাল ক্রয়ের কাজও দেয়া হচ্ছে ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামের এক কোম্পানিকে। আর এ কোম্পানিটির পরিচালনায় রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা। প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক আশরাফ আলীর সঙ্গে সমঝোতা করে তারা এসব কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) জমা পড়েছে।
এদিকে মহাপরিচালকের নির্দেশনা অনুযায়ী তথ্য ফাঁকি দিয়ে মূল্যায়ন না করায় প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তাকে ঢাকা থেকে বদলি করে শাস্তিমূলক পোস্টিং দেয়া হয়েছে। ‘অ্যানথ্রাক্স রোগে’র টিকা উত্পাদনের কেমিক্যাল ও মালামাল ক্রয়ের কাজের টেন্ডারের মূল্যায়ন রিপোর্ট স্থগিত করে তা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে অ্যানথ্রাক্স টিকা উত্পাদন শাখা থেকে ২০১০-১১ অর্থবছরে কেমিক্যাল ও আনুষঙ্গিক মালামাল ক্রয়ের জন্য ওপেন টেন্ডারিং পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ বিষয়ে গত ১০ অক্টোবর দৈনিক ভোরের কাগজ ও ৯ অক্টোবর দ্য ডেইলি নিউ নেশন পত্রিকায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। ৬ নভেম্বর কালের কণ্ঠ, ৮ নভেম্বর দ্য ডেইলি স্টার এবং ১৪ অক্টোবর সিপিটিইউ ওয়েবসাইটেও টেন্ডার বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়। দুটি প্যাকেজে উল্লিখিত মালামাল ক্রয়ের নিমিত্তে প্রাপ্ত দরপত্রগুলো গত ২৯ নভেম্বর খোলা হয়।
প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান গঠিত মূল্যায়ন কমিটি এসব দরপত্র মূল্যায়ন করে গত ২৩ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়। দরপত্র মূল্যায়ন রিপোর্টে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় আশা সায়েন্টিফিক কোম্পানি। এ প্রতিষ্ঠানটি ৭৪ লাখ ৭০ হাজার টাকায় উল্লিখিত কেমিক্যাল ও প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয়ের কথা দরপত্রে উল্লেখ করে। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয় সায়মন এন্টারপ্রাইজ। এ কোম্পানি ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় উল্লিখিত মালামাল সরবরাহের প্রস্তাব দেয়। ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকার প্রস্তাবনা দিয়ে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউজ এবং ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড।
মূল্যায়ন কমিটি সূত্র জানায়, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শুরু থেকেই ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডকে সর্বনিম্ন দরদাতা উল্লেখ করে মূল্যায়ন রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশনা দেন। সর্বনিম্ন অন্য তিনটি কোম্পানির আবেদনে ত্রুটি দেখিয়ে তা বাতিল করতে মৌখিক নির্দেশ দেন তিনি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা, মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ডা. সুলতানা শাহানা বানু, ডা. মো. আবু বকর সিদ্দিক, ডা. মো. রফিকুল ইসলাম ও ডা. হুজ্জত উল্যাহ এ বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু তথ্য ফাঁকি দিয়ে দরপত্র মূল্যায়নে বাদ সাধেন দু-তিনজন সদস্য। সর্বশেষ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন শেষে ২৩ ডিসেম্বর মূল্যায়ন কমিটি রিপোর্ট দেয়।
নির্দেশনা অনুযায়ী মূল্যায়ন রিপোর্ট না পেয়ে ক্ষেপে যান প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফ আলী। তিনি বিষয়টি নিয়ে ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের প্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দফতর সম্পাদক সালেহ মো. টুটুলের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং একজন কর্মকর্তাকে বদলির ব্যবস্থা করেন। ঢাকা থেকে তাকে কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। আরও দু-তিনজন কর্মকর্তাকে বদলির হুমকি দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।
সর্বনিম্ন দরদাতার বিচারে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেডকে কাজ দিতে চান আশরাফ আলী। এজন্য দরপত্র মূল্যায়নের রিপোর্ট তদন্তের জন্য তিনি গত ২৭ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তিন সদস্যের এ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে তেজগাঁও পোলট্রি ফার্মের উপ-পরিচালক রবার্ট ডিক্লোজকে। অন্য দুই সদস্য হলেন অতিরিক্ত ইন্সট্রাক্টর স্বপন কুমার ও স্টোরকিপার সাইদুর রহমান। তদন্তের বিষয়ে কমিটির সভাপতি রবার্ট ডিক্লোজ বলেন, ‘দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কর্মপ্রক্রিয়া ঠিকভাবে হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা ২৯ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছি। কাজ চলছে। চলতি সপ্তাহেই রিপোর্ট জমা দিতে পারব।’ প্রাথমিক তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দরপত্রের তথ্য নিয়ে আমাদের কোনো কাজ করতে বলা হয়নি, কেবল মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হবে।’
প্রসঙ্গত, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্পর্শকাতর টিকা, খাদ্যসহ বিভিন্ন কাজ অবৈধভাবে সরকারি দলের নেতাদের কোম্পানিকে দেয়ার অভিযোগ গত দেড় বছর ধরে একাধিকবার উঠেছে। বিশেষ করে, ম্যাস কনসোর্টিয়াম লিমিটেড কোম্পানির অন্যতম স্বত্বাধিকারী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দফতর সম্পাদক সালেহ মো. টুটুলসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক নেতা প্রতিনিয়ত প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে আসা-যাওয়া করেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ না করলে কর্মকর্তাদের বদলির হুমকিও দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান মহাপরিচালক আশরাফ আলীর চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়ার শর্তে কাজ পাচ্ছে তার কোম্পানি।
কয়েক মাস আগে সাভারে পশুখাদ্য সরবরাহের একটি কাজ দেয়া হয়েছিল ম্যাস কনসোর্টিয়াম কোম্পানিকে। সেখানে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা হয়। পরে স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তে টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত হলে তিনজন কর্মকর্তাকে ঢাকার বাইরে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। এসব বিষয় তুলে ধরে নাম প্রকাশ না করে সম্প্রতি দুদকেও ‘প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মর্যাদা রক্ষা করুন’ শিরোনামে একটি আবেদন পাঠানো হয়েছে।
এসব বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সালেহ মো. টুটুল বলেন, ‘মহাখালী প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে ঘুরে-ফিরে একটি চক্র কাজ করছে। চলতি দরপত্রে আমরাও প্রতিযোগিতায় আছি। প্রশাসন টেন্ডার সিন্ডিকেট ভাঙতে চাচ্ছে। এজন্য তদন্ত কমিটি হয়েছে বলে শুনেছি। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’
প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফ আলীর মোবাইলে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার মহাখালী অফিসের ফোনে দুবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

No comments:

Post a Comment