Saturday 29 January 2011

প্রধানমন্ত্রীর কাছে শতাধিক ঠিকাদারের অভিযোগ : যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও জালিয়াতি



জাহিদুল করিম কচি, চট্টগ্রাম

আন্তর্জাতিক ক্রয়ে ব্যাপক দূর্নীতি ও জালিয়াতির ফলে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ রেলওয়ে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত শতাধিক ঠিকাদার প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিতভাবে এসব অভিযোগ জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের দরপত্র আহ্বান, কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন এবং মন্ত্রণালয় পর্যায়ে যাচাই-বাছাই কোনো কিছুতেই সরকারের ক্রয় আইন ও বিধি অনুসরণ করছে না যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব আন্তর্জাতিক দরপত্রই সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপ পদ্ধতিতে আহ্বান করা হয়। অথচ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ) এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলসে (পিপিআর) দরপত্র আহ্বানের স্বীকৃত/অনুসৃত দুটো পদ্ধতি হচ্ছে ‘ওপেন টেন্ডারিং মেথড’ ওটিএম বা উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি এবং ‘টু স্টেজ’ বা দ্বিতীয় পর্যায় পদ্ধতি। পিপিএ’র আন্তর্জাতিক ক্রয় সংক্রান্ত ৩৩ ধারায় সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপ নামের কোনো পদ্ধতি নেই। আর ৩৪ ধারায় রয়েছে টু-স্টেজ বা দ্বিতীয় পর্যায় পদ্ধতি। পিপিএ’র নির্দেশনাগুলো বিস্তারিতভাবে পিপিআর’র ৮৩ ও ৮৪ বিধিতে রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) ওয়েবসাইটে থাকা প্রমিত দরপত্রের ফরমেটেও (স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্ট) আন্তর্জাতিক দরপত্রের ক্ষেত্রে সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপ পদ্ধতি বলে কিছু নেই। এ ফরমেটেই সংবাদপত্রে সব মন্ত্রণালয়ের অসংখ্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় উদ্ভাবিত সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপ পদ্ধতিকে বৈধতা দিতে মন্ত্রিসভা কমিটির জন্য তৈরি প্রস্তাবে সারসংক্ষেপ ক্রয় আইনের অসত্য উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। অনিয়মের জন্য একই সঙ্গে পৃথক দুটি খামে কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এতে পছন্দের প্রতিষ্ঠানের কারিগরি প্রস্তাবকেই কেবল যোগ্য (রেসপনসিভ) এবং অন্যদের (বিশেষ করে যাদের দর কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে) কারিগরি প্রস্তাবকে অযোগ্য (নন রেসপনসিভ) ঘোষণা করে কথিত যোগ্য বা রেসপনসিভ দরদাতাদের আর্থিক প্রস্তাব খুলে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে পাতানো এ প্রক্রিয়ায় পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলোই পর্যায়ক্রমে শত শত কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে।
গত ৫ জানুয়ারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভার আলোচ্যসূচির বাইরে সওজের জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের ৪টি প্যাকেজে ৮৮০ কোটি টাকায় ঠিকাদার ও ২৫ কোটি টাকায় নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব সম্পূরক বিষয় হিসেবে টেবিলে উত্থাপিত ও কোনো আলোচনা ছাড়াই অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়। এজন্য তৈরি সার-সংক্ষেপে নতুন ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কিত ৪টি ক্রয় প্রস্তাব/সার-সংক্ষেপের প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ওয়ান স্টেজ টু ইনভেলাপ পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের নোটিশটি সংযুক্ত করা হয়নি। নয় শতাধিক কোটি টাকার ক্রয় প্রস্তাবের সার-সংক্ষেপ কমিটির সদস্যদের পড়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। সার-সংক্ষেপ তৈরিতে প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কোনো ক্ষেত্রেই নিয়ম নীতিমালা অনুসরণ করছে না।
এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভার আলোচ্যসূচিভুক্ত ৪, ৫, ৬, ৭, ৮নং বিষয়গুলো ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ফরিদপুর ও উত্তরবঙ্গে রেললাইন নির্মাণ সংক্রান্ত। সিপিটিইউ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলাদেশ রেলওয়ের দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে ওপেন টেন্ডারিং মেথড ওটিএম বা উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির উল্লেখ থাকলেও ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রেরিত সার-সংক্ষেপের প্রথম পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপের দরপত্র আহ্বান করার কথা বলা হয়েছে। ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ওই সভায় কয়েকজন সদস্য সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপের বিষয়টি উত্থাপন করলে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা এতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদনের উল্লেখ করে ক্রয় কমিটিকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নেন। যদিও অন্য ৩টি প্রকল্পের সঙ্গে পাচুরিয়া-ফরিদপুর এবং ষোলশহর-দোহাজারী রেললাইনের প্রকল্পের ডিপিপি একনেকের অনুমোদনের আগেই কেবল দরপত্র আহ্বানের অনুমোদন দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, এর আগেও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধু সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ এবং ফাটল মেরামতের দরপত্রসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক দরপত্রেই সিঙ্গেল স্টেজ টু ইনভেলাপে প্রস্তাব আহ্বান করে একই ধরনের অসততার আশ্রয় নিয়ে বেআইনি প্রস্তাব ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে সহায়তাকারী সচিবরা, মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্য সিনিয়র মন্ত্রিরা এবং চূড়ান্ত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষসহ সবাই অনিয়মের মামলার ঝুঁকিতে থাকছেন।
এদিকে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিনিয়োগকারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার সিকদার-কেসিসি জয়েন্টভেঞ্চারকে কারিগরি মূল্যায়নে অযোগ্য ঘোষণা করায় বিনিয়োগকারী নির্বাচন প্রতিযোগিতাহীন হয়ে পড়েছে। সিকদার-কেসিসি কারিগরি প্রস্তাবের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন দাবি করে বলেছে, অন্যায়ভাবে তাদের অযোগ্য দেখানো হয়েছে। তাদের দাবি ইটাল-থাইয়ের কোথাও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা নেই। বিষয়টি হাইকোর্টে শুনানি ও সংসদীয় কমিটিতে পরীক্ষাধীন অবস্থায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাড়াহুড়ো করে ইটাল-থাইয়ের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে। ৮ হাজার কোটি টাকার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দেশের প্রথম পিপিপি প্রকল্প। এ প্রকল্পের ২৭ শতাংশ ব্যয় সরকার বহন করবে। ফলে এ নিয়ে তাড়াহুড়ো করলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়াসহ নানা জটিলতা ও ভবিষ্যত্ পিপিপি প্রকল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। তদুপরি বাংলাদেশ রেলওয়ের কোচ, বগি ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়ম করা হচ্ছে। নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে আগেই বিদেশি স্পেশিফিকেশন দিয়ে দেয়া হচ্ছে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে। যাতে করে অন্যরা দরপত্রে অংশ নিলেও কাজ না পায়।
সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো অভিযোগে বলেন, দরপত্রে অনিয়ম তথা অবৈধ ক্রয় প্রস্তাবগুলো বৈধ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেভাবে আপনার নাম ভাঙ্গিয়ে অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীর মতো ব্যক্তিদেরকে ক্রয় কমিটির বৈঠকে ব্ল্যাক মেইল করছেন তাও অকল্পনীয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গতিহীনতা আর বেআইনি, অস্বচ্ছ ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণে ভবিষ্যতে আপনার সরকারের অনেক সাফল্যে জনগণের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে

No comments:

Post a Comment