Saturday, 8 January 2011

নড়াইলে ১৫ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিল ক্ষমতাসীন নেতারা : টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে দলের ২ এমপি ও ৩ চেয়ারম্যান নিয়ে গঠিত কমিটি

নড়াইল প্রতিনিধি

নড়াইলে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক টেন্ডারবাজির অভিযোগ উঠেছে। নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণে গঠিত হয়েছে ৭ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি। কমিটির সদস্যরা হলেন নড়াইলের এমপিদ্বয়, তিন উপজেলা চেয়ারম্যান, নড়াইল পৌরসভার বর্তমান ও একজন সাবেক মেয়র। স্টিয়ারিং কমিটির তত্ত্বাবধানে গঠন করা হয়েছে ২১ সদস্যের টেন্ডার কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বিশিষ্ট ঠিকাদার মো. আজাহার উদ্দিন। অলিখিত এ কমিটির মাধ্যমে সব ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। কোনো বিভাগে দরপত্র আহ্বান করা হলে শুধু কমিটির মনোনীতদেরই দরপত্র কিনতে দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী মতাদর্শের বাইরের কেউই টেন্ডারে অংশ নিতে পারছেন না। দরপত্র দাখিলের আগে সমঝোতা বৈঠকের মাধ্যমে ভাগ-বাটোয়ারা করা হচ্ছে কাজ। উত্সব কমিউনিটি সেন্টার, সার্কেট হাউস ও রূপগঞ্জ টাউন ক্লাবে এসব ভাগ-বাটোয়ারা ও সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ শীর্ষ ও প্রভাবশালী নেতাকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। দরপত্র ক্রয় ও দাখিল নিয়ন্ত্রণ করার ফলে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা না থাকায় নিজেদের সুবিধামতো দর উঠিয়ে দাখিল করা হচ্ছে দরপত্র। এভাবে এরই মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের সাড়ে ১৫ কোটিরও বেশি টাকার কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এর ফলে সরকারের মোটা অংকের রাজস্ব হারারোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পাধীন বিল চেঞ্চুরি উপ-প্রকল্পে চারটি রেগুলেটর সংস্কার ও ৮.৪ কিলোমিটার খাল সংস্কার কাজে ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত মূলের বিপরীতে ১৫ নভেম্বর টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এতে ১২০টি দরপত্র বিক্রি হলেও প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে গড়ে সাড়ে ৯ শতাংশ অতিরিক্ত দর দিয়ে দাখিল করা হয় মাত্র ২০টি দরপত্র। একই প্রকল্পে গত ১ ডিসেম্বর ১০টি খাল সংস্কার ও রেফারেন্স সেকশন নির্মাণে ৯৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের বিপরীতে দরপত্র আহ্বান করা হলে মাত্র ১৫টি দরপত্র বিক্রি হয় এবং গড়ে ৯ শতাংশ অতিরিক্ত দর দিয়ে দাখিল করা হয় ১১টি দরপত্র। একই প্রকল্পে ৭ গ্রুপে ৫ কোটি ৮ লাখ টাকার খাল পুনঃখনন কাজে গত ২৯ ডিসেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হলে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ অতিরিক্ত মূল্যে ২২টি দরপত্র দাখিল করা হয়। কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত যুবলীগের একটি গ্রুপ এদিন দরপত্র জমা দিতে গেলে যুবলীগ নেতা ছালাম প্রতিপক্ষের হাতে প্রহৃত হন এবং দু’গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ঠিকাদার জানান, এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ২০-২২ শতাংশ নিম্নদর দিয়ে কাজ নেয়ার নজির থাকলেও বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে প্রাক্কলিত মূলের চেয়ে অতিরিক্ত দর দেয়া হচ্ছে। গত ৬ ডিসেম্বর সড়ক বিভাগে ৫৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত মূল্যে রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ কাজে দরপত্র আহ্বান করা হলে ৮৫টি দরপত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে সড়ক বিভাগের বিভিন্ন টেন্ডারে প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত নিম্নদর দেয়া হয়েছে জানিয়ে নড়াইল সড়ক বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী কামরুল শেখ বলেন, এবারে গড়ে ৪ শতাংশ অতিরিক্ত দর দিয়ে ৫ গ্রুপে ১৭টি দরপত্র দাখিল করা হয়েছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মনে করেন তিনি। একই দিনে এলজিইডি’র অধীন ১৯ গ্রুপে জেলার তিন উপজেলায় ৩৬.৫২ কিলোমিটার রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের বিপরীতে দরপত্র আহ্বান করা হলে ১৪৫টি দরপত্র বিক্রি হয় এবং গড়ে প্রায় সমমূল্য দিয়ে প্রতি গ্রুপে গড়ে মাত্র ৪টি দরপত্র দাখিল করা হয়। গত ৩ জানুয়ারি এলজিইডির অধীন ২ গ্রুপ বিটুমিনাস কার্পেটিং দ্বারা রাস্তার উন্নয়নে ২ কোটি সাড়ে ৭ লাখ টাকার কাজের দরপত্র আহ্বান করা হলে ৩৬টি দরপত্র বিক্রি হয় এবং প্রায় সমদর দিয়ে দুই গ্রুপে দাখিল করা হয়েছে ৭টি দরপত্র। এলজিইডি নড়াইল বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী হারুনার রশিদ বলেন, প্রতিযোগিতা থাকলে সাধারণত কেউ সমদর দেয় না। বিষয়টি অস্বাভাবিক।
এর আগে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জেলার তিন উপজেলায় কালভার্ট নির্মাণে প্রতিটিতে ১৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকার বিপরীতে গত ১০ নভেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হলে দরপত্র দাখিল নিয়ন্ত্রণ করে সদর ও কালিয়া উপজেলায় কাজ বাগিয়ে নেয়া হয়। এ ছাড়া লোহাগড়ায় শাসক দলের নেতাকর্মীদের মনোনীত ঠিকাদারকে কাজ না দিয়ে দাখিলকৃত ৩৯টি বৈধ দরদাতার মধ্যে নিয়মানুযায়ী লটারি করা হলে তাদের হাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা লাঞ্ছিত হন।
নড়াইল-২ আসনের এমপি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এসকে আবু বাকের ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণে কোনো স্টিয়ারিং কমিটির কথা জানেন না দাবি করে বলেন, কেউ টেন্ডারবাজি করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments:

Post a Comment