অর্থনৈতিক রিপোর্টার
পুঁজিবাজারে বড় ধরনের দরপতনে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো গতকালও বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ মিছিল ও ভাংচুর চালিয়েছে। বেলা ৩টায় লেনদেন শেষ হওয়ার পর পরই বিনিয়োগকারীরা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ভবনের সামনের সড়ক অবরোধ করে ভাংচুরের ঘটনা ঘটায়। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ করে। এমনকি বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে ঢুকে বিনিয়োগকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে পুলিশ। পুলিশের এমন আচরণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পুলিশের লাঠিচার্জে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে ৬ বিনিয়োগকারীকে আটক করেছে পুলিশ। দেড় ঘণ্টাব্যাপী বিক্ষোভ শেষে বেলা সাড়ে ৪টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। ব্যাপক দরপতনের কারণে গত বুধবারও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল।
গতকাল ঢাকা শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দিয়ে লেনদেন শুরু হলেও ১০ মিনিটের মধ্যেই অধিকাংশ শেয়ারের দরপতনের কারণে সূচকের ব্যাপক পতন ঘটে। পরবর্তী আধঘণ্টার মধ্যেই সূচক আগের দিনের চেয়ে ৫৭ পয়েন্ট কমে যায়।
এরপর সূচক কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও তা খুব একটা স্থায়ী হয়নি। শেয়ারের বিক্রি চাপ বেড়ে যাওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই সূচকে নিম্নমুখী প্রবণতা তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীরা এতে আরও আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে দ্রুত সূচকের পতন ঘটতে থাকে। পলনদেন পশষে আগের দিনের তুলনায় ডিএসই সাধারণ সূচক কমে যায় ২১৩ পয়েন্ট। এ বছরে এটিই সর্বোচ্চ দরপতন। এর আগে ৩ জানুয়ারি ২০৪ পয়েন্টের পতন হয়েছিল। নতুন বছরে এ নিয়ে টানা চারদিনই শেয়ারবাজারের সূচকের পতন হয়েছে। এ সময়ে ডিএসই সাধারণ সূচক কমেছে ৫৭০ পয়েন্ট। অপরদিকে বাজার মূলধন কমে গেছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গতকাল লেনদেনে অংশ নেয়া ২৪৭টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১৬টি ছাড়া বাকি ২৩১টির শেয়ারের দরপতন ঘটে।
এরই মধ্যে গত ৮, ১২ ও ১৯ ডিসেম্বরের দরপতনের কারণে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজির বড় অংশই হারিয়েছেন। এর মধ্যে গত চারদিনের টানা দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় পড়েছেন। অনেকের এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করতে সরকারের জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তা না হলে শেয়ারবাজারে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। দরপতনের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে তারল্য প্রবাহ ব্যাপক হারে কমে গেছে। ৫ ডিসেম্বর শেয়ারবাজারে একদিনে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। এখন লেনদেনের পরিমাণ কমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে মাত্র ৯৬৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। লেনদেনের পরিমাণ গত সাড়ে ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত ১৯ মার্চ ডিএসইতে সর্বনিম্ন ৯৬৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। বাজারে তারল্য প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারল্য প্রবাহ বাড়াতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) মার্জিন লোন সুবিধা ১ঃ১.৫ হারে বাড়ালেও মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো গ্রাহকদের এ হারে ঋণ দিতে পারছে না। তারাও বড় ধরনের তারল্য সঙ্কটে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাজার পরিস্থিতি বিষয়ে বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এলিয়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের এমডি ওয়ালি উল মারুফ মতিন বলেন, পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা উপায়ান্তর না দেখে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। কিন্তু এতে কোনো লাভ নেই। তবে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় সরকারের হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন। সরকার শেয়ার কিনলে বর্তমান সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। দেশের পুঁজিবাজারকে অসম্পূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। বাজার এখনও শুধু ইক্যুয়িটি বেইজড। বন্ড মার্কেট চালু করা যায়নি। ডেরিভেটিভ নেই। এর ফলে বাজারে ঝুঁকি তৈরি হলেও তা থেকে সহজে উত্তরণ সম্ভব হয় না। তিনি বিনিয়োগকারীদের অহেতুক আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এইমস ফার্স্ট বাংলাদেশের এমডি ও বাজার বিশ্লেষক ইয়াওয়ার সাঈদ বলেন, পুঁজিবাজারে এতদিন আইন ভঙ্গ করে অনেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিল। ধারদেনা করেও অনেক বিনিয়োগকারী বাজারে ফ্রেশ টাকা নিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে তাদের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয় করছে। নতুন করে বিনিয়োগও করছে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখনও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না। ফলে বাজারে শেয়ারের চাহিদা অনেকাংশেই কমে গেছে। এ কারণে বিক্রি চাপ বেড়ে যাওয়ায় শেয়ারের দর সংশোধন হচ্ছে। বর্তমানে শেয়ারের দরপতন হলেও এটি অস্বাভাবিক নয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারই অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় বাজারে দর সংশোধন অনেকটাই অনুমিত ছিল এবং তা-ই হচ্ছে। তবে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যারা মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ার কিনেছেন তাদের উদ্বেগের কারণ নেই। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগে তারা লাভবান হবেন।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ব্যাপক দরপতনের পর লেনদেন শেষে গতকাল বেলা ৩টার দিকে বিক্ষোভ শুরু করে বিনিয়োগকারী। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ভবনের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দেয় এবং একটি বাস ও একটি প্রাইভেট কার ভাংচুর করে। পুলিশ বিনিয়োগকারীদের রাস্তা থেকে হটাতে বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ডিএসই ভবনের সামনের মধুমিতা সিনেমা হল ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে ঢুকে এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ করে পুলিশ। ব্রোকারেজ হাউসে অবস্থানরত বিনিয়োগকারীরা পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হন। এর আগে শেয়ারবাজারে দরপতনের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল করলেও পুলিশ কখনো বিনিয়োগকারীদের ওপর এতটা চড়াও হয়নি। কিন্তু গতকাল পুলিশ অনেকটা বেপরোয়া ছিল। পুলিশের এমন ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পুলিশের আঘাতে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। বিক্ষোভ চলাকালে দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিনিয়োগকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ দুটি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। তবে জলকামান আনলেও তা ব্যবহার করা হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ আটজনকে আটক করে। তাদের মধ্যে দুজনকে ছেড়ে দেয়া হলেও ছয়জনকে আটক করে মতিঝিল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারা হলেন—মামুন (২৮), আলী আকবর (৫৫), মোবারক হোসেন (৩০), বাদশা মিয়া (২৮), ফয়সাল আহমেদ (২৪), মাহমুদুল (২৫)
।
No comments:
Post a Comment