শফিকুল ইসলাম জুয়েল, ময়মনসিংহ থেকে ফিরে
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলেছিলেন, তাঁর একটি গরুর খামার আছে। এটিই তাঁর আয়ের একমাত্র উৎস, পরিবারের সদস্যদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। ওই সাক্ষাৎকারে নিজেকে সৎ দাবি করে মতিউর রহমান বলেন, তিনি রিকশা-ভ্যানে চলাফেরায় অভ্যস্ত_এমপি নির্বাচিত হতে পারলে জনগণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন। আর আওয়ামী লীগের এমপি হওয়ার পর আড়াই বছরে তিনি এখন বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক। এক কোটি ২২ লাখ টাকায় কিনেছেন একটি প্রাডো, ৩০ লাখ টাকায় একটি ভঙ্ িওয়াগন গাড়ি। বাড়ির প্রতিটি ঘরে লাগিয়েছেন এসি। ঘরে তুলেছেন এলসিডি টিভিসহ প্রায় ১০ লাখ টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক আসবাবপত্র।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে মতিউর রহমানের ভাই ও আফাজ উদ্দিনের সম্পদের বিবরণ জানতে চাওয়া হয়। আফাজ তাঁর আইনজীবী অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান খোকনের মাধ্যমে দেওয়া হিসাবে বলেন, তাঁর দোচালা টিনের ছোট একটি বাড়ি, ১২টি মুরগি, আটটি হাঁস, ছয়টি ছাগল আছে। নগদ অর্থ নেই। ভাই এমপি হওয়ার পর আফাজ নামে-বেনামে কিনছেন লাখ লাখ টাকার জমি। ঢাকার উত্তরায় প্রায় ৮০ লাখ টাকায় কিনেছেন অত্যাধুনিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। তিনি প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার না করলেও প্রায় সময় অন্তত ১৫ থেকে ২০টি মোটরসাইকেলে মহড়া দিয়ে চলাচল করেন।
একইভাবে এমপির ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর ছেলে মুহিতউর রহমান শান্ত এবং পিএস সাঈদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যাঁরা ভোট দিয়ে মতিউর রহমানকে সংসদে পাঠিয়েছেন, অভিযোগ তুলছেন তাঁরাও। এলাকাবাসী বলছেন এমপি ও তাঁর পরিবারের দুই সদস্যের এই অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার রহস্য হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি, দখল-চাঁদাবাজি এবং টেস্ট রিলিফ (টিআর), কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচির অর্থ লুট।
কাজ না করেই অর্থ পকেটে : গত সপ্তাহে টানা চার দিন ময়মনসিংহ সদর এলাকায় অনুসন্ধান করে ক্ষমতাসীন দলের এমপির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ পাওয়া যায়। এলাকাবাসী বলছে, এমপি, তাঁর ছেলে শান্ত ও ভাই আকুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফাজ উদ্দিন ক্ষমতার ত্রিমুখী অপব্যবহার করছেন। তাঁদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলেও কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। রাস্তা ও ভবন নির্মাণের অধিকাংশ কাজই বাজার দরের দ্বিগুণেরও বেশি মূল্যে হাতিয়েছেন এবং কাজ না করেই অর্থ তুলে আত্মসাৎ করেছেন এমপির ভাই আফাজ উদ্দিন।
'দাপুনিয়া-বাড়েরারপাড় কাঁচা-পাকা রাস্তাটিতে গত আড়াই বছরে এক কোদাল মাটিও পড়েনি। মেরামত হয়নি ভেঙে পড়া ব্রিজগুলো। ফলে রাস্তায় এখন উঁচু-নিচু গর্ত, কোথাও কোথাও হাঁটুপানি আর পিচ্ছিল কাদার ছড়াছড়ি। ফলে গাড়ি দূরের কথা, রিকশা-ভ্যানে চলাচল করা দায়। রাস্তাটির কারণে বাড়েরারপাড় গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ হাসপাতাল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সদরে যেতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়।' কালের কণ্ঠকে বলছিলেন দাপুনিয়া-বাড়েরারপাড় গ্রামের বাসিন্দা ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সাবেক ডেপুটি প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা কবীর আহমেদ।
পরে খোঁজ নিয়ে ও এলজিইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দাপুনিয়ার এ রাস্তাটি সংস্কারের লক্ষ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছরে এলজিইডি ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ১৫ টাকা বরাদ্দ দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমইঅ্যান্ডএমইকে। নির্দেশনা ছিল, ২০০৯ সালে ৯ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে ২০১০ সালে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাস্তাটি সংস্কারের। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাত্র ১৫ শতাংশ কাজ করেই পুরো বিল তুলে নিয়েছে। জানা যায়, ঠিকাদারি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন। তবে মতিনের ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কাজটি নিয়েছিলেন এমপির ভাই আফাজ উদ্দিন।
ময়মনসিংহের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও পরপর তিন বছর জেলার সর্বোচ্চ করদাতার পুরস্কার পাওয়া ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চু ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'সরকার ক্ষমতা নেওয়ার প্রথম দিকে কিছু দরপত্রে অংশ নিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও কাজ পায়নি আমার প্রতিষ্ঠান। প্রতিবাদ করায় এমপির ভাই ও ছেলের সন্ত্রাসীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। বিচারের দাবিতে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও মামলা করতে পারিনি, এমনকি জিডিও নেয়নি পুলিশ। সর্বশেষ নিরুপায় হয়ে ময়মনসিংহের কাজে অংশ নেওয়া ছেড়ে এখন কিশোরগঞ্জ-জামালপুরে প্রতিযোগিতায় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ করছি।'
গত ২৩ আগস্টের এলজিইডির কাজের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএস প্রাইম ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এইড আজামতপুর পূর্বপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন সংস্কারের কাজ পায়। কাজটি ২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারির মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা থাকলেও মাত্র ২৫ শতাংশ কাজ করেই ১৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বারিরা উজানপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন সংস্কারের কাজ সমপরিমাণ অর্থে ও একই সময়ের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা ছিল, কাজ না করেই পুরো টাকা তোলা হয়। একই প্রতিষ্ঠান আকুয়া ফিরোজ লাইব্রেরি মোড় থেকে মাসকান্দা পাড়াইল রাস্তা উন্নয়নের জন্য ১৮ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৮ টাকা তুলে নিলেও কাজ করেছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। এ কাজটি ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর শুরু করে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর শেষ করার নির্দেশনা ছিল। প্রতিষ্ঠানটি আকুয়া নাজির ব্যাপারীর রাস্তার কাজ পেলেও মাত্র ৩৫ শতাংশ শেষ করেই ৩১ লাখ ৯২ হাজার ২৩৩ টাকা তুলে নিয়েছে। এ কাজটি ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর শুরু করে গত বছরের ৮ আগস্ট শেষ করার নির্দেশনা ছিল। এসব কাজ এমপির ভাগ্নে বুলবুলের প্রতিষ্ঠানের নামে হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করেছেন এমপির ভাই আফাজ উদ্দিন।
পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনের মালিকানাধীন এমইঅ্যান্ডএমই প্রতিষ্ঠান সদর উপজেলাধীন দাপুনিয়া বাড়েরারপাড় রাস্তা উন্নয়নের জন্য ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ১৫ টাকা তুলে নিলেও কাজ করেছে মাত্র ১৫ শতাংশ। এ কাজটি ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর শুরু করে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর শেষ করার নির্দেশনা ছিল। একই প্রতিষ্ঠান চোরখাই ভাবখালী পুরাতন বাজার হয়ে ভাবখালী ইউপি সড়ক মেরামতের কাজ নিয়ে মাত্র ৬০ শতাংশ শেষ করেই পুরো বিলের ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিও নিয়ন্ত্রণ করেন আফাজ উদ্দিন।
আফাজ উদ্দিনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সব্যসাচী এন্টারপ্রাইজ এলজিইডির আওতাধীন আইআরআইডিপি প্রজেক্টে ফুলবাড়িয়া রোড থেকে খলপা (আর্মি বাইপাস) পর্যন্ত কার্পেটিংয়ের জন্য কাজ পেয়ে মাত্র ৪০ শতাংশ শেষ করেই ৩৫ লাখ ১৭ হাজার ২১৭ টাকা তুলে নিয়েছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর দেওয়া কাজটি চলতি বছরের ২০ জুলাই শেষ করার নির্দেশনা ছিল। একই প্রতিষ্ঠান একই সময়ে কাজ শেষ করার নির্দেশনা নিয়ে মোড়লপাড়া থেকে চারপাড়া সড়ক সংস্কারের কাজ পায়। কিন্তু মাত্র ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ করেই পুরো বিলের ২৪ লাখ ২৫৭ টাকা তুলে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এলজিইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব প্রকল্পের কাজ বাকি না থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।
সরকারি জমি দখল : ১ দশমিক ১৫ একর খাসজমির দখল নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান একাডেমী (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) এই নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমপি নিজের নামেই প্রতিষ্ঠানটি করেছেন। পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধিত) আইন, ২০১০ লঙ্ঘন করে জলাশয় ভরাটের পর ভবন নির্মাণ করা হয়। এরই মধ্যে জমি বরাদ্দ নেওয়ার প্রায় সাড়ে তিন মাস পার হলেও মূল্য বাবদ ১২ কোটি ৫২ লাখ ৬৬ হাজার চার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি এমপি। অথচ এরই মধ্যে চালু করা হয়েছে স্কুল-কলেজ। ২০০৬ সালে এই জমি শহীদ জিয়াউর রহমান টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের নামে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. তৌফিকুল আজিম ১৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় বরাদ্দ নেন। সেই জমি এখন বর্তমান এমপি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশসহ বিশেষ তদবিরের মাধ্যমে নিজের নামের প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ নেন।
আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ অধ্যক্ষের জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের ১৫ শতাংশ জমির ওপর স্থাপিত বাড়িটিতে ১৯৬৯ সাল থেকেই বসবাস করে আসছেন কলেজটির প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। অথচ ২০০২ সালের ৩০ জুন তিনি কলেজ থেকে অবসর নেন এবং শহরে এমপির নিজস্ব বাড়িও আছে। এদিকে কলেজ ক্যাম্পাসের বাড়ি বরাদ্দ না পেয়ে বর্তমান অধ্যক্ষ এ কে এম আজহারুল ইসলাম এখন থাকেন অন্য স্থানে।
এমপি মতিউর রহমান ও স্ত্রী নুরুন্নাহার শেফালীর নামে আকুয়া মৌজায় ৬৫ শতাংশ অর্পিত সম্পত্তি অবৈধ দখলদারের কাছ থেকে পানির দরে কিনে টিনের বাউন্ডারি দেওয়া হয়েছে। এখন খারিজের চেষ্টা চলছে। কিন্তু অর্পিত সম্পত্তি ব্যক্তি নামে খারিজ করতে রাজি হননি সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তা। ফলে বিষয়টি ঝুলে আছে।
দাপুনিয়া জেলা পরিষদের মালিকানাধীন প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের তিন একর খাসজমি (দাপুনিয়া বাজারসংলগ্ন ফুলবাড়িয়া সড়কঘেঁষা) দখল করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে প্রায় দেড় বছর ধরে দখলে রেখেছেন এমপির ছোট ভাই আফাজ উদ্দিন।
এমপিপুত্র শান্ত নির্বাচনের আগে জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এখন চলেন রাজকীয় ভঙ্গিতে। জানা যায়, ডেঙ্গু ব্যাপারী রোডের প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের ৭ শতাংশ অর্পিত সম্পতি দখলে নিয়ে নিজের নামে দলিল করে নিয়েছেন এমপিপুত্র শান্ত। রামকৃষ্ণ মিশন রোডে জাতীয় পার্টির নেতা এম এ হান্নানের মালিকানাধীন প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের ৮ শতাংশ জমি বিজ্ঞান কলেজের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দখল করে নিয়েছেন শান্ত।
ময়মনসিংহ পৌরসভার কয়লাওয়ালাপাড়ার মোড়ে বাদল ভৌমিকের মালিকানাধীন প্রায় ছয় কোটি টাকা মূল্যের ২০ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছেন এমপিপুত্র। ময়মনসিংহ সদরের ছোট বাজারের ৬৩ শতাংশ অর্পিত সম্পত্তিও দখল করেছেন শান্ত। ব্যক্তিমালিকানাধীন হিসেবে শান্তর নামে রেজিস্ট্রি করা এ জমির দলিলে দুই কোটি টাকার সম্পত্তির দাম ধরা হয়েছে মাত্র ১৫ লাখ টাকা। এটি জেলা প্রশাসন এক বছর ধরে তদন্ত করে যাচ্ছে। গত বছরে বাসাবাড়ি এলাকায় হকার্স মার্কেটের ১৫ শতাংশ জমি দখল করে ১২টি ঘর নির্মাণের পর দোকান হিসেবে প্রতিটি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকায় বিক্রি করেন এমপিপুত্র শান্ত। পরে জেলা প্রশাসনের অভিযানে অবৈধ স্থাপনা হিসেবে সেসব দোকান ভেঙে দেওয়া হয়; যদিও দোকানের মালিকদের কেউই এখনো টাকা ফেরত পাননি, যাঁদের অনেকেই এখন নিঃস্ব।
অভিযোগ উঠেছে, শান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেও জমির দখল নিয়েছেন। এমপির আকুয়া এলাকার বাড়ি যাওয়ার পথে জেলা প্রশাসনের মালিকানাধীন প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের ৫ শতাংশ জমি দখল করে তিনটি বড় ঘর নির্মাণসহ 'প্রতিশ্রুতি ক্রীড়াচক্র' ক্লাবের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন তিনি। এর প্রায় ১০০ গজ দূরে দুই কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ১০ শতাংশ জমি দখল করে ঝোলানো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা একাডেমীর সাইনবোর্ড। মুক্তিযোদ্ধা একাডেমীর ওই অফিসে পর পর তিন দিন ঘুরেও তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
এ ছাড়া সরকারি জমি দখলের চেষ্টায় দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে বাসাবাড়ি এলাকার ২৫ শতাংশ খাসজমি উত্তরণ বহুমুখী সমিতির নামে এবং আরো ২৫ শতাংশ খাসজমি ডিজিটাল বহুমুখী সমবায় সমিতির নামে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
শান্তর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সারিন্দা রেস্টুরেন্টের মালিক সুরুজ্জামানের ছেলে মাকসুদ তাঁদের মালিকানাধীন ব্রিকফিল্ডের পাশের জেলা প্রশাসনের (আকুয়া মৌজা) প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের ৬৬ শতাংশ খাসজমি দখল করে টিনের বাউন্ডারি দিয়ে এখন নিজ নামে রেজিস্ট্রির চেষ্টা করছেন।
দুস্থদের অর্থ লুট : ময়মনসিংহ সদর আসনের নামে গত আড়াই বছরে টিআর, কাবিখা, কাবিটার জন্য বরাদ্দ করা অর্থের বেশির ভাগই আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি কাবিটার ৯০ লাখ টাকা বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে 'ভুয়া প্রতিষ্ঠান' ও 'ম্যানেজড' ব্যক্তির নাম ব্যবহৃত হয়। শোনা যায়, বেশির ভাগ কাজে ৫০ হাজার টাকার চেক দিয়ে ৪০ হাজার টাকা ফেরত নিয়েছেন এমপিপুত্র।
জানা যায়, এমপির নিজের নামে করা কলেজের মাটি ভরাট, স্থাপনা নির্মাণ ও আসবাবপত্র_সবই করা হয়েছে সরকারি টাকায়। এ ক্ষেত্রে অর্থায়ন করা হয়েছে এডিপির বরাদ্দের ৪০ লাখ টাকা এবং এমপির নামে বরাদ্দের টিআরের ২৫ টন চাল ও কাবিখার ৩০ লাখ টাকা।
দাপুনিয়া ইউনিয়নের ডিকে উচ্চ বিদ্যালয়কে কাবিটার বরাদ্দ থেকে দুই দফায় সাড়ে তিন লাখ টাকা দিলেও তা আত্মসাৎ করা হয়। টেলিফোনে জানতে চাইলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রহমান বলেন, 'প্রথম দফায় ৫০ হাজার টাকা পেয়ে কিছু কাজ করেছি। পরের তিন লাখ টাকার খবর আমার জানা নেই।'
কাওয়ালতী নামাপাড়া ফকিরবাড়ী হাফেজিয়া মাদ্রাসার নামে কাবিটার ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পান আওয়ামী লীগ নেতা হারুনূর রশিদ। এর ৪০ হাজার টাকা ফেরত দিতে হয় এমপিপুত্রের কাছে। বরাদ্দ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাওয়ালতী নামাপাড়া ফকিরবাড়ী ফোরকানিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক শিবলী টেলিফোনে বলেন, 'শুনেছি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তবে আমার মাদ্রাসা তা পায়নি। আর বাস্তবে এ গ্রামে কোনো হাফেজিয়া নয়, রয়েছে ফোরকানিয়া মাদ্রাসা।'
এমপিপুত্র শান্তর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ঘাগরা ইউনিয়ন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পাড়াইল উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মামুনের নামে আড়াই লাখ টাকার পাঁচটি প্রকল্প দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। তবে কোনো প্রকল্প ও টাকা পাননি বলে দাবি করেন মামুন। একই ইউনিয়নের সুহিলা গ্রামের বেলালও পেয়েছেন ছয়টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের নামে বরাদ্দ হওয়া তিন লাখ টাকার মধ্যে আড়াই লাখ টাকাই শান্তকে দিতে হয়েছে। বেলালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি একটি প্রকল্প পেয়েছেন এবং এর মাস্টাররোল সম্প্রতি জমা দিয়েছেন। শান্তকে টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি নিরুত্তর থাকেন।
টিআর, কাবিটা, কাবিখা বাস্তবায়ন নীতিমালায় বলা আছে, অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রজেক্ট কমিটির সভাপতিকে ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি/চেয়ারম্যান, প্রতিষ্ঠানপ্রধান কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হতে হবে, যার কোনো কিছুই মানা হয়নি।
ক্ষমতার অপব্যবহার : স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নিযোগপ্রক্রিয়ায় এমপির স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বোর্ডের সদস্য নন, এমনকি আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। অথচ নিয়োগ বোর্ডে হারহামেশাই হাজির হন এমপি। পরে নিজস্ব প্রার্থীদের নিয়োগ করতে চাপ দেন। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন পদে নিয়োগে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়ে থাকেন এমপি ও তাঁর পুত্র। এ ছাড়া ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট, সিএমএমইউ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, গৃহায়ণ ও গণপূর্তসহ সব প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারে এমপিপুত্র শান্তকে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত চাঁদা না দিয়ে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারে না।
২১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ঠিকাদার সেলিম অভিযোগ করেন, 'পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সুনামগঞ্জ ভবন তৈরির এক কোটি ৬২ লাখ টাকার দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য গত ৬ সেপ্টেম্বর দরপত্র ফেলতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এমপিপুত্র শান্তর নির্দেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা শাহজাদ ও তাঁর ক্যাডার বাহিনী হুমকি দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দেয়। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ পারমাণবিক কেন্দ্রের ভবন নির্মাণের দরপত্রে পাঁচ কোটি টাকার কাজের প্রায় দুই কোটি টাকার কাজই নিজস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে দিয়েছেন শান্ত।'
হাইকোর্টের নির্দেশনার কারণে ২০০১ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের কাচারিঘাট বালুমহালের ইজারা বন্ধ থাকলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইজারা ছাড়াই ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এখান থেকে প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার টাকা আয় করছে এমপির পরিবারের লোকজন। এ বালুমহাল দখল নিয়ে খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এমপির ভাই মমতাজ মোটর মালিক সমিতির নেতৃত্ব নিয়ে নেন। অথচ ২০১০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোটর মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি সৈয়দ ফারুকীর নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ ছিল। এমপির ভাগ্নে বুলবুল খাগদহর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে পরাজিত হওয়ার পর সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় ভাঙচুর করেছেন।
একইভাবে এমপির পিএস সাঈদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে ময়মনসিংহের শহরতলি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে ও সানকিপাড়ায় জমি কিনে দুটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন বলে জানা যায়।
অভিযোগ অস্বীকার : সার্বিক অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মতিউর রহমান এমপি টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার প্রতিপক্ষরা অসত্য অভিযোগ করে আসছে। আমরা দলকে ভালোবাসি। কোনো ক্ষমতার অপব্যবহার করি না।' কলেজের নামে জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ করা জমির টাকা পরিশোধ প্রসঙ্গে বলেন, দ্রুতই এর সমাধান হবে। নিজের কলেজে সরকারি অর্থ বরাদ্দ নেওয়া প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য মতিউর রহমান বলেন, 'আমি শিক্ষক মানুষ। শিক্ষা সম্প্রসারণে সব সময়ই কাজ করেছি। সাম্প্রতিক বরাদ্দও এরই অংশ।'
এমপিপুত্র মুহিতউর রহমান শান্তও অভিযোগ অস্বীকার করে টেলিফোনে বলেন, 'আমি সরকারি জমি দখল করিনি। আর ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে টিআর, কাবিখা, কাবিটার অর্থ বরাদ্দ হলে তা খতিয়ে দেখা হবে।' বিজ্ঞান কলেজের নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল প্রসঙ্গে বলেন, 'জমিটি কলেজের নামে ভাড়া নেওয়া হয়েছে।' টেন্ডারবাজি প্রসঙ্গে বলেন, 'আমার অগোচরে ছাত্রলীগের ছেলেরা কিছু করলেও তা আমার জানা নেই।'
এমপির ভাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আফাজ উদ্দিন সরকার বলেন, 'আমি উপজেলা পরিষদের জমি এক বছরের জন্য লিজ নিয়েছি।' লিজ নেওয়া জমিতে সাইনবোর্ড টাঙানো প্রসঙ্গে কোনো উত্তর দেননি। আর পুরো কাজ না করেই বিল তুলে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি ঢাকা থেকে কাজের সময় বাড়িয়ে নিয়ে রানিং বিল তুলেছি।' এত অর্থ আয় প্রসঙ্গে বলেন, 'আমি ব্যবসা করে টাকা কামাই।' অভিযোগ প্রসঙ্গে এমপির পিএস সাঈদ বলেন, 'আমার কোনো বাড়ি-সম্পদ নেই। আমি আগেও জিরো ছিলাম, এখনো জিরো।'
প্রশাসনের বক্তব্য : সরকারি জমিতে আফাজ উদ্দিনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড প্রসঙ্গে দাপুনিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাসানুল ইসলাম বলেন, 'বিষয়টি সঠিকভাবে আমার জানা নেই। তবে ওই এলাকায় পৌরসভার বেশ কিছু জমি আছে, যার অধিকাংশই লিজ দেওয়া রয়েছে।'
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার টিআর, কাবিটা, কাবিখার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নুরুল হুদার মোবাইলে বারবার রিং করলেও তিনি ধরেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অফিসের অন্য এক কর্মকর্তার দাবি, 'সরকারি অনুদানের ২০ ভাগ কাজও মাঠপর্যায়ে হয়নি। বরাদ্দ করা অর্থ শুধু লুটই হয়েছে।'
এলজিইডির ময়মনসিংহ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, কাজগুলোর বিল উপজেলা পরিষদ থেকে ইউএনওর তত্ত্বাবধানে হয়। তবে কাজ না করে টাকা তোলা হলে সেটা অবশ্যই অনিয়ম।
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক লোকমান হোসেন মিয়া টেলিফোনে বলেন, কলেজের জমির টাকা লিখিতভাবে চাওয়া হয়েছে। আর জেলা প্রশাসনের কিছু জমি অবৈধ দখলে থাকতে পারে। তবে তা দখলমুক্ত করে পুনরুদ্ধার করা হবে।
No comments:
Post a Comment