Wednesday, 29 December 2010

মহাজোট সরকারের দু’বছর : রাবিতে অর্ধশত সংঘর্ষ, নিহত ৩ : হামলার শিকার ১০ শিক্ষক ৩০ সাংবাদিক : বেপরোয়া চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য ভিন্নমতাবলম্বী দমন, ছাত্রী লাঞ্ছনা

এরশাদুল বারী কর্ণেল রাবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তার ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছে মহাজোট সরকার সমর্থিত বর্তমান প্রশাসনের গত দু’বছরে। বেপরোয়া চাঁদাবাজি, সংঘর্ষ, হত্যা, গণগ্রেফতার, নিয়োগবাণিজ্য, দলীয়করণ, বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট লঙ্ঘন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্যকরণ, ভিন্নমতালম্বী দমন, ছাত্রী ও শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক নির্যাতন, প্রেসক্লাবে হামলা এমন কোনো ঘটনা পাওয়া যাবে না যা গত দু’বছরে ঘটেনি। ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মহাজোট সরকার সমর্থিত ভিসি প্রফেসর এম আবদুস সোবহান ও প্রোভিসি প্রফেসর মুহম্মদ নুরুল্লাহর নেতৃত্বে বর্তমান প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে গত দু’বছরে অর্ধশতাধিক ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে ৩ মেধাবী ছাত্রকে। গ্রেফতার হয়েছে পাঁচ শতাধিক ছাত্র। এসব ঘটনায় ক্যাম্পাস বন্ধ থেকেছে শতাধিক দিন। নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৮৫ দলীয় শিক্ষককে। ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হয়েছে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, ১০
শিক্ষক ও কমপক্ষে ৩০ সাংবাদিক। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব। কোনো কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের পাশাপাশি প্রশাসন ও প্রক্টরিয়াল বডির জড়িত থাকারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব অপরাধমূলক ঘটনার অধিকাংশেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে।
সূত্রমতে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৪ ফেব্রুয়ারি সাময়িকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিসি প্রফেসর ড. মামনুনুল কেরামতকে অব্যাহতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর এম আবদুস সোবহানকে ভিসির দায়িত্ব দেয়া হয়। একইদিন মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও প্রগতিশীল শিক্ষক গ্রুপের সক্রিয় সদস্য প্রফেসর মুহম্মদ নুরুল্লাহকে প্রোভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভিসি-প্রোভিসির দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে শুরু হয় দলীয়করণের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। প্রশাসনিক সবগুলো পদে নিজেদের পছন্দের লোককে বসিয়ে পুরো প্রশাসন ঢেলে সাজানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি এবং অধিকাংশ হল প্রাধ্যক্ষদের ডেকে পদত্যাগের চাপ সৃষ্টি করা হয়। অব্যাহতি দেয়া হয় জোরপূর্বক।
সংঘর্ষে নিহত, গ্রেফতার, ক্যাম্পাস বন্ধ : গত দু’বছরে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৮ থেকে ১০ বার। অন্যদিকে শুধু ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৩৫ থেকে ৪০ বার। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যকার সংঘর্ষে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিবিরের রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান নোমানীকে প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে। ওই ঘটনায় উভয় সংগঠনের কমপক্ষে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়। ঘটনার দিনই পরিস্থিতি শান্ত করতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ক্যাম্পাস। তারই সূত্র ধরে বন্ধ হয়ে যায় রাজশাহী মহানগরীর প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর আগে ১১ মার্চ রাতে আবাসিক হলগুলো থেকে শতাধিক শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। চলতি বছর ৮ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ছাত্রলীগ-শিবির ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত হয় ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন। ফারুক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সরকারের নির্দেশে চিরুনি অভিযান শুরু হলে সারাদেশে কমপক্ষে দেড় হাজারের বেশি জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার পর শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা দায়ের হলে তার আত্মগোপন করে। ওই ঘটনায় রাবিতেই কমপক্ষে চার শতাধিক শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
১৫ আগস্ট শোক দিবসের টোকেন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে শাহ মখদুম হলের দোতলা ছাদ থেকে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিমকে ফেলে দেয় দলটির সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা। ৯ দিন মুমূর্ষু অবস্থায় ঢামেকে চিকিত্সাধীন থাকার পর ২৩ আগস্ট নাসিমের মৃত্যু হয়।
হলে সিট দখল, লুটপাট ও চাঁদাবাজি : ৮ ফেব্রুয়ারির রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে আবাসিক হলগুলোতে সিট দখল, লুটপাট ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও মারধরের কারণে পাঁচ শতাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী আতঙ্কে হলের আবাসিকতা বাতিল করে ক্যাম্পাসের বাইরে মেসগুলোতে অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন এমন তালিকার মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, সাংবাদিক, সাধারণ শিক্ষার্থী, ক্যাম্পাসের ব্যবসায়ী ছাড়াও খোদ ছাত্রলীগের কর্মীরাও।
আক্রমণের শিকার শিক্ষার্থী, ১০ শিক্ষক, ৩০ সাংবাদিক ও প্রেসক্লাব : চাঁদাবাজি, অবৈধ সিট দখল ও পরীক্ষার হলে বিশৃঙ্খলার ঘটনায় ছাত্রলীগের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষসহ লাঞ্ছিত হয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী, ১০ শিক্ষক এবং অন্তত ৩০ সাংবাদিক। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর চাঁদাবাজির সময় বাধাদানের ঘটনায় রাবি ছাত্রলীগের উপগণশিক্ষা সম্পাদক এমদাদুল হক কর্তৃক ফোকলোর বিভাগের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ড. অনুপম হিরা মণ্ডল প্রহৃত হন। ৭ এপ্রিল ছাত্রলীগের অবৈধ সিট দখলে বাধা দিতে গিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতিসহ নেতাকর্মীদের হাতে প্রহৃত হন শহীদ শামসুজ্জোহা হল প্রাধ্যক্ষ ড. মর্তুজা খালেদ। একাধিকবার ছাত্রলীগের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়া। ১০ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ক্যাডাররা অনলাইন সংবাদ সংস্থা রেডটাইমস বিডি ডটকমের সাংবাদিক মুনছুর আলী সৈকতকে পিটিয়ে আহত করে। ১১ ফেব্রুয়ারি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেলে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন চ্যানেল আইযের বিশেষ প্রতিনিধি মোস্তফা মল্লিক, ক্যামেরাম্যান মইন, আমার দেশ-এর রাজশাহী ফটোসাংবাদিক আসাদুজ্জামান আসাদ, প্রথম আলোর আজহার উদ্দিন, নিউ এজের সৌমিত্র মজুমদার, কালের কণ্ঠের নজরুল ইসলাম জুলু, সানশাইনের রুনি, জনকণ্ঠের রাবি প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম, যুগান্তরের সায়েম সাবু ও দি এডিটরের আতিকুর রহমান তমাল। এ ছাড়া ছাত্রলীগ কর্মীরা দৈনিক ইনকিলাব প্রতিনিধি সামসুল আরেফিন হিমেল, বাংলাবাজার পত্রিকার শাহজাহান বিশ্বাস, শীর্ষনিউজের লুত্ফর রহমান, যুগান্তরের সায়েম সাবু, ডেসটিনির আবদুর রাজ্জাক সুমন, বাংলাদেশ টুডের আওরঙ্গজেব সোহেল, আরটিএনএনের এসএম সাগরকে মারধর ও লাঞ্ছিত করে।
সাংবাদিক নির্যাতন ও নিপীড়নের সবচেয়ে বড় নিদর্শন সৃষ্টি হয় গত বছরের ২৪ এপ্রিল। ওইদিন প্রক্টর তাদের দলীয় ক্যাডারদের সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের প্রেসক্লাব সিলগালা করে দেন। এ ঘটনায় এখনও প্রেসক্লাব বন্ধ রয়েছে।
১৮৫ জন দলীয় শিক্ষক নিয়োগ : গত দু’বছরে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সাংগঠনিক অবস্থান মজবুত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় শিক্ষক নিয়োগের মহাযজ্ঞ শুরু হয়। চার শতাধিক দলীয় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার চার ধাপে এ পর্যন্ত ২৯টি বিভাগের বিজ্ঞাপিত ১০০ পদের বিপরীতে ১৮৫ শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ২০১০ সাল নাগাদ রাবিতে সব শ্রেণীর নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ওই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এ নিয়োগ দেয়া হয়। এসব নিয়োগের বেলায় বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি ও সভাপতির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ’৭৩-এর অ্যাক্ট লঙ্ঘনেরও গুরুতর অভিযোগ ওঠে। মেধাবীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া এবং বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে দ্বিগুণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণ দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘমেয়াদি একাডেমিক ঝুঁকিতে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ইউজিসির অনুমোদনহীন এসব নিয়োগের ফলে প্রায় ২০ কোটি টাকা ঘাটতিতে পড়ে প্রশাসন। তাছাড়া বর্তমানে আরও সহস্রাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

No comments:

Post a Comment