Tuesday 28 December 2010

টিআইবির রিপোর্টে সরকারে তোলপাড় : জনমনে নানা প্রশ্ন

এম এ নোমান

দেশে বিচার বিভাগ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাত হিসেবে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন বিচার বিভাগ নিয়ে মানুষের মনে এতদিন যে প্রশ্ন তৈরি হয়ে আসছিল টিআইবির রিপোর্টে তা ফুটে উঠেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন বিচার বিভাগ নিয়ে সত্য রিপোর্ট প্রকাশ করায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের দণ্ড হয়েছে। আমার দেশ প্রতিবেদক জেল খেটে এসেছেন। এখন দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে বিচার বিভাগ টিআইবির স্বীকৃতি পেয়েছে। অবশ্য প্রধান বিচারপতি নিজেও সম্প্রতি বলেছেন জেলাজজ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে পেশকারের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেন করার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে টিআইবির প্রকাশিত রিপোর্ট প্রসঙ্গে সরকারের মন্ত্রী ও সরকারদলীয় নেতারা নানা বিরূপ মন্তব্য করছেন। সরকারের মন্ত্রী ও শাসক দলের নেতারা এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন বলেও মন্তব্য করেন অনেকে।
টিআইবির রিপোর্টকে যথাযথ ও বাস্তবভিত্তিক বলে মনে করেন এ সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বিচার বিভাগ নিয়ে এর আগে প্রধান বিচারপতি ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন মহল যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন টিআইবির রিপোর্ট তারই বাস্তব প্রতিফলন মাত্র। বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, টিআইবির প্রতিবেদন বরাবরই সরকারি দল ‘ষড়যন্ত্রের অংশ’ মনে করে প্রত্যাখ্যান করে। আর বিরোধী দল তা গ্রহণ করে। এতেই প্রমাণ হয় টিআইবির রিপোর্ট হচ্ছে বাস্তবভিত্তিক।
টিআইবি গত বৃহস্পতিবার ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০১০’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। টিআইবির এ জরিপ অনুযায়ী দেশের বিচার বিভাগ হচ্ছে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। এর পরে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও ভূমি প্রশাসন। সেবাপ্রার্থী শতকরা ৮৪ ভাগ মানুষই দুর্নীতির শিকার। সেবাপ্রার্থীদের বছরে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়। দেশে দুর্নীতি বেড়েছে ৮৫ শতাংশ। টিআইবির এ জরিপ সম্পর্কে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছেন, দুর্নীতির এ চিত্র সার্বিক নয়। দুর্নীতির ব্যাপকতা এর চেয়ে অনেক বেশি।
বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া : সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক টিআইবির রিপোর্ট সম্পর্কে বলেন, রিপোর্টের যতটুকু অংশ আমি পড়েছি তাতে বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুষঙ্গগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিচারপ্রার্থীদের বিভিন্ন স্থানে ঘুষ দিতে হয়। জুডিশিয়াল সার্ভিস সম্পর্কেও বলা হয়েছে। বিচার বিভাগের অনিময় সম্পর্কে টিআইবির রিপোর্টেই শুধু বলা হয়নি, এর আগে বর্তমান প্রধান বিচারপতি, সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ অনেকেই বলেছেন। তবে আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে—দেশের মানুষ এখনও বিচার বিভাগকে তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করে থাকে। এটাই হচ্ছে বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় ভরসা। বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগেরই। বিচার বিভাগের মর্যাদা যাতে আর ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবারই নজর দেয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, টিআইবির রিপোর্টে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকেই এর আগে বিচার বিভাগ নিয়ে তাদের আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রায় একই বক্তব্য দিয়েছেন। টিআইবির রিপোর্ট প্রকাশের দিন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান রিপোর্ট সম্পর্কে বলেছেন, এ রিপোর্টে যা প্রকাশ হয়েছে, বাস্তবচিত্র আরও ভয়াবহ। দুর্নীতি আরও বেশি ও ব্যাপক। টিআইবির এ রিপোর্ট সম্পর্কে শাসক দলের মন্ত্রী ও নেতারা যেভাবে কথা বলছেন তা দুর্ভাগ্যজনক ও অনভিপ্রেত। তিনি বলেন, টিআইবি এ ধরনের রিপোর্ট এর আগেও দিয়েছে। বরাবরই ক্ষমতাসীনরা এ রিপোর্ট তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রত্যাখ্যান করছে। আর বিরোধী দল তা গ্রহণ করছে। বাস্তব কথা হলো—দুর্নীতি বাড়ছে। দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। টিআইবিকে জরিপ চালানো ও রিপোর্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।
টিআইবির প্রতিক্রিয়া : টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মোজাফ–র আহমদ ‘সেবাখাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০১০’ সম্পর্কে আমার দেশকে বলেন, এটি কোনো মতামত কিংবা মন্তব্য নয়। এটি একটি জরিপের ফলাফল। এ ফলাফলের ভিত্তি নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন তাদের উচিত এটি সম্পূর্ণ পড়ে নেয়া। এ জরিপের ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে জরিপের পদ্ধতিও উল্লেখ করা হয়েছে। যারা এটি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছেন তারা হয়তো প্রতিবেদনটি এখনও পড়েননি। জরিপ কাজে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বাস্তবভিত্তিক জ্ঞানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাই জরিপ করেছেন। বিচারপ্রার্থী জনগণের বাস্তব উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে এ জরিপে। বিচারপ্রার্থীরা বিচারাঙ্গনে গিয়ে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন তারই প্রতিফলন ঘটেছে এ জরিপ রিপোর্টে। এটি কোনো টেবিল মেকিং কিংবা কাল্পনিক জরিপ নয়। অধ্যাপক মোজাফ–র বলেন, দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বিচারকদের এক অনুষ্ঠানে তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা পেশকারদের কাছ থেকে তোলা নেবেন না।’ বিচারকদের সংশোধনের জন্যও তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বিচার বিভাগ সম্পর্কে বলেছেন, বিচার বিভাগ এখন কাচের ঘরে অবস্থান করছে। যে কোনো সময় তা ভেঙে পড়তে পারে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বিচার বিভাগ সম্পর্কে বলেছেন, গরিবদের জন্য ন্যায়বিচার দুরাশা ছাড়া কিছুই নয়। বিচার এখন ধনীদের জন্য। বিচার বিভাগ নিয়ে তাদের এ উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা টিআইবির রিপোর্টের সঙ্গে মিলে গেছে। তাই বলে এটা বলা যাবে না যে, তাদের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এ জরিপ হয়েছে। তাদের বক্তব্যের অনেক আগে থেকেই টিআইবি জরিপ কাজ শুরু করেছে। টিআইবির এ জরিপ বাস্তবভিত্তিক। এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মোজাফ–র বলেন, বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশে টিআইবি এ জরিপ করেনি। বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব হচ্ছে বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিতরা যদি তাদের মর্যাদা রক্ষা করতে না চান, সেক্ষেত্রে দেশের সব মানুষ একত্র হয়েও বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করা যাবে না। কাজেই টিআইবির রিপোর্টে বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক নয়।
মন্ত্রী ও নেতাদের প্রতিক্রিয়া : গত বৃহস্পতিবার টিআইবির এ রিপোর্ট প্রকাশের পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও শাসক দলের নেতারা এর তীব্র সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের এমপি বলেছেন, বিচার বিভাগ সম্পর্কে টিআইবির রিপোর্ট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করেছে। তিনি গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বঙ্গবন্ধু সমাজকল্যাণ পরিষদ আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে টিআইবির রিপোর্ট সম্পর্কে বলেন, দুর্নীতির বিকাশ ও অস্তিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু টিআইবি যে জরিপ চালিয়েছে তা বাস্তবভিত্তিক নাও হতে পারে। কেননা দেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে ১৬ হাজার লোকের মতামত গ্রহণ করলে সেখানে সমগ্র জাতির মতামতের সঠিক প্রতিফলন নাও হতে পারে।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, বিচার বিভাগ সম্পর্কে টিআইবি প্রকাশিত রিপোর্ট বিভ্রান্তিকর। এতে বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তিনি গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নবনির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির অভিষেক ও শ্রেষ্ঠ রিপোর্ট পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে টিআইবির রিপোর্ট সম্পর্কে এ মন্তব্য করেন। টিআইবি রিপোর্ট সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, এ ধরনের রিপোর্ট দেশের জন্য ক্ষতিকর। বিচার বিভাগের দুই-একজনের অসাধুতার জন্য সবার ওপর ঢালাওভাবে দোষ চাপানো ঠিক নয়। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করতেই টিআইবি দুর্নীতিবিষয়ক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা দেশের বিচার বিভাগকে বিতর্কিত, কলঙ্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এই মুহূর্তে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ রিপোর্টের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। তিনি গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় টিআইবির রিপোর্ট সম্পর্কে আরও বলেন, দুর্নীতির রিপোর্ট পেশ করে রাজনীতিবিদদের হেয় করা এখন টিআইবিসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়া বলেছেন, টিআইবির প্রতিবেদনে ব্যক্তিবিশেষের দায় পুরো বিচার ব্যবস্থার ওপর যেভাবে চাপানো হয়েছে তা যুক্তিযুক্ত হয়নি। এতে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশের জনগণ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে উত্সাহিত হবে। টিআইবির রিপোর্টের ভিত্তি সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমদ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এ রিপোর্ট প্রতিনিধিত্বমূলক কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। যারা এ রিপোর্ট তৈরির আগে জরিপ করেছেন তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা রয়েছে কিনা তাও দেখার বিষয়।
টিআইবির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে সুপ্রিমকোর্টের আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ২৩ ডিসেম্বর টিআইবি বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তা সঠিক নয়। এ রিপোর্ট যথাযথ হয়নি। বিচার বিভাগ সম্পর্কে ঢালাওভাবে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এ রিপোর্টে বিচারক ও বিচার বিভাগের সমস্যা সম্পর্কে কোনো সুপারিশ করা হয়নি। ফলে এ রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য নয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম ফজলুল হক খান ফরিদ, অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান খান হিরু, আফরোজা মুন, আবুল কালাম খান দাউদ, সুপ্রিকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ.ম. রেজাউল করিম প্রমুখ।

No comments:

Post a Comment