Tuesday 21 December 2010

শেয়ারবাজারে ধসের নেপথ্যে সিন্ডিকেটের কারসাজি : ২৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ

কাওসার আলম

সরকারের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। রোববার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ সূচকের পতন হয়েছিল ৫৫১ পয়েন্ট। রেকর্ড দরপতনে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। সুযোগ কাজে লাগিয়ে কয়েকটি সিন্ডিকেট চক্র বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেছেন, পরিকল্পিতভাবে দরপতন ঘটিয়ে চিহ্নিত কয়েকটি সিন্ডেকেট চক্র বাজার থেকে ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে এসব সিন্ডিকেট চক্রের গভীর সম্পর্ক থাকায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। উপরন্তু এসইসির বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে এসব সিন্ডিকেট চক্রের যোগসাজশ রয়েছে। তাদের সুযোগ করে দিতেই এসইসি ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯৬ সালে বিপর্যয় ঘটলে স্থবির হয়ে পড়ে দেশের শেয়ারবাজার। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং মাত্র কয়েক হাজার ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে লেনদেন। ধীরে ধীরে শেয়ারবাজারে গতি সঞ্চারিত হয়। ২০০৪ সালে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। তবে শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক গতি ফিরে আসার সূচনা হয়েছে গত জরুরি সরকারের আমলে। ওই সরকারের নানামুখী অভিযানে দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতে বিনিয়োগের সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও সংকুচিত হয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকে লাভজনক মনে করতে শুরু করেন। তাছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও জরুরি সরকারও শেয়ারবাজারে কালো টাকার প্রশ্নহীন বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়। ফলে চাঙ্গা হয়ে ওঠে শেয়ারবাজার।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর শেয়ারবাজারে লেনদেন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। বিপুলসংখ্যক নতুন বিনিয়োগকারী যুক্ত হওয়ায় বেড়ে যায় লেনদেনের পরিমাণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আবারও শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ায় শেয়ারবাজারে লেনদেনের পালে আরও জোরে হাওয়া লাগে। ২ জুলাই দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন ১ হাজার কোটি টাকার মাইলফলক স্পর্শ করে। লেনদেন যতই বাড়ছিল ততই সক্রিয় হয়ে ওঠে সিন্ডিকেট চক্র। বাজার থেকে ফায়দা লুটতে তারা কারসাজির মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর বাড়াতে শুরু করে। দরবৃদ্ধির কারণে শেয়ারবাজারে প্রতিদিনই যোগ হতে থাকে নতুন নতুন মুখ। শেয়ারবাজার সম্পর্কে এদের অধিকাংশেরই কোনো ধারণা না থাকলেও শুধু মুনাফা লাভের আশায় বিনিয়োগ শুরু করে। বিদ্যুত্, গ্যাস ও অবকাঠামো সমস্যার সমাধান করতে না পারার কারণে দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় শিল্প উদ্যোক্তারাও ধীরে ধীরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো আমানত ও সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমিয়ে দেয়ায় সাধারণ মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। পেনশনভোগী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, ছাত্র-যুবকসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। অফিসের কাজকর্ম ফেলে রেখে শেয়ারবাজার নিয়ে মেতে ওঠেন অনেকে। নতুন বিনিয়োগ না থাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথও রুদ্ধ হয়ে পড়ে। বেকার যুবকরাও শামিল হয় শেয়ারবাজারে। ব্যাংক ও বিভিন্ন উত্স থেকে ঋণ নিয়ে তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। নতুন নতুন বিনিয়োগকারী যুক্ত হওয়ায় বাজারে তারল্য প্রবাহ বেড়ে যায়। শেয়ারবাজারে একদিনে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের ঘটনাও ঘটে। লেনদেনের পরিমাণ যতই বাড়তে থাকে ততই বাড়তে থাকে শেয়ারের চাহিদা। দুই বছর আগেও শেয়ারবাজারে বিও অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখের নিচে। বর্তমানে সে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩ লাখে। বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে শেয়ারের জোগান বাড়েনি। বাজার বিশ্লেষকরা সব সময়ই বলে আসছিলেন, সরবরাহ না বাড়ানোর কারণে বাজার ক্রমেই ঝুঁকির দিকে চলে যাচ্ছে। অল্প কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার বার বার হাতবদলের কারণে অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে বেশিরভাগ শেয়ার। তবে কয়েকটি কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট কম। একই সময় মিউচুয়াল ফান্ডের একের পর এক অনুমোদন দেয়ার কারণে বাজারে শেয়ারের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। এতে শেয়ারের মূল্যস্তর আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় বাড়তি মুনাফা করতে ব্যাংকগুলোও আইনি সীমা লঙ্ঘন করে শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ শুরু করে। ব্যাংকের ভল্টের টাকাও শেয়ারবাজারে চলে আসে। শিল্প গড়তে ব্যাংক ঋণ নিয়েও কোনো কোনো উদ্যোক্তা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। ফলে সামগ্রিকভাবে শেয়ারবাজারে তারল্য প্রবাহের ঢেউ আছড়ে পড়ে। তারল্য প্রবাহ বাড়তে থাকায় শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা তুলে নেয়ার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে সিন্ডিকেট। নানা কারসাজি করে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলে নিতে কৌশলের আশ্রয় নেয়। একেক সময় একেক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করে ওইসব চক্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (এসইসি) চাপে ফেলে সিন্ডিকেট চক্র বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সংস্থাটি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে কোম্পানির শেয়ারের দাম কমতে শুরু করলে সে সুযোগে স্বল্পমূল্যে শেয়ার কিনে নিত তারা। পরে আবার দাম বাড়তে শুরু করলে চড়া দামে সেসব শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তের কারণে বড় ধরনের পতন হলে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় বিক্ষোভ বা আন্দোলন করলে এসইসি দু্রত সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে এসইসির কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়নি বরং তা বারবার বাজারকে অস্থির করে তোলে। অভিযোগ রয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কয়েকটি সিন্ডিকেট চক্রের কাছে নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ায় বাজারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এসইসির দুর্বল নেতৃত্বকেও এ জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। উপরন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে কমিশনে রয়েছে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন চক্রের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই এসইসি কর্মকর্তাদের মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ তৈরি হয়েছে। তবে কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে হাত না মেলানোর কারণে তাদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আর এসব অপপ্রচারের পেছনে কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ ডিসেম্বর চেক ক্লিয়ারিং ছাড়া শেয়ার কেনার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়ে ডিএসইর এক পরিচালক এসইসির ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। বাজারের অতিমূল্যায়ন ঠেকাতে তিনি তা কার্যকরের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেন। তার পীড়াপীড়িতে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল এসইসি। কমিশনের চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। নির্দেশনার কারণে গত ৮ ডিসেম্বর পুঁজিবাজারের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। ওইদিন মাত্র সোয়া ঘণ্টার ব্যবধানেই ডিএসইর সাধারণ সূচকের পতন ঘটে ৫৪৭ পয়েন্ট। দরপতন ঘটে প্রায় সবকয়টি কোম্পানির। পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ফলে এসইসি এ নির্দেশনাটির কার্যকারিতা স্থগিত করে। চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে নির্দেশনা জারি করার কারণে কমিশনের সিনিয়র সদস্য মনসুর আলমকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয় এবং পরবর্তী সময়ে অফিস আদেশের মাধ্যমে তাকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য কমিশন বাজারের স্বার্থে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি মূলত সিন্ডিকেট চক্রের কারণে। সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করা ডিএসইর এক পরিচালক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন বলে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। তার সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি সক্রিয় সিন্ডিকেট চক্র বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পেছনে রয়েছে ওইসব সিন্ডিকেট চক্রের হাত। আর সিন্ডিকেট চক্রটির কাছে অনেক সময়ই অসহায় আত্মসমর্থন করতে হচ্ছে কমিশনকে। এমনকি ডিএসই পরিচালনা পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো বিষয়েও কমিশনের ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছিল মূলত প্রভাবশালী মহলের চাপে। আর এসব চক্র নানাভাবেই কারসাজি করে বাজার থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। গত ৮, ১২ ও ১৯ ডিসেম্বরের দরপতনে সিন্ডিকেট চক্রটি বাজার থেকে ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে বাজারে ব্যাপক গুজব রয়েছে।
অপরদিকে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি এবং চাহিদা বাড়লেও সরকারের বেশ কিছু অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ে। আর অতিমূল্যায়িত বাজারে দরপতন ঘটিয়ে সে সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে সিন্ডিকেট চক্রটি। ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে শেয়ার সরবরাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই— বাজার বিশ্লেষকদের এমন অভিমতের বিপরীতে সিদ্ধান্ত নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় গত বছরের মার্চে এসইসির কাছে একটি সুপারিশ করে। সুপারিশে ৪০ কোটি টাকার কম পরিশোধিত মূল্যের কোম্পানির শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর ফলে বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো পরিশোধিত মূলধন জটিলতায় শেয়ারবাজারে আসতে পারেনি। একদিকে চাহিদা বৃদ্ধি অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। অবশেষে সম্প্রতি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৩০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আবার বেসরকারি খাতের কোম্পানির সরাসরি তালিকাভুক্তি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমেও শেয়ার সরবরাহের পথে বাধা তৈরি করা হয়।

No comments:

Post a Comment