Sunday, 28 March 2010
চাঁদপুরে মানবসম্পদ উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট
গিয়াসউদ্দিন মিলন, চাঁদপুর
সাক্ষরজ্ঞান আছে এমন লোকদের সৃজনীমূলক কাজে দক্ষতা বাড়িয়ে মানবসম্পদে পরিণত করার প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে সরকারের বিদেশ থেকে আনা ঋণের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। বেসরকারি সংস্থা ‘ডরপ’ জেলার ৫টি উপজেলায় গত নভেম্বর মাস থেকে এ ধরনের লুটপাট চালাচ্ছে। সরকারের পক্ষে যারা এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের তদারকি করার কথা তারাও অজানা কারণে নীরবতা পালন করছে।
গত প্রায় ১ মাস চাঁদপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ওই প্রকল্পের জন্যে বাড়ির ছাদে, ঘরের বারান্দায়, সরকারের পরিত্যক্ত গোডাউনে, কোথাও কারও বসতঘরের একাংশে এবং অনেকের অর্ধনির্মিত পরিত্যক্ত ঘরকে কেন্দ্র দেখানো হয়েছে। সরকার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে, সেই প্রশিক্ষণ কাজ একেবারেই না করে টাকা-পয়সা লুট করছে তারা। অনেক কেন্দ্র মাস কিংবা সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে দিন ও রাতে দু’শিফটের মধ্যে এক শিফটে ৫/৬ জন শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে। অন্য শিফট কখনোই চলে না। অধিকাংশ কেন্দ্র সহায়ক/সহায়িকা জানে না তাদের মূল কাজ কী। গৃহনির্মাণে কত টাকা বরাদ্দ দেয়া আছে, বিবিধ সুযোগ-সুবিধা কী তাও তাদের জানা নেই। অনেক স্থানেই ঘরের মালিক হচ্ছেন পরিচালনা কমিটির সভাপতি, স্ত্রী শিক্ষিকা এবং তার সন্তান কিংবা নিকটাত্মীয়কে সহায়ক রাখা হয়েছে। ইউনিয়ন ও উপজেলা সুপারভাইজার সপ্তাহে একবারও তাদের কেন্দ্র পরিদর্শন করেননি বলে জানা গেছে। জেলা সহকারি পরিচালক (উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো) মীর হোসেন এসব তথ্য জেনে রীতিমত হতবাক! তিনি ঘোষণা দিয়েছেন এখন থেকে প্রকল্পের কাজ ঠিকমত না হলে তাদের বিল ও বেতন ভাউচারে স্বাক্ষর করবেন না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীনুর শাহীন খান বলেছেন, এখন থেকে তিনি বিষয়টি ভালোভাবে দেখবেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলার ৮টি উপজেলায়ই প্রকল্পের কাজ গত নভেম্বর ’০৯ মাস থেকে চালু হয়েছে। এর মধ্যে চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব উত্তর, ফরিদগঞ্জ এবং হাজীগঞ্জ উপজেলায় কাজ করছে ‘ডরপ’। কচুয়ায় নারী মৈত্রী, শাহরাস্তিতে পিআরডিএস এবং মতলব দক্ষিণে সিএইচডি কাজ করছে। সেসব উপজেলার চিত্রও একই রকম। প্রতিটি উপজেলায় ৩৪টি করে কেন্দ্র রয়েছে। প্রতি কেন্দ্রে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মহিলা ও পুরুষের দুটি পৃথক দল গঠন করা হয়েছে। প্রতি দলে ৩০ জন করে লোক নেয়া হয়েছে। মহিলা দলের ক্লাস বিকাল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। পুরুষদের সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত। প্রতি কেন্দ্রে ১টি করে পরিচালনা কমিটি, ১ জন পুরুষ ও ১ জন মহিলা সহায়িকা রয়েছে। ১৭টি কেন্দ্রের জন্য ১ জন সুপারভাইজার, প্রতি উপজেলায় ১ জন সমন্বয়কারী এবং ১ জন জেলা সমন্বয়কারী রয়েছে। কেন্দ্র পরিচালনা কমিটি ছাড়া সমন্বয়কারী ও কেন্দ্র সহায়ক/সহায়িকারা বেতনভুক্ত। প্রতিটি কেন্দ্র নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, বই ইত্যাদির জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৬২ হাজার ৫৫০ টাকা। সে হিসেবে চাঁদপুরের ৮টি উপজেলায় শুধু কেন্দ্র প্রস্তুতের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৪ কেন্দ্র। ৮ উপজেলা=২৭২টি কেন্দ্র। এ হিসেবে ২৭২টি কেন্দ্রে মোট অর্থ ব্যয় হচ্ছে ২৭২–৬২৫৫০=১ কোটি ৭০ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ টাকা। এরই মধ্যে উল্লিখিত টাকার প্রায় সিংহভাগ তারা ব্যয় দেখিয়েছে। অথচ ২০ ফুট সাইজের একটি ঘরও তারা নির্মাণ করেনি। প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার টাকা। ৮ হাজার টাকা মূল্যের ১টি করে টিভি দেয়ার কথা থাকলেও গত ৫ মাসে তা সরবরাহ করা হয়নি। ২ হাজার ৫০০ টাকায় ২০ সেট বই দেয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৩০০ টাকায় ২ সেট বই দেয়া হয়েছে। আসবাবপত্র কেনায়ও অনিয়ম করা হয়েছে। যেভাবে চেয়ার-টেবিল দেয়ার কথা তা দেয়া হয়নি। স্টিলের আলমিরা এবং রেডিও দেয়া হয়নি অনেক কেন্দ্রে। ট্রেড বিষয়ক কোর্সে ২০টি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও দু’একটি কেন্দ্রে শুধু টেইলারিং ও হাউস ওয়্যারিং ছাড়া আর কিছুই তারা শেখাচ্ছে না।
সরেজমিন অনেক কেন্দ্রই বন্ধ পাওয়া গেছে। কোথাও দু’একজনকে পাওয়া গেলেও তারা কেউই উপরোল্লিখিত কাজ সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। তারা জানান, কখনও কখনও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিদর্শনে আসার আগে তাদের মোবাইল ফোনে আগাম বার্তা দেয়া হয়। শুধু ওই দিনের জন্য তারা কেন্দ্রের হাজিরা খাতা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের হাজির রাখেন। সাধারণত তারা পাঠ্যবই চেতনায় ১, ২ ও ৩ পড়িয়ে থাকেন। এদের কোনো কেন্দ্রেই ইস্যুভিত্তিক ১২৫টি অনুসারক গ্রন্থ নেই। এগুলো পড়ানোর মতো অনেক সহায়ক/সহায়িকার দক্ষতাও নেই। মানব উন্নয়নের জন্য সাক্ষরতা-উত্তর ও অব্যবহৃত শিক্ষা প্রকল্প-২-এর বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জেলা সমন্বয়কারী আবদুল মালেক জানান, ২৫ হাজার টাকায় একটি কেন্দ্র নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন। তাছাড়া ওই টাকায় ২০% স্থানীয় কমিটির দেয়ার কথা, বাকি ৮০ ভাগ টাকা একত্রে সংস্থা দিচ্ছে না। যার কারণেই বাড়ি বাড়ি থেকে মানুষের ঘর, কাচারি মাসিক হারে ভাড়া নিয়ে কেন্দ্র করা হয়েছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রের টিভি দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে প্রত্যেক কেন্দ্রে রেডিও দেয়া হয়েছে। নিম্নমানের ফার্নিচার দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। কেন্দ্র নিয়মিত পরিদর্শন না হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রত্যেক উপজেলায় মাত্র ২ জন সুপারভাইজার। ১ জনকে ১৭টি কেন্দ্র দেখতে হয়। ২ হাজার টাকা বেতন পেয়ে প্রতি মাসে সব কেন্দ্র দেখা খুবই কষ্টকর।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/03/29/24796
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment