Wednesday, 10 March 2010
আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের রাজধানীতে পরিবহন চাঁদাবাজি বছরে ৩৮৮ কোটি টাকা
পরিবহন চাঁদাবাজি বছরে ৩৮৮ কোটি টাকা
Shamokal বৃহস্পতিবার | ১১ মার্চ ২০১০ | ২৭ ফাল্গুন ১৪১৬ | ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৩১
রাজধানীর চিত্র:
চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্যে অসহায় বাস মালিকদের ডাকা ধর্মঘটে মঙ্গলবার রাত থেকে নগর পরিবহনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। চরম দুর্ভোগে পড়েন গতকাল সকালে অফিসগামী মানুষ। বিকেলে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত গন্তব্যে পেঁৗছতে রাজধানীর কর্মজীবীদের এ প্রাণান্তকর চেষ্টা অব্যাহত ছিল । মাহবুব হোসেন নবীন
মাহবুব আলম লাবলু/নাহিদ তন্ময়
রাজধানীতে পরিবহন খাত থেকে দিনে গড়ে এক কোটি আট লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। বছরে চাঁদাবাজির পরিমাণ প্রায় ৩৯০ কোটি টাকা। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নামে এই বেপরোয়া চাঁদাবাজি রোধ করতে পারছে না পুলিশ। অবৈধ আয়ের এই 'সোনার খনি' দখলের লড়াইয়ে ঘটছে খুনোখুনির ঘটনা। গডফাদাররা অবৈধ এ টাকার একটি অংশ ওড়াচ্ছেন নগরীর বেশ কয়েকটি অভিজাত হোটেল ও ক্লাবের নাচঘরে। কেউ আবার মোটা টাকা খরচ করে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব রঙমহল। পুলিশ ও প্রভাবশালীদের এসব রঙমহলে নিয়ে ম্যানেজ করা হয়। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে এ খাতের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণও বদল হয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর স্থানীয় নেতাকর্মীরা 'কাঁচা টাকার' টানে পরিবহন চাঁদাবাজিতে এতটাই সক্রিয় যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি
বন্ধের দাবিতে ধর্মঘট ডাকছেন মালিকরা।
এদিকে পরিবহন খাতে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ প্রশাসনের গঠন করা যৌথ কমিটির নেতাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধেই রয়েছে চাঁদাবাজির অভিযোগ। ১৯ সদস্যের কমিটির ৯ জন পুলিশ কর্মকর্তা। বাকি ১০ জন পরিবহন খাতের বিভিন্ন কমিটির নেতা। এদের লোকজন শ্রমিকদের কল্যাণের নামে রসিদ দিয়ে চাঁদাবাজি করছে। এই টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে খরচের নজির খুব কম। মাঠ পর্যায়ে চাঁদা আদায়ের কাজে নিয়োজিত আছে 'লাঠি বাহিনী', 'যানজট বাহিনী' ও 'লাইন বাহিনী'।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার একেএম শহীদুল হক সমকালকে বলেন, পরিবহন শ্রমিক-মালিকরা সমঝোতার ভিত্তিতে নিজেদের নির্ধারিত রেটে চাঁদা তোলে। চাঁদাবাজির বিষয়ে পুলিশের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগও নেই। কেউ অভিযোগ করলে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক-মালিক সংগঠনের নেতৃত্বও বদলে যায়। পরিবহন মালিকদের মধ্যেও বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজন রয়েছে। সব সময় ক্ষমতাসীনরাই পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করে।
পরিবহন মালিকদের দেওয়া তথ্য ও সমকালের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৪৮টি কোম্পানির মালিকানায় ১৮ হাজার গাড়ি প্রতিদিন রাজধানীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন রুট এবং আশপাশের জেলায় চলাচল করে। দিনে প্রতিটি গাড়ি থেকে নূ্যনতম ৬০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এ হিসাবে ১৮ হাজার গাড়ি থেকে দিনে এক কোটি আট লাখ, মাসে ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন লীগ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি, ঢাকা জেলা বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, মহাখালী বাস টার্মিনাল শ্রমিক ইউনিয়ন, ফুলবাড়িয়া সড়ক পরিবহন যানবাহন ইউনিয়নসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে আদায় করা হচ্ছে এই বিপুল পরিমাণ চাঁদা।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির নির্ধারিত চাঁদার পরিমাণ গাড়িপ্রতি ৭০ টাকা। এর বাইরেও টার্মিনাল থেকে গাড়ি বের হতে যানজট বাহিনীকে দিতে হয় ২০ টাকা (কাঙালি চাঁদা হিসেবে পরিচিত), পরের ধাপ লাইনম্যানকে ২০ টাকা, টার্মিনালের গেট থেকে বের হলে সার্জেন্টের হাজিরা ফি ৫০ থেকে ১০০ টাকা, দিতে দেরি হলে বেড়ে দাঁড়ায় ২০০ টাকায়। টার্মিনালে প্রবেশের সময়ও দিতে হয় ২০ টাকা। পার্কিং বাবদ টার্মিনালের ইজারাদারকে দিতে হয় ৪০ টাকা। এছাড়া পথে পথে চাঁদাবাজ বাহিনীর আবদার মেটানোর পর দিন শেষে সব মিলিয়ে নূ্যনতম প্রতি গাড়ির জন্য মালিককে গুনতে হয় ৬০০ টাকা। সায়েদাবাদ টার্মিনাল, মহাখালী, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান টার্মিনাল এবং গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মাওয়াসহ ৭৪টি রুটেই নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি।
একজন পরিবহন মালিক জানান, বর্তমানে পরিবহন চাঁদাবাজির প্রভাবশালী নিয়ন্ত্রক ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন যানবাহন ইউনিয়ন নেতা কামরুল ইসলাম ও ইসমাইল হোসেন বাচ্চু। পরিবহন সেক্টরের সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে গঠিত যৌথ কমিটির ১৮ নম্বর সদস্য এই ইসমাইল হোসেন বাচ্চু। তাদের অধীনে অর্ধশতাধিক লোক মাঠ পর্যায়ে চাঁদা তুলছে। আবার অনেক পরিবহন কোম্পানি মাসিক মাসোহারাও দিচ্ছে তাদের। কামরুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলাও রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে অনেক দিন হাজতবাসও করেছেন তিনি। আর ইসমাইল হোসেন বাচ্চুর নামে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স। এমন কথাও শোনা যায়, মাঝে মধ্যে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করেন তিনি।
সড়ক পরিবহন যানবাহন ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া শাখার সভাপতি কামরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, '২০-২১ বছর আগে থেকেই আমি শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। আমার বিরুদ্ধে কেউ চাঁদাবাজির অভিযোগ করতে পারবে না। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির নির্ধারিত ৭০ টাকার বেশি চাঁদা আদায় করা হয় না। একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বাচ্চু সমকালকে টেলিফোনে জানান, বিগত সরকার আমলে মালিকদের গাড়িপ্রতি দিনে ৬০০-৭০০ টাকা চাঁদা দিতে হতো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে খোদ ডিএমপি কমিশনার চাঁদার পরিমাণ কমিয়ে মাত্র ৭০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।'
পূবালী ও রঙধনু পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা জানান, ঢাকা সড়ক পরিবহনের আঞ্চলিক ও যুবলীগ নেতা আহসান উল্লাহ, কাশেম ও কাওসার জুরাইন এলাকার পরিবহন চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। পূবালী পরিবহনের ৩০টি গাড়ি জুরাইন থেকে মিরপুর দিয়াবাড়ী রুটে চলাচল করে। একজন কর্মচারীর অভিযোগ, চাঁদা না পেয়ে এসব নেতা কয়েক দিন আগে জুরাইনের কাউন্টার বন্ধ করে দেন। পরে পূবালী পরিবহনের মালিক এসব নেতার সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতার ভিত্তিতে কাউন্টার চালু করেন। এছাড়া রঙধনু পরিবহনের ২৫টি গাড়ি জুরাইন থেকে মোহাম্মদপুর রুটে চলাচল করে। চাঁদা দিয়েই এসব গাড়ি চালাতে হয়।
মিরপুর-পল্লবী এলাকায় পরিবহন চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত স্থানীয় যুবলীগ নেতা ও পল্লবী থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আওলাদ হোসেন লাক্কু। র্যাবের কাছে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। র্যাব-৪-এর এক কর্মকর্তা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন। যদিও আওলাদ হোসেন লাক্কু টেলিফোনে সমকালের কাছে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment