Wednesday 10 March 2010

টিআর কাবিখায় দুর্নীতি: জড়িত সরকারি দলের এক শ্রেণীর নেতা-কর্মী

Kalerkantho ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ ফাল্গুন ১৪১৬, ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৩১, ১১ মার্চ ২০১০
টিআর কাবিখায় দুর্নীতি আহমেদ দীপু ও আশরাফুল হক রাজীবগ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও দুস্থদের সহায়তায় নেওয়া কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক দুর্নীতি চলার অভিযোগ উঠেছে। খোদ খাদ্যমন্ত্রীর কাছে এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ তোলা হলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে এরই মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় চলতি মৌসুম থেকে কাবিখার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
নীতি-নির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, সরকারি নির্দেশনায় দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন মাঠ পর্যায়ে সরকারি দলের এক শ্রেণীর নেতা-কর্মী। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মন্ত্রীর কাছে টিআর ও কাবিখা খাতে বরাদ্দ চেয়ে সংসদ সদস্যরা একের পর এক সরবরাহপত্র (ডিও) দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে মন্ত্রীর দপ্তরে এ ধরনের ডিওর স্তূপ হয়ে গেছে। কিন্তু চারদিক থেকে দুর্নীতির খবর আসায় মন্ত্রী বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করছেন।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার কাছেও অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। যারা এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন_এ প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। শতভাগ চাল বিক্রির ছাড়ের সুযোগ নিচ্ছেন কেউ কেউ_এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, শতভাগ নয়, কিছু ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছি। এ কর্মসূচির আওতায় যে কাজগুলো হতো, তা দরপত্রের মাধ্যমে নগদ টাকায় করা হবে।' দুর্নীতির কারণে কাবিখা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কি না, এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, কাজের স্বচ্ছতার জন্য কাবিখা বন্ধ করে দরপত্রের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে সব দলের লোকজন কাজ করার সুযোগ পাবে।
সূত্র জানায়, টিআরের আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলোর জন্য এক মেট্রিক টন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ মেট্রিক টন পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। এমপিদের জন্য এবার মোট এক লাখ ১১ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টনের বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর ৫০ শতাংশ বরাদ্দ ব্যবহারের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে না দেওয়ায় ৫৫ হাজার ৮০০ মেট্রিক টনের বেশি চাল নিয়ে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর বড় একটি অংশ ভুয়া প্রকল্প দিয়ে লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে টেস্ট রিলিফ খাতে চার লাখ মেট্রিক টন এবং কাবিখা খাতে তিন লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি পর্যন্ত টিআর খাতে শুধু এমপিদের নামে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৩০০ সংসদ সদস্যের প্রত্যেককে ৩৫০ মেট্রিক টন চাল এবং সংরক্ষিত আসনে মহিলা সংসদ সদস্যদের ১৫০ মেট্রিক টন করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে কাবিখার দুই লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
নির্দেশনাতেই গলদ : খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে টেস্ট রিলিফ ও কাবিখা কর্মসূচির প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের বিষয়ে ২০০৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত সংশোধিত পরিপত্র (সার্কুলার) জারি করা হয়। এতে সংসদ সদস্যদের জন্য টিআরের বিশেষ বরাদ্দের ৫০ শতাংশ জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজে ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাকি ৫০ শতাংশ দিয়ে কী করা হবে, এর কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। কাবিখার প্রকল্প শেষ হওয়ার পর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তাদের নূ্যনপক্ষে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ (কমপক্ষে পাঁচটি) এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নূ্যনপক্ষে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ (কমপক্ষে তিনটি) প্রকল্পের জরিপ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শত শত প্রকল্পের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি প্রকল্পের জরিপ হবে, তা-ও কাজ শেষে। আর এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের অসাধু অনেক চেয়ারম্যান, সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা পিআইওর (প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা) সহায়তায় কাগজপত্রে প্রকল্প দেখিয়ে ভুয়া বরাদ্দ নিচ্ছেন। বরাদ্দের চাল বিক্রি করে পরে চলছে টাকা ভাগ-বাটোয়ারা।
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন : স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও বিলুপ্ত স্থানীয় সরকার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ১০০ শতাংশ তদারকি করেও প্রকল্পের দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। আর এখানে তো গড়ে ২৫ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। এখানে সরকার একটা যুক্তি দেখায়, প্রকল্পের পিআইওতো রয়েছেনই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একজন পিআইওর হাতে তিন থেকে ৫০০ প্রকল্প থাকে। এ অবস্থায় পিআইওর পক্ষে কি মনিটর করা সম্ভব? এসব অব্যবস্থাপনার সুযোগে ভয়াবহ দুর্নীতি হচ্ছে। টিআর ও কাবিখার মাধ্যমে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের জন্ম হচ্ছে।
ভাগ দিতে হবে : নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, 'টিআর ও কাবিখার চাল বিক্রির টাকা নিজেরা পকেটে নিতে না পারলে এমপিদের সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীরা থাকবে কেন। তারা গত সাত বছর কিছুই পায়নি। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদে যাঁরা চেয়ারম্যান রয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ বিএনপির লোক। চেয়ারম্যানরা শেষবারের মতো লুটপাট করবে আর আমাদের নেতা-কর্মীরা বসে থাকবে, তা হবে না। দলের নেতা-কর্মীদের ভাগ দিতে হবে। তিনি বলেন, কর্মীদের আর্থিক সুবিধার কথা বিবেচনা করেই এ ধরনের ছোটখাটো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। অনেক সময় একই স্থানে প্রায় প্রতিবছরই প্রকল্প নেওয়া হয়।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গ্রামীণ অবকাঠামো কর্মসূচির আওতায় বাঁধ সংস্কার, নদী পুনর্খননসহ নানা ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয় কাবিখার মাধ্যমে। কিন্তু আইলার পর বাঁধ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে কাবিখার আওতায় যেসব বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাতে খুব বেশি কাজ হয়নি। যেসব স্থানে কাজ হয়েছে, সেগুলো খুবই নিম্নমানের। বরাদ্দের অধিকাংশই দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট করা হয়েছে। চলতি মৌসুমেও সংসদ সদস্যরা পুরনো নিয়মে কাবিখার আওতায় নানা ধরনের কাজের লক্ষ্যে বরাদ্দ চেয়ে পানিসম্পদমন্ত্রীর কাছে সরবরাহপত্র পাঠান।

No comments:

Post a Comment