Thursday 11 March 2010

পরিবেশ অধিদফতর দুর্নীতির বিষবৃক্ষ



Shamokal শুত্রুবার | ১২ মার্চ ২০১০ | ২৮ ফাল্গুন ১৪১৬ | ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৩১
হকিকত জাহান হকি
দুর্নীতির বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। এখান থেকে যে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্র নেওয়া ও ছাড়পত্রের নবায়নে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়া পথ নেই। এ অধিদফতরে ঘুষ লেনদেনের ঘটনা 'ওপেন সিক্রেট'। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও সরকার বদলের ঘটনা ঘটলেও এ প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি হ্রাস পায়নি। একজন নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে পরিবেশের ছাড়পত্র গ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালদের সঙ্গে কথা বলে ঘুষ লেনদেনের নানা তথ্য জানা গেছে। এখানে ঘুষ ছাড়া শিল্পের পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্র পাওয়া যায় না, ছাড়পত্রের নবায়নও হয় না। শিল্প-কারখানার নতুন ছাড়পত্রের জন্য চার-পাঁচ হাজার টাকা এবং প্রাপ্ত ছাড়পত্র নবায়নের জন্য দিতে হয় তিন-চার হাজার টাকা। কখনও কখনও আরও বেশি টাকা গুনতে হয়। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত পরিবেশ অধিদফতরে ঢোকার পর প্রথমেই চোখে পড়বে দালালদের মুখ। স্বল্প সময়ে ছাড়পত্র বের এবং ছাড়পত্রের নবায়নের কাজ করিয়ে দেওয়ার কথা বলে প্রথমে নিজেদের আয়ত্তে নেওয়া হয় গ্রাহকদের। এ ভবন সংলগ্ন চায়ের দোকানগুলোতেও দালালদের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। একজন শিল্প মালিক জানান, পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্র গ্রহণ ও ছাড়পত্র নবায়নের কাজের জন্য পরিদর্শকদের গাড়িতে চড়িয়ে কারখানায় নিয়ে যেতে হয়। দুপুরে ভালো করে খাওয়াতে হয়। হাত খরচের টাকা দিতে হয়। আবার গাড়িতে করে অফিসে পেঁৗছে দিতে হয়। পুরো কাজটা করার জন্য সেলামি
হিসেবে দিতে হয় চার-পাঁচ হাজার টাকা। এ ব্যাপারে ঢাকা বিভাগের পরিদর্শক মাহবুবুর রহমানের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, কেউ এ ধরনের কাজ করছেন কি-না তা তার জানা নেই।
ভোগান্তির শিকার আলমগীর হোসেন নামে এক শিল্প উদ্যোক্তা জানান, তিনি গাজীপুরের কালীগঞ্জ থেকে এসেছেন একটি পোলট্রি খামারের পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্রের জন্য। অধিদফতরের কাছেই একটি চায়ের দোকানে কথা হয় দালাল মোস্তফার সঙ্গে। তিনি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া এলাকার সংগ্রাম মেটাল লিমিটেডের ছাড়পত্র বের করে এনেছেন। তিনি দেখালেন এক কর্মকর্তার স্বাক্ষর করা পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্রের কপিটি। এ ছাড়পত্র বের করে দেওয়ার জন্য সংগ্রাম মেটালের মালিক আতাউর রহমানের কাছ থেকে তিনি ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে জানালেন। ছাড়পত্র বের করতে অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। বাকি টাকা রেখেছেন নিজের পকেটে।
স্বাস্থ্য ভালো শ্যাম বর্ণের এক লোক সদর্পে অধিদফতরের ভেতরে-বাইরে ঘোরাঘুরি করছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আরও একজন লোক। তারা কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য এসেছেন কি-না জানতে চাওয়া হলে অকপটে বললেন, 'না, আমরা একটি পার্টির কাজ করিয়ে দেওয়ার জন্য এসেছি। কোন পার্টি, কী কাজ_ জানতে চাইলে বলেন, নারায়ণগঞ্জের বিছমিল্লাহ কোল্ড স্টোরেজের পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্র বের করতে হবে। এ জন্য পার্টির কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্য থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি করা, যাতায়াত বাবদ খরচ হবে ৮-১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা থাকবে তার পকেটে।
ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সুকুমার বিশ্বাসের পিয়ন জিন্নাত মোল্লাকে পোলট্রি খামারের একটা ছাড়পত্র দরকার বলতেই তিনি বললেন, মুরগি কতগুলো। বললাম এক হাজারের বেশি। তিনি বললেন, আবেদনপত্রে এক হাজারের কম উল্লেখ করবেন, তাতে তাড়াতাড়ি ছাড়পত্র পাবেন। তখন আরেকজন দালাল আবদুর রহমান মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার ভাই ভাই রাইস মিলের পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্রের আবেদন নিয়ে কথা বলছিলেন এ পিয়নের সঙ্গে। কথা শোনার পর পিয়ন তাকে ও আমাকে নিয়ে গেলেন ঢাকা বিভাগের এক অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাছে। তিনি দু'জনকেই বুঝিয়ে বললেন, কাজ হবে। আসবেন। পরে জানা গেল পিয়নরা একেক সময় একেক কর্মকর্তার মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেন। কাজটা হলে ঘুষের টাকাও ভাগাভাগি হয়।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আনিসুল হক সমকালকে বলেন, 'অনৈতিক আর্থিক সুবিধা ছাড়া পরিবেশ অধিদফতরের কেউ কোনো কাজ করেন না বলে বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত অভিযোগ করছেন।' পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্র না পাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তা শিল্প স্থাপনের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে পারছেন না। অনেকের উৎপাদন শুরু করতে বিঘ্ন ঘটছে।
পরিবেশ অধিদফতরে ঘুষ, দুর্নীতি চলছে কি-না এ প্রশ্নের জবাবে অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. জাফর আহমেদ খান জানান, এ অধিদফতরে ঘুষ, দুর্নীতি, নানা অনিয়ম চলছে_ এ খবর তিনি নানাজনের কাছ থেকে শুনেছেন। ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধে এরই মধ্যে তিনি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
পরিবেশ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সুকুমার বিশ্বাস বলেন, অনেক সময় উদ্যোক্তারা পরিবেশের সব ধরনের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়ে অযৌক্তিকভাবে পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্রের দাবি করেন। পরিবেশের স্বার্থে কোনোভাবেই সেসব শিল্পে ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। তিনি আরও বলেন, পরিবেশ দূষণের দায়ে ঢাকা বিভাগে এ পর্যন্ত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ১৮৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতে বিচারাধীন আছে ১০৩টি; তদন্তাধীন ৩৭ ও নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৭ মামলা।

No comments:

Post a Comment