Thursday, 11 March 2010

পরিবহনে চাঁদাবাজির 'উৎসব'

শফিকুল ইসলাম জুয়েল
Kalerkantho ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ ফাল্গুন ১৪১৬, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৩১, ১২ মার্চ ২০১০
মন্ত্রী বলছেন, চাঁদাবাজি চলছে। পুলিশ বলছে, চাঁদাবাজি চলছে। মালিক, শ্রমিক, যাত্রী, চালক_সবাই চাঁদাবাজির কথা একবাক্যে স্বীকার করছেন এবং বলছেন, এটা বন্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশের পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এখন 'অসহনীয়' পর্যায়ে পেঁৗছেছে। কেউ কিছু করতে পারছে না। শুধু একজন আরেকজনের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। মাঝখান থেকে যাত্রীদের গুণতে হচ্ছে বেশি টাকা। আর সেই টাকা চলে যাচ্ছে অসাধু মহলের পকেটে।
নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজির অভিযোগ মেনে নিয়ে নিজেও বললেন, 'সারা দেশে ভয়াবহভাবে বেড়েছে পরিবহনে চাঁদাবাজি। এটা বন্ধে পদক্ষেপ নিয়েও তেমন সফল হতে পারিনি।'
তিনি বলেন, 'চাঁদাবাজি বন্ধ করে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। পরিবহন সেক্টর চলছে সেই ১৯৩৯ সালের নীতিমালার আলোকে তৈরি ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী। সময়ের প্রয়োজনে যার সংশোধন ও সংযোজন জরুরি। আমরা চারটি কমিটি করে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলোর পরিচালন ব্যয় মেটানোর জন্য সংগৃহীত টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলাম। পরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কারণে তা স্থগিত করে দিতে হয়।' মন্ত্রী মনে করেন, মালিক-শ্রমিকদের সব সংগঠন একসঙ্গে করে নীতিমালার আলোকে এই পরিচালন ব্যয় নির্ধারণ করে নির্দেশনা এবং ব্যত্যয় ঘটলে জেল জরিমানার ব্যবস্থা চালু করলে সব ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব।
মন্ত্রীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগ আমরাও জানি। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। অবশ্যই আমরা চাঁদাবাজির বিপক্ষে।' মন্ত্রীর উদ্যোগে কমিটি গঠন ও বাতিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আগামী রবিবার আমরা বৈঠকে বসব। ওই দিন সব বিষয়ে আলোচনা করে সময়োপযোগী সব ধরনের পদক্ষেপ নেব।'
হাইওয়ে পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) আনোয়ার কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, চাঁদাবাজির অভিযোগ আগের চেয়ে এখন কমেছে। পুলিশের যারা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বাসমালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে একটি বাসকে ঢাকায় পেঁৗছাতে রাজশাহী, নাটোর, বনপাড়া ও গাবতলী_এই চার পয়েন্টে ৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদা তোলা হয় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সমিতির নামে। চাঁদার ভাগ পুলিশেরও থাকে। ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেতে একটি বাসকে দিতে হয় ১৫০ টাকা। পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় আসার বাসকে সৈয়দপুর, রংপুর, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, বগুড়া, মহাখালী ও গাবতলী এই ছয় পয়েন্টে ৬০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যেতে দিতে হয় ১৭০ টাকা। দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা থেকে বাস ঢাকায় পেঁৗছাতে খুলনা, নওপাড়া, যশোর, কালিগঞ্জ, ঝিনাইদহ, মাগুরা পয়েন্টে চাঁদা দেয় ২৪৫ টাকা। আর ঢাকা থেকে খুলনা যেতে দিতে হয় ১০০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে একটি বাসকে অন্তত পাঁচটি স্থানে গুনতে হয় সাড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে দিতে হয় ১৫০ টাকা চাঁদা।
পরিবহন মালিকদের বেশ কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, চাঁদার এই বাড়তি টাকা পুষিয়ে নিতে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়। আসলে টাকাটা যায় যাত্রীসাধারণের পকেট থেকে। এখন যে হারে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে, তা না থাকলে অন্তত ২৫ ভাগ কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করা যেত।
পরিবহন মালিকদের ভাষ্য: বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং এস আর ট্রাভেলসের চেয়ারম্যান জি এম সিরাজ কালের কণ্ঠকে জানান, ১৫ বছরের ব্যবধানে পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের মালিক সমিতি এবং শ্রমিক ইউনিয়ন সরকারের ছত্রছায়ায় বেশিরভাগ সময় রসিদ ছাড়াই চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বগুড়ায় সর্বোচ্চ চাঁদাবাজি চলছে। মালিকদের আয়ের সিংহভাগই চাঁদার পেছনে খরচ হওয়ায় বারবার মালিকরা প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। তিনি মনে করেন, চাঁদা কমলে ভাড়া কমানোসহ যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়ানো সম্ভব হতো।
সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক তালুকদার সোহেল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'চাঁদার পরিমাণ যে হারে বাড়ছে তাতে মনে হয় পরিবহন ব্যবসা করাই আমাদের অপরাধ। সরকারকে সব ধরনের ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়ে ব্যবসা করি, অথচ পথে পথে গুনতে হয় টাকা।' তিনি মনে করেন, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য প্রত্যক্ষ নজরদারির মাধ্যমে নীতিমালা করে ঘোষণা দিয়ে দৈনিক চাঁদা প্রথা বন্ধ করে মাসিক কিংবা বার্ষিকভাবে নিদিষ্ট টাকা তোলার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
শ্যমলী পরিবহনের স্বত্বাধিকারী শ্যামল চন্দ্র ঘোষ বলেন, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ সালের শাসনামলে শেষের এক বছর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের সময় চাঁদাবাজদের দাপট কম ছিল। বিএনপি সরকার এলে চাঁদাবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। পরে তত্ত্বাধায়ক সরকারের আমলে কমে যায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতার আসার দুই-তিন মাস ভালোই ছিল। কিন্তু এখন এতটাই বেপরোয়া যে, বাসমালিকরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, 'এভাবে চলতে থাকলে আমাদের গাড়ি চালানো বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।'
ট্রাকে চাঁদা আরো বেশি : ট্রাক মালিক ও শ্রমিকরা জানান, রাজধানীসহ সারা দেশের মহাসড়কে চলাচলকারী ট্রাকে আরো বেশি চাঁদাবাজি চলছে। দিনের চেয়ে রাতের বেলায় এ চাঁদাবাজির হার বেশি। ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে একটি ট্রাককে আসা-যাওয়ায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা গুনতে হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে কমপক্ষে এক হাজার গাড়ি প্রতিদিন চলাচল করে। এ রুটের চালক মো: আব্দুর রশিদ জানান, দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম শহরে ঢুকতে দাউদকান্দি, চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, ফেনী, বারইহাট_এ পাঁচটি পয়েন্টে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতেই হয়। এ ছাড়া ছোটখাটো আরো ৭-৮টি পয়েন্টে ২০ থেকে ৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয়, যা বিভিন্ন ব্যক্তির নামে তোলা হয়। ঢাকা-সিলেট রুটে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ ট্রাক চলাচল করে। ঢাকা খুলনা রুটে চলে ১০০ থেকে ১৫০টি ট্রাক। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে পাঁচ শতাধিক ট্রাক। এসব রুটে মাল বহনকারী প্রতিটি ট্রাকের চালককেই প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া পুলিশ, বখাটে মাস্তানসহ অনেকের হয়রানিও সহ্য করতে হয়।
বাংলাদেশ আন্তজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, এ সরকার আসার কিছুদিন পর থেকে চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। রাতের বেলা যানজটহীন রাস্তায়ও ট্রাক থামিয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোনো লাভ হয়নি। তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী কমিটির সভাপতি নৌমন্ত্রী শাজাহান খানকেও আমরা বলেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।'
নৌপরিবহনেও রেহাই নেই: লঞ্চমালিক ও শ্রমিকরা জানান, ঢাকা থেকে শরীয়তপুরের ডামুড্যা পেঁৗছাতে একেকটি লঞ্চকে পথে চাঁদপুর, ইশানবালা, জালালপুর, চরমাইজারা, কোদালপুর ও পট্টিতে থামতে হয়। প্রতিটি স্থানে একেকটি লঞ্চকে প্রতি ট্রিপে গড়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ রুটে চলাচলকারী এমভি ঝাণ্ডা ও এমভি আওলাদ লঞ্চের সুপার ভাইজার রুহুল আমিন এ টাকাকে চাঁদা হিসেবে নয়, বকশিস হিসেবে দেওয়া হয় বলে স্বীকার করেন। এভাবে ঢাকায় আসার পথেও সমপরিমাণ টাকা গুনতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক লঞ্চমালিক জানিয়েছেন, ঢাকাসহ অন্য বড় নৌবন্দরগুলোতে লঞ্চ প্রতি ট্রিপে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় মালিক সমিতির নামে। তবে, এই টাকার কোনো ধরনের সুফল পাওয়া যায় না।
ঢাকা থেকে সারা দেশের দেড়শ রুটে ডবল ডেকার (বড় লঞ্চ) দুই শতাধিক লঞ্চ যাতায়াত করে।

No comments:

Post a Comment