Wednesday 10 March 2010

কম দামের ডাল বেশি দামে কিনছে টিসিবি

ফখরুল ইসলাম ও আয়নাল হোসেন | তারিখ: ১১-০৩-২০১০


বাজারে যখন ডালের দাম কমতে শুরু করেছে, টিসিবি সে সময় বেশি দামে ডাল কেনা শুরু করেছে। যারা কম দামে ডাল সরবরাহ করতে চেয়েছিল, তাদের বাদ দিয়ে বেশি দামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে এই ডাল কেনা হচ্ছে।
দেশে খুচরা বাজারে এখন ৮০ টাকা কেজি দরে ডাল পাওয়া যাচ্ছে। আর সরকার সেই ডালই কিনছে ১০০ টাকায়। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আমদানি করে নয়, স্থানীয় বাজার থেকে সেই ডাল সংগ্রহ করে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) দিচ্ছে। এর ফলে সরকারের অর্থ গচ্চা গেলেও লাভবান হচ্ছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি।
দানিয়া জামান অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এ ডাল কেনা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. আসাদুজ্জামান নিজেকে বাণিজ্যমন্ত্রীর দূরসম্পর্কের আত্মীয় বলে দাবি করেছেন। যোগাযোগ করা হলে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান গত মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের সবাই সবার আত্মীয়। এতে কী আসে-যায়। আর আত্মীয় বলেই কেউ ব্যবসা করতে পারবে না, এমনটা ভাবা ঠিক নয়।
টিসিবি সূত্র জানায়, গত ২৭ জানুয়ারি টিসিবিকে দানিয়া জামান অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস থেকে এক হাজার টন মসুরের ডাল সংগ্রহের নির্দেশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে শর্ত দেওয়া হয়, ডালের আকার হবে ২ থেকে ২ দশমিক ৭৫ মিলিমিটার। প্রতি কেজির দর ১০০ টাকা এবং ঋণপত্র (এলসি) খোলার ৩০ দিনের মধ্যে টিসিবির গুদামে ডাল পৌঁছাতে হবে। আমদানিসংক্রান্ত এসব শর্ত থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ ডালপট্টি থেকে ১০০ টন ডাল কিনে ৩ মার্চ বুধবার টিসিবির তেজগাঁওয়ের গুদামে তা পৌঁছে দিয়েছে। অর্থ পরিশোধের পর পর্যায়ক্রমে বাকি ৯০০ টন ডাল টিসিবিকে দেওয়া হবে বলে দানিয়া জামান অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, এর মধ্যে আবার দুই হাজার টন ডাল সংগ্রহে রিলায়ান্স ট্রেড ওয়েভ এবং জিএম এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। টিসিবির আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ জানুয়ারি টিসিবির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন জানায় প্রতিষ্ঠান দুটি। ২ দশমিক ৬ থেকে ৩ মিলিমিটার আকারের ডাল ৮৫ টাকা কেজি দরে সরবরাহের আবেদন করা হয়। এর তিন দিন পর, ৪ ফেব্রুয়ারি ওই দরে এক হাজার টন করে মোট দুই হাজার টন ডাল কেনার অনুমোদন দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একই পত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবিকে দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করারও নির্দেশ দেয়।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ডাল কেনাসংক্রান্ত অনুমোদনপত্রের কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানকে আবারও প্রস্তাব আহ্বানের নির্দেশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, ‘টিসিবি ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ৮৫ টাকা কেজি দরে দুই হাজার টন ডাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলেও ডালের দাম কমে যাওয়ায় প্রতি কেজি ৮০ টাকা নির্ধারণ সম্ভব বলে মন্ত্রণালয় মনে করে।’ টিসিবির চেয়ারম্যান মো. খলিলুর রহমান সাত সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রধান।
পরের দিন, ১৭ ফেব্রুয়ারি ডালের দর কমানো বিষয়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বৈঠক হয় টিসিবিতে। দুই প্রতিষ্ঠানকে ওই দিনই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে কুরিয়ারযোগে চিঠি পাঠানো হয়। এই চিঠি পরের দিন পৌঁছালে ওই দিনই (১৮ ফেব্রুয়ারি) টিসিবির চেয়ারম্যানের কাছে ৫০০ টন ৮০ টাকা কেজি দরে এবং বাকি ডাল ৮৩ টাকা কেজি দরে সরবরাহের আবেদন জানায় রিলায়ান্স ট্রেড ওয়েভ। ১৯ ফেব্রুয়ারি উভয় প্রতিষ্ঠানকেই টিসিবি জানিয়ে দেয়, কারও কাছ থেকেই তারা কোনো ডাল কিনবে না। বরং নেপাল, কানাডা বা তুরস্কের ডাল উত্পাদন মৌসুমে দাম কম থাকে বলে মৌসুমের সময়ই ডাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের কথা বলা হলেও দানিয়া জামান ফুড প্রোডাক্টস থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে ডাল কেনার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত অনুমোদনপত্রে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, এলসি খোলার ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য জাহাজীকরণ শুরু করতে হবে। টিসিবির গুদামে পণ্য পৌঁছানোর পর (পোস্ট ল্যান্ডিং ইনস্পেকশন) ঋণপত্র নিষ্পত্তি হবে। ঋণপত্র খোলার ৩০ দিনের মধ্যে মসুর ডাল টিসিবির গুদামে পৌঁছাতে হবে। এসব শর্ত দেওয়া হলেও তা অকার্যকর বলে সংশ্লিষ্ট লোকেরা মনে করেন। কেননা দানিয়া জামান ফুড প্রোডাক্টস স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করে ডাল দিচ্ছে, আমদানি করে নয়।
সূত্র জানায়, রিলায়ান্স ট্রেড ওয়েভ এবং জিএম এন্টারপ্রাইজ টিসিবিকে যে ডাল সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছিল, তার আকার ছিল ২ দশমিক ৬০ থেকে ৩ মিলিমিটার পর্যন্ত। আর দানিয়া জামান ফুড প্রোডাক্টস দিচ্ছে ২ থেকে ২ দশমিক ৭৫ মিলিমিটার আকারের ডাল। ডালের আকারের এই সামান্য পার্থক্যের জন্য এখন ডাল কিনতে টিসিবির খরচ পড়বে ১০ কোটি টাকা। কেজি ৮০ টাকা হলে এক হাজার টন ডাল কিনতে খরচ হতো আট কোটি টাকা।
যোগাযোগ করলে টিসিবির চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, ভালো মানের ডাল হওয়ায় দাম একটু বেশি পড়ছে। এর বাইরে কোনো কথা বলতে তিনি রাজি হননি। ভারপ্রাপ্ত বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন বলেন, বিষয়টি তাঁর অজানা। দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ইকরাম আহমেদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
ইকরাম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মসুর ডালের দাম দিন দিন কমছে। ১০০ টাকা দরের এই ডাল টিসিবি কত টাকা করে বিক্রি করবে সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।
রিলায়েন্স ট্রেড ওয়েভের অংশীদার মনির হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, টিসিবির আইন-কানুন আমদানিবান্ধব নয়। হঠাত্ করে টিসিবি জানিয়ে দেয়, এখন কোনো ডাল কেনা হবে না। অথচ তারাই আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে ডাল কিনছে। বিষয়টি বোধগম্য নয়।
দানিয়া জামান ফুড প্রোডাক্টসের মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কানাডা থেকে তাঁরা ডাল আমদানি করছেন। টাকা-পয়সা নিয়ে ঝামেলা করলে টিসিবির সঙ্গে ব্যবসা করবেন না প্রয়োজনে। তিনি দাবি করেন, বাণিজ্যমন্ত্রীই টিসিবির সঙ্গে ব্যবসা করতে তাঁকে রাজি করিয়েছেন। এর বেশি তিনি কিছু বলতে চাননি।
৮০ টাকার ডাল ১০০ টাকা কেজি দরে কেনা প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, নিম্নমানের নয়, বরং ভালো মানের ডালই বেশি দাম দিয়ে কেনা হচ্ছে। আর এখনই ডাল কেনার সময় উল্লেখ করে তিনি জানান, পাঁচ থেকে ছয় হাজার টন মসুর ডাল সংগ্রহ করা হবে। ১০০ টন মাত্র সংগৃহীত হয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, টিসিবিকে সক্রিয় ও কার্যকর করার কথা সবাই বলে। কিন্তু যখনই সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তখনই নানা দিক থেকে তার বিরোধিতা করা হচ্ছে।
টিসিবির প্রকাশ করা বাজার দর অনুযায়ী, গতকাল ঢাকার বাজারে তুরস্ক ও কানাডার ডালের দর ছিল ৭৫ থেকে ৯০ টাকার মধ্যে। নেপাল থেকে আনা ডালের মূল্য ১০২ থেকে ১০৮ টাকা। আর দেশি ডালের দর ৯৫ থেকে ১০০ টাকা।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-03-11/news/48024

No comments:

Post a Comment