নেসার উদ্দিন আহাম্মদ
বর্তমান সরকারের আমলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৭১ পদে নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে ৩ গুণ লোককে। শুধু এমএলএসএস, সুইপার, সিকিউরিটি গার্ড ও কুক/মশালচি পদে ৩৫১ জনকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। সূত্র আরও জানায়, এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী সমিতির আওয়ামী লীগ সমর্থিত এক নেতা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই নেতাসহ সংশ্লিষ্টরা একটি সুইপার পদের নিয়োগ বিক্রি করেছে ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, এবারের নিয়োগের জন্য তদবির ও সুপারিশ করতে বাদ পড়েননি মন্ত্রী, এমপি, সচিব, আমলা, রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকরাও।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মানা হয়নি মুক্তিযোদ্ধা বা প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত কোটার বিধান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হলেও ঢাকা মেডিকেলের তত্কালীন সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বজলে কাদের মন্ত্রীর নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গেছেন। হাসপাতালের কয়েকজন সাবেক কর্মচারী নেতা আশঙ্কা করছেন যাদের নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে তাদের সবাইকে কাজে যোগদান করতে না দেয়া হলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে। তা এড়ানোর একমাত্র উপায় নতুন করে ইন্টারভিউ নেয়া। হাসপাতাল সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ১৫ জানুয়ারি এক জরুরি সভায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী পদে লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি তদন্তের জন্য তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলের সাবেক পরিচালক তা উপেক্ষা করে তার বদলির আগেই গত ১৪ জানুয়ারি নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে যান।
এ ব্যাপারে গত ১ ফেব্রুয়ারি সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বজলে কাদেরের সঙ্গে আমার দেশ থেকে তার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ছাপানোও হয়ে গেছে।’ এর বেশি কিছু না বলে তিনি ফোনটি রেখে দেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অফিস আদেশ স্মারক নম্বর ঢামেকহা/প্রশা/যোগদান/২০১০/২৬১-এ দেখা যায় এমএলএসএস পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২৩৪ জনকে। অথচ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় ৯৮ পদের জন্য। ২৬৪ নম্বর স্মারকে সিকিউরিটি গার্ড পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৯ জনের। বিজ্ঞপ্তিতে এই পদের জন্য চাওয়া হয় ১৫ জন। ২৬৫ নম্বর স্মারকে সুইপার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৮১ জনকে। এই পদে চাওয়া হয় ৩২ জন। প্রায় প্রতিটি পদেই দুর্নীতি করা হয়েছে বলে সূত্র জানায়। হাসপাতালের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এটাকে বলছেন ডিজিটাল দুর্নীতি।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধার কোটা মানা হয়নি। এমনকি প্রতিবন্ধী কোটার বিধানও এক্ষেত্রে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
এদিকে হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আশঙ্কা করছেন, নিয়োগপত্র পাওয়া সবাইকে যদি নিয়োগ দেয়া না হয় তাহলে হাসপাতালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হিসেবে জানা যায়, প্রায় সবাই অর্থের বিনিময়ে নিয়োগপত্র নিয়েছে। ফলে যারা চাকরিতে যোগদান করতে পারবে না তারা মারমুখী হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেলের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী সমিতির সাবেক সভাপতি এমএ হান্নান বলেন, এবারের নিয়োগে চরম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। যদি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না এনে নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে হাসপাতালে চরম বিশৃঙ্খলা ঘটবে। যারা টাকার বিনিময়ে নিয়োগপত্র পেয়েছে তারাও মারমুখী হয়ে উঠবে।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির অষ্টম বৈঠকে ঢাকা মেডিকেলের নিয়োগ প্রক্রিয়া সঠিক হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। বৈঠকে বলা হয়, এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকায় তা সঠিক হয়নি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম। কমিটির সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোঃ শহীদুল হক মল্লিক জানান, তিনি গত ৪ ফেব্রয়ারি হাসপাতালে পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ১৫ জানুয়ারি নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়। মন্ত্রণালয় এই স্থগিতাদেশ তুলে না নেয়া পর্যন্ত তার করার কিছুই নেই। তিনি নিয়মের বাইরে কোন কাজ করতে পারবেন না বলে জানান। তিনি বলেন, এই নিয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। যদি ১৭১ জনের বেশি নিয়োগপত্র পেয়ে থাকে তাহলে নিয়োগ নিয়ে জটিলতা আরও বাড়বে।
৬ এপ্রিল বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে এক প্রেসব্রিফিং শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঢাকা মেডিকেলের নিয়োগের বিষয়ে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে সুপারিশ এসেছে তা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পদ মাত্র ১৭১টি। এর মধ্যে একজন মন্ত্রীই ২৫০টি সুপারিশ করেছেন। আবার একজন প্রার্থীর জন্য একাধিক মন্ত্রীর সুপারিশ এসেছে। এভাবে মন্ত্রীরই সুপারিশ এসেছে প্রায় ৫০০।
উল্লেখ্য, গত ২৬ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর ১৭১টি পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। আবেদনপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল ১০ ডিসেম্বর। ২৩ ডিসেম্বর মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়। আর তড়িঘড়ি করেই তা শেষ করা হয় ৩১ ডিসেম্বর।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/10/26841
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment