সৈয়দ মিজানুর রহমান
প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা স্পিনিং মিল ধ্বংস করতে এবার দেশের সুতার বাজার তুলে দেয়া হচ্ছে ভারতের হাতে। বস্ত্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্যিকভাবে সুতা আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়ার। কয়েক দিনের মধ্যেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সুতার মূল ব্যবহারকারী পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা ভারত থেকে অবাধে সুতা আমদানির দাবি না তুললেও হঠাত্ করেই বস্ত্রমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি উন্মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
এরই মধ্যে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রস্তাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে তৈরি ও নিট পোশাক খাতে শতভাগ রফতানিকারকরা বন্ডের আওতায় বেনাপোল দিয়ে সড়ক পথে সুতা আমদানির সুযোগ পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমদানিকারকদের কোনো শুল্কও দিতে হয় না। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে আমদানি উন্মুক্ত আছে। তবে ভারত দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল তাদের সুতা রফতানিকারকদের সুবিধার্থে সড়কপথে (বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে) সুতা আমদানি খুলে দেয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিলগুলো রাজি না হওয়ায় সেটি বন্ধ আছে।
ভারত থেকে অবাধে সুতা আমদানি হলে দেশের টেক্সটাইল মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ হিসেবে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সাবেক সভাপতি মোঃ শাজাহান গতকাল আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশ কাঁচামাল আমদানি করেই সুতা বানায়। কিন্তু ভারতে কাঁচামালের (তুলা) কোনো ঘাটতি নেই। এছাড়া ভারত টেক্সটাইল মিলগুলোকে সুতা রফতানির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে সুতা উত্পাদন খরচ প্রায় ৩০ ভাগ কম। এ অবস্থায় ভারত থেকে সুতা আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়া হলে ৬ মাসে দেশের সব টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যাবে।
দেশের টেক্সটাইল মিলগুলোর উত্পাদিত সুতার ৭০ ভাগ ব্যবহার করে স্থানীয় নিট কারখানাগুলো। আর ৩০ ভাগ সুতা আমদানি হয় ভারত থেকে। নিট পোশাক ও ওভেন গার্মেন্টস মালিকরা সুতা আমদানি করতে পারছেন সড়ক পথে। ফলে এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কার স্বার্থে সুতা আমদানি উন্মুক্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিএমএ সভাপতি আবদুল হাই সরকার বলেন, তাঁতিদের নামে সরকার ভারতের হাতে দেশের সুতার বাজার তুলে দিতে চাইছে। অথচ তাঁতিরা কখনোই সরাসরি সুতা আমদানি করেন না। তাদের এ ক্ষমতাও নেই। আর তাঁতিরা যে পরিমাণ সুতা ব্যবহার করেন তার কোনো ঘাটতি নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সম্প্রতি বিটিএমএ নেতাদের তার বাসায় ডেকে পাঠান। সেখানে কয়েকজন তাঁতি নেতাও উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী বিটিএমএ নেতাদের কাছে জানতে চান ভারত থেকে বাণিজ্যিকভাবে সড়ক পথে সুতা আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়া হলে তাদের (টেক্সটাইল মিল মালিকদের) কোনো সমস্যা হবে কিনা। জবাবে বিটিএমএ নেতারা এর নেতিবাচক দিক তুলে ধরে মন্ত্রীকে এ সিদ্ধান্ত না নেয়ার অনুরোধ জানান। তবে মন্ত্রী টেক্সটাইল মিল মালিকদের সাফ জানিয়ে দেন, ভারত থেকে সুতা আমদানি সহজ করতে বেনাপোল স্থলবন্দর খুলে দেয়া হবে। শিগগিরই বাণিজ্যিকভাবে সুতা আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা জানান মন্ত্রী।
জানা গেছে, ভারত থেকে সুতা আমদানিতে সব বাধা তুলে নিতে সম্প্রতি বস্ত্র মন্ত্রণালয় এনবিআরকে অনুরোধ করেছে। মন্ত্রী নিজেও এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোনে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। সরাসরি বস্ত্রমন্ত্রীর চাপেই এনবিআর স্থলপথে বেনাপোল দিয়ে সুতা আমদানি উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব গতকাল আমার দেশকে বলেন, স্থানীয় তাঁতিদের কথা চিন্তা করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।
ভারত থেকে সুতা আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়া ঠিক হবে না বলে মনে করছেন স্বয়ং ব্যবহারকারীরাই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোঃ ফজলুল হক বলেন, গত কয়েক মাসে সুতার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এটা হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুত্ সঙ্কটের কারণে। তিনি মনে করেন, টেক্সটাইল মিলগুলোর উত্পাদন ক্ষমতা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত কমে গেছে। তবে আরও কিছু কারণ থাকতে পারে সুতার দাম বাড়ার পেছনে। তবে এজন্য ভারত থেকে আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়ার যৌক্তিকতা নেই। এতে স্থানীয় মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিকেএমইএ সভাপতি মনে করেন, সুতার বাজার পরিস্থিতি দেখভাল করার জন্য একটি কমিটি করে সব সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব।
জানা গেছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার, টাঙ্গাইলসহ বেশ কিছু এলাকায় টেক্সটাইল মিলের উত্পাদনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। দিনে এসব এলাকার কোনো কারখানাতেই চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস-বিদ্যুত্ সরবরাহও হচ্ছে না। এতে মিলগুলোতে প্রতি মাসে ক্ষতি হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। উত্পাদনে বিপর্যয় নেমে আসায় অনেকের রফতানি কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে। সঙ্কট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরে অভিযোগ জানিয়েও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সরকারের এসব বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মিলগুলোর সমস্যার সমাধান দিতে না পারলেও ভারতের জন্য নিজেদের বাজার খুলে দিতে বেশি আগ্রহী একটি মহল।
বর্তমানে দেশে বেসরকারি খাতে টেক্সটাইল মিল আছে ৩৪২টি এবং সরকারি খাতে ২৩টি। সরকারি খাতের অধিকাংশ মিলই সার্ভিস চার্জে পরিচালিত হচ্ছে এবং বাকি মিলের উত্পাদন বন্ধ রয়েছে। বেসরকারি খাতের স্পিনিং মিল স্থানীয় বাজারের সিংহভাগ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রফতানিমুখী নিট পোশাকের জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্র উত্পাদনে ব্যবহৃত সুতার ৮২ শতাংশ পূরণে সক্ষম হচ্ছে।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/10/26753
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment