27/04/2010
কাদের গনি চৌধুরী
মন্ত্রী, এমপি ও সরকারি দলের প্রভাবশালীদের দেয়া তালিকা মতো দলীয় লোকদের চাকরি পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা না করায় খাদ্য অধিদফতরের তৃতীয় শ্রেণীর ১০ ক্যাটাগরির শূন্যপদে নিয়োগে ঢাকা বিভাগের পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে দিয়েছে সরকার। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সরকারি দলের সঙ্গে জড়িত নন এমন যোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে। প্রার্থীদের অনেকে গতকাল খাদ্য অধিদফতর ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে কী হতে যাচ্ছে এসব বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন।
ঢাকা বিভাগে খাদ্য অধিদফতরের তৃতীয় শ্রেণীর ১০ ক্যাটাগরির শূন্যপদে নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল বাতিলের নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, পরীক্ষা চলাকালে মন্ত্রী, এমপি ও স্পিকারের কার্যালয় থেকে চাকরি দেয়ার জন্য প্রচুর তদবির আসে। শুধু টেলিফোনেই নয়, অনেক মন্ত্রী-এমপি ডিও লেটারও পাঠান। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা কোনো তদবিরই আমলে নেননি। এ খবর জানাজানি হওয়ার পর মন্ত্রী-এমপিরা ফলাফল বাতিলের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।
সূত্র জানায়, মৌখিক পরীক্ষার জন্য গঠিত কমিটির প্রধান থাকার কথা ছিল ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ড. শওকত হোসেনের। কিন্তু পরীক্ষা কার্যক্রম যখন শুরু হয় সে সময় ড. শওকত ছিলেন বিদেশে। তাই অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোঃ মাসুদুর রহমানকে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আরসি ফুড, পিডব্লিউডির এডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার, কৃষি অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক ও ইডেন কলেজের একজন প্রফেসর। কমিটির সব সদস্য মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে, কোনো চাপের কাছে তারা নত না হয়ে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত করবেন। সেভাবেই তারা মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ শেষে ফলাফল তৈরি করেন। এ ফলাফল তৈরির দুইদিন পরই এলপিআরে যান পরীক্ষা কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোঃ মাসুদুর রহমান। এরই মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার ড. শওকত হোসেন দেশে ফিরে এলে পরীক্ষার ফলাফল তার হাতে তুলে দেন তারা। এদিকে সরকারের বিভিন্ন মহলের চাপে ওই ফলাফলের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেন ড. শওকত হোসেন। এতে বিপাকে পড়ে যায় মন্ত্রণালয়। চাপ আসে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের দাবি হচ্ছে তাদের দলের কারও চাকরি হয়নি। কাজেই এ ফলাফল সঠিক হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জের নেতারা অভিযোগ করেন যে, তাদের জেলা থেকে আওয়ামী লীগের যারা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তাদের কারও চাকরি হয়নি। তবে মৌখিক পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যাদের ব্যাপারে অনুরোধ এসেছে তারা সবাই তদবিরে চাকরি হবে এ ব্যাপারে আগে থেকেই শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন। ফলে প্রস্তুতি না নেয়ায় তারা ভাইভা বোর্ডে খুবই খারাপ করেন।
বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এ নিয়োগের ব্যাপারে কোনো প্রভাব না খাটানোর কারণে কমিটি অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে ফলাফল তৈরি করে। বিশেষ করে কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোঃ মাসুদুর রহমান এলপিআরে যাওয়ার প্রাক্কালে কোনো অনৈতিক কাজ করতে চাননি। কমিটির অন্য সদস্যরাও তাকে পুরোপুরি সাপোর্ট দেন। তাই সরকারের পক্ষ থেকে বারবার চাপ দেয়ার পরও কমিটি ফলাফল পরিবর্তন করতে রাজি হয়নি।
খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, খাদ্য বিভাগে চাকরি দেয়ার কথা বলে সরকারি দলের লোকেরা প্রচুর ঘুষ নেয়। তাদের তদবিরে কাজ হয়নি জানতে পেরে বিভিন্ন মহলে তারা নানা প্রচারণা চালান। বিশেষ করে তারা সরকারের বিভিন্ন মহলে প্রচার করতে থাকেন যে, পরীক্ষা কমিটি রাজনৈতিক কারণে ও ঘুষ নিয়ে আওয়ামী লীগ সর্মথকদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করেছে। সরকারের উচ্চ মহলকে এটি তারা বিশ্বাসও করাতে পেরেছেন।
সূত্র জানায়, সারাদেশে খাদ্য অধিদফতরে লোক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগে তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। এ বিভাগে অনিয়মের অভিযোগ করছে কেবল সরকারি দলের লোকেরা। অন্যান্য বিভাগে লোক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ঢাকা ছাড়া অন্যান্য বিভাগে লোক নিয়োগে ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছা পূরণ হওয়ায় সেসব বিভাগের মৌখিক পরীক্ষার ফল বাতিল করা হয়নি।
পরীক্ষা কমিটির প্রধান সাবেক অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোঃ মাসুদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, এখনও আমি সরকারি চাকরিতে কর্মরত আছি। তাই সংস্থাপন সচিবের অনুমতি ছাড়া মিডিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারি না, তবে এতটুকু বলব কমিটি মন্ত্রণালয়ের নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান ও গাইড লাইন মেনে অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে।
ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ড. শওকত হোসেন বলেন, এ পরীক্ষা নেয়ার সময় আমি দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে ফেরার পর প্রচুর অভিযোগ আসে। অভিযোগের কথাসহ আমি ফলাফল পাঠিয়ে দিই মন্ত্রণালয়ে। এরপর মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফলাফল বাতিলের। আপনার কাছে অনিয়ম হয়েছে বলে মনে হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযোগ এবেবারেই অহেতুক মনে হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সাল থেকে অধিদফতরের ১০টি ভিন্ন পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমবার পে-অর্ডার এবং দ্বিতীয়বার দরখাস্ত খোয়া যাওয়ার ঘটনায় পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। ২০০৬ সালে আবার নিয়োগের জন্য দরখাস্ত চাওয়া হয়। পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়। তবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে নিয়োগ দিতে না পারায় শেষ পর্যন্ত তাও বাতিল করা হয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উদ্যোগ নেয়া হলেও নিয়োগ শেষ করা যায়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্রুত নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নেয়। নতুন করে দরখাস্ত আহ্বানের পরিবর্তে বিগত সময়ে নেয়া আবেদনগুলোর ভিত্তিতে ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল লিখিত পরীক্ষা শেষ করা হয়। ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় গত বছরের ২৩ অক্টোবর। এর প্রায় দেড় মাস পর দেশের ছয়টি বিভাগে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/27/29366
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment