Thursday 22 April 2010

স্বাস্থ্য অধিদফতরের জমি আ’লীগ নেতাদের দখলে : পুলিশ ফাঁড়ি এখন দলীয় কার্যালয়



হাসান শান্তনু
স্বাস্থ্য অধিদফতরের জমিতে ঘর বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। মহাজোট সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তারা প্রায় ২ হাজার ঘর বানিয়েছেন। অধিদফতরের ঢাকার মহাখালীর জমিতে বানানো কাঁচা ও আধাপাকা এসব ঘর থেকে তারা প্রতি মাসে ভাড়া পাচ্ছেন কয়েক লাখ টাকা। অধিদফতরের জমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাজার, দোকান, অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নিয়মিত চাঁদা আদায় করছেন। চাঁদা দিতে কেউ রাজি না হলে পুলিশের ভয় দেখানো, এমনকি হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। নেতাদের নির্মিত বস্তিঘর থেকে চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। পুরো এলাকা ভাসছে মাদকের ওপর। জায়গা সঙ্কটের কারণে স্বাস্থ্য অধিদফতর নিজস্ব কেন্দ্রীয় ভবনসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ ভবন নির্মাণ করতে না পারলেও এসব জমি উদ্ধারের কোনো তত্পরতা নেই। অধিদফতরের কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় মাদক ব্যবসাকে চাঙ্গা করে তুলেছে। মহাখালীর ওই এলাকাজুড়ে সংক্রামক ব্যাধি, বক্ষব্যধি ও ক্যান্সার হাসপাতাল, আইসিডিডিআরবি, ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ, জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠানসহ সরকারের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের আশপাশ রাস্তা দখল হয়ে গড়ে উঠছে দোকান ও বস্তিঘর। মাদকের ব্যবসা ও অবৈধ দখলের ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশ। অন্যদিকে চাঁদাবাজদের দাপটে আতঙ্কিত স্থানীয় বাসিন্দারা।
পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে দলীয় কার্যালয় : মহাখালীর সাততলা মোড়ে তিন বছর আগে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার হুমায়ুন কবির একটি একতলা ভবন নির্মাণ করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের জমিতে এ ভবন পুলিশ ফাঁড়ির জন্য নির্মিত হয় বলে তখন তিনি দাবি করেন। বছর দুয়েক আগে ওই কমিশনার মারা গেছেন। এ ভবনটি এখন ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভবনের সামনে টানানো হয়েছে দলীয় সাইনবোর্ড। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই ভবনটি দখল করেন নেতারা। এ ভবন থেকে ভাড়া বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি পরিচালিত হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রকাশ্যে এলাকায় ফেনসিডিল, দেশি মদ, ইয়াবা ট্যাবলেটসহ নানাধরনের নেশার পণ্য বিক্রি, ছিনতাই, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ এ কার্যালয় থেকেই হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বাসিন্দা আমার দেশ-এর কাছে অভিযোগ করেন, দিনে এ কার্যালয়ে যারা আড্ডা দেয়, সন্ধ্যার পর তারাই ছিনতাই করে। গতকাল দুপুরে সরেজমিন কার্যালয়ে গেলে সোহেল, রাকিব, তারেক, সুজনসহ ৮/১০ জনকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। জানতে চাইলে তারা ‘ছাত্রলীগ কর্মী’ বলে নিজেদের পরিচয় দেন। কার্যালয়টি থেকে কোনো ধরনের ‘অসামাজিক কর্মকাণ্ড’ পরিচালিত হয় না বলেও তারা দাবি করেন।
ভাড়া নিচ্ছেন, চাঁদাবাজি করছেন যারা : মহাখালীর বিএমআরসি ভবনের পেছনে রয়েছে প্রায় এক হাজার কাঁচাঘর। বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়ধারী কেরু প্রায় ৩শ’ ঘরের ভাড়া নেন। অনেক ঘরই বাসিন্দাদের নিজের টাকায় নির্মিত। তবে সরকারি জমিতে নির্মিত বলে চাঁদা দিতে হয় কবির, রিপু, আকরামসহ একাধিক গ্রুপকে। তারা এলাকায় ‘আওয়ামী লীগের ক্যাডার’ নামে পরিচিতি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা মসজিদ, বাজার, নিকেতন বাজারের সব দোকান থেকে প্রতিদিন ছাত্রলীগ নেতারা চাঁদা আদায় করছেন বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। তারা বলেন, চাঁদা ওঠাবার কাজটা কর্মীরা করলেও এর পেছনে রয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। ৭তলা বস্তি থেকে চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি সেখানে মাদকের ব্যবসা করছেন সোহেল। এলাকায় তিনি ‘পুলিশের সোর্স’ ও সরকারি দলের নেতা হিসেবে পরিচিত। চাঁদা দিতে কেউ রাজি না হলে সোহেল মিথ্যা মামলার ভয় দেখান। বিএমআরসি ভবনের সামনের বস্তির বাসিন্দা সীমা বেগম অভিযোগ করেন, চাঁদা না দেয়ায় তার স্বামী পিংকু, ভাই তারেক, ভাগ্নে আমজাদকে চক্রান্ত করে মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছেন সোহেল। আইপিএইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের দোকান থেকে চাঁদা তুলছেন মোতালেব, মোতাসের, কানাচি রিপনসহ কয়েক আওয়ামী লীগ নেতা। কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ওই এলাকার সরকারি জমিতে কয়েক বছর ধরেই ঘর বানিয়ে এভাবে ভাড়া বাণিজ্য চলছে। ক্ষমতায় যারা থাকেন তারাই তা নিয়ন্ত্রণ করেন।
নিষ্ক্রিয় স্বাস্থ্য অধিদফতর : মহাখালীর যে ভবনে অধিদফতরের কার্যক্রম চলছে, সেটি আইইডিসিআর’র মালিকানাধীন বলে জানা যায়। অধিদফতরের নিজস্ব কোনো কেন্দ্রীয় ভবন নেই। জমি সঙ্কটের কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘হেলথ ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ মহাখালীতে নির্মাণ করতে পারেনি অধিদফতর। জটিলতার ফলে শেষপর্যন্ত ঢাকার সাভারে এই কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। অথচ মহাখালীতে অধিদফতরের বিশাল পরিমাণ জমি বেদখল হয়ে আছে। কি পরিমাণ জমি অন্যের দখলে এ তথ্য অধিদফতরের কাছে নেই। এসব জমি উদ্ধার করতেও প্রতিষ্ঠানটির গরজ নেই। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসন শাখার কর্মকর্তারা দখল বাণিজ্য থেকে ভাগ পাওয়ায় উদ্ধার অভিযান চালানো হচ্ছে না বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জমিগুলো এখন আওয়ামী লীগ নেতাদেরই দখলে। তাই অভিযান চালালেও লাভ হবে না।’ সম্প্রতি উচ্ছেদ অভিযান চালানোর অনুমতি চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে তিনটি প্রতিষ্ঠান চিঠি দিয়েছে বলেও জানা যায়। এসব বিষয়ে অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. শাহ মনির হোসেনের বক্তব্য জানতে গতকাল দুপুরে কার্যালয়ে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. একেএম মহিবুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে পারব না। প্রশাসন শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’ জানতে চাইলে প্রশাসন শাখার উপ-পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দিন হাওলাদার বলেন, ‘উচ্ছেদ শুধু স্বাস্থ্য অধিদফতর করবে কেন? যেসব প্রতিষ্ঠানের আশপাশ দখল হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানই তা করতে পারে। তারা ব্যর্থ হলে অধিদফতর থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ দলীয় চাপের কারণে অভিযান সম্ভব হচ্ছে না বলেও তিনি স্বীকার করেন। কি পরিমাণ জমি বেদখল তা জানতে চাইলে ডা. হাওলাদার বলেন, এ তথ্য আমাদের কাছে নেই, গণপূর্ত অধিদফতরে পাবেন।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/21/28358

No comments:

Post a Comment