Thursday 22 April 2010

মেরামতের নামে সীমাহীন দুর্নীতি : কলাপাড়ায় উপকূলীয় বাঁধে অল্পতেই ভাঙন




মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া
২০০৭ সালে সিডরের আঘাতে কলাপাড়ার ভেঙেপড়া উপকূলীয় বাঁধগুলো মেরামতের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত্ করা হয়। ফলে কিছুদিন যেতে না যেতেই অল্পদিনেই সেগুলোতে ভাঙন ধরে। পরে আইলার জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষতি হয় সেগুলোর। বর্ষা আতঙ্ক নিয়ে আসে মানুষের মাঝে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমেও সমুদ্র উপকূলীয় কলাপাড়ার লাখ লাখ মানুষের নিরাপত্তায় নেয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। পর পর দুটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার তাণ্ডবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলেও সেগুলো পুনর্নির্মাণ বা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়নি। ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে বাঁধসংলগ্ন অর্ধশতাধিক গ্রামের ১০ হাজার পরিবারের নিরাপত্তা। হুমকির মুখে পড়েছে এসব এলাকার কৃষি ব্যবস্থা। গত সিডরের জলোচ্ছ্বাসে যে বাঁধগুলো ভেঙে প্রাণহানি ও সম্পদহানি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আইলার জলোচ্ছ্বাসেও সেগুলো ভেঙে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়।
সরকারি হিসাব মতে, ঘূর্ণিঝড় আইলার জলোচ্ছ্বাসে সাড়ে চার কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে যায়। আংশিক ক্ষতি হয় অন্তত ৪৫ কিলোমিটার এলাকার বাঁধ। ১৫০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ও সাড়ে ১২ কিলোমিটার পাকা রাস্তারও ক্ষতি হয়। শুধু জলোচ্ছ্বাসের কারণে ১০ হাজার ৫শ’ ঘরবাড়ি ভেসে যায়। ক্ষতি হয় ২২ হাজার ৫২০টি ঘরবাড়ির।
কলাপাড়ার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাইলের পর মাইল এলাকার বেড়িবাঁধ ভাঙা। ভাঙন দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে গোটা এলাকা প্লাবিত হয় মাঝে মাঝেই। লবণপানি বাঁধের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অন্যদিকে ক্ষেতে লবণপানি জমে থাকায় কৃষকদের চাষবাদও বন্ধ হওয়ার পথে।
লতাচাপলী ইউপি চেয়ারম্যান আঃ বারেক মোল্লা আমার দেশকে জানান, এ ইউনিয়নে প্রায় ৮ কিলোমিটার বাঁধ এখনও ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে ইউনিয়নের ৪৮টি পোল্ডার সংলগ্ন খাজুরা, কুয়াকাটা, পানজুপাড়া, হোসেনপাড়া, দক্ষিণ মুসুল্লিয়াবাদ, মম্বিপাড়া গ্রাম মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বর্ষা মৌসুমের আগে এ ভাঙা বাঁধ মেরামত করা না হলে এ এলাকায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। এরই মধ্যে সাগরে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় জোয়ারের সময় বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। তিনি বলেন, খাজুরা পয়েন্টে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সিসি ব্লক ফেলার কাজ চললেও এখানেও এরই মধ্যে ভাঙন শুরু হয়েছে। তিনি জানান, জরুরিভিত্তিতে ভাঙা বাঁধ মেরামত করা না হলে এ বর্ষা মৌসুমে গোটা এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে সাগরের পানিতে। বন্ধ হয়ে যাবে চাষাবাদ। ঘরছাড়া হবে ৮/৯ হাজার মানুষ।
ধানখালী ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান তালুকদার বলেন, তার ইউনিয়নে দেবপুর থেকে পাটুয়া পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার বাঁধ গত সিডর ও আইলার জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হলেও বাঁধ মেরামতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি এ পর্যন্ত। ফলে ৫৪/এ পোল্ডার সংলগ্ন চালিতাবুনিয়া, গোলবুনিয়া, পাটুয়া, দেবপুর এলাকার ৫/৭শ’ পরিবার রয়েছে চরম আতঙ্কে।
এলাকাবাসী জানান, সিডরের পর কলাপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন বেড়িবাঁধ মেরামত করা হলেও ঠিকাদার ও পাউবোর কর্মকর্তাদের বড় রকমের দুর্নীতির কারণে সেগুলো কিছুদিন যেতে না যেতে ভাঙন ধরে। কলাপাড়া পৌর শহরের নাচনাপাড়া এলাকার বেড়িবাঁধ গত সিডরের জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যায়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাঁধটি নামমাত্র মেরামত করা হলেও আইলার জলোচ্ছ্বাসের প্রথম ফ্লতেই সেটি একই স্থানে ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এ বাঁধ প্রায় ৩০ ফুট ভেঙে গেছে। পরে আবার বাঁধটি মেরামত করা হয়। চরধুলাসার গ্রামের ৪৭/৩ পোল্ডারের চরধুলাসার বেড়িবাঁধও দায়সারাভাবে মেরামত করা হলেও অল্পতেই সেটি ভেঙে হাজার হাজার একর জমিসহ ঘরবাড়ি আইলার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়। বন্ধ হয়ে যায় ধুলাসারের সঙ্গে কুয়াকাটার সড়ক যোগাযোগ। লালুয়া ইউনিয়নের ৪৭/৪ পোল্ডারের বাঁধটিও সিডরের পর মেরামত করা হলেও এটিরও প্রায় ২শ’ ফুট এলাকা ভেঙে গেছে। নষ্ট হয়ে যায় প্রায় ৩ হাজার একর জমির ফসল। ধানখালী ইউনিয়নের দেবপুর বেড়িবাঁধের তিনটি পয়েন্ট থেকে ভেঙে গেছে। এ বাঁধও সিডরে ভেঙে যাওয়ার পর মেরামত করা হলেও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে অল্পতেই পানির তোড়ে ভেসে যায়। গৃহহারা হয় শত শত মানুষ। ৪৭/১ পোল্ডারের নিজামপুর এলাকার বাঁধ সিডরের জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে গেলেও তা উঁচু করা হয়নি। এ কারণে বাঁধের সিসি ব্লক উপচে আইলার জলোচ্ছ্বাসের গোটা এলাকা তলিয়ে যায়। ৫৪নং পোল্ডারের প্রায় ৭০ ফুট বাঁধ ভেঙে গেছে।
এলাকাবাসী জানান, তাদের প্রতিটি রাত কাটে এখন চরম আতঙ্কে। ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের সময় শোঁ শোঁ করে পানি প্রবেশ করে গোটা এলাকা প্লাবিত হয়। এলাকার শত শত মানুষের আর্তি, আমাদের বাঁচান। এ ভাঙা বাঁধ মেরামত করা না হলে তাদের সর্বস্ব হারাতে হবে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ লিয়াকত আলী আমার দেশকে জানান, সিডরের পর কিছু বাঁধ মেরামত করা হয়েছে। এখনও যেসব বাঁধ ভাঙা রয়েছে তা মেরামতের কাজ কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে। তবে এ বর্ষা মৌসুমে শুরু হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো আশ্বাস দিতে পারেননি।
এব্যাপারে পটুয়াখালী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/20/28279

No comments:

Post a Comment