Friday 9 December 2011

প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে দশ হাজার কোটি টাকা লুটপাট

জাহিদুল ইসলাম

গত অর্থবছরে (২০১০-১১) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সমাপ্ত প্রকল্পগুলোতে প্রাথমিক বরাদ্দের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। সময়মত কাজ শেষ না করে দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়িয়ে এ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এ সময়ে শেষ হওয়া ২৩৯টি প্রকল্পের মধ্যে ১৫৭টিরই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ২০১০-১১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, পরিকল্পিতভাবে এসব প্রকল্পের কাজ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পরে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি, ভূমি অধিগ্রহণে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে প্রকল্পের জন্য বাড়তি অর্থ নেয়া হয়েছে। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও প্রকল্প অনুমোদনে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে লুটপাটের অর্থ ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের প্রতিটিতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে গড়ে ৮৩ শতাংশ সময় বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত লেগেছে ১৩ থেকে ১৪ বছর। এসব প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে ১২ হতে ১৩ গুণ পর্যন্ত।
বাছবিচার না করে লাগামহীনভাবে প্রকল্প অনুমোদন দেয়ায় এসব প্রকল্প সময়মত
বাস্তবায়ন হয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাদের মতে এর ফলে সরকারি প্রকল্প থেকে সেবা পেতে বিলম্ব হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য প্রকল্পও বাধাগ্রস্ত হয়। এ অবস্থার নিরসনে রাজনৈতিক বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না নেয়ার পরামর্শ দেন তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, সঠিক সময়ে অর্থ ছাড় না হওয়া, বরাদ্দের অতিরিক্ত খরচ, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়া, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) দুর্বলতা, কারিগরি দক্ষতার অভাব, রাজনৈতিক কারণে প্রকল্প হাতে নেয়ার কারণে দেশে সরকারি বিনিয়োগের সুফল আসছে না।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১০-১১ অর্থবছরে মূল এডিপিতে ৯১৬টি প্রকল্পের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ১ হাজার ১৯৩টি প্রকল্প। এর বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২৬৮টি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণার জন্য নির্ধারিত ছিল। এর মধ্যে ৩০টি প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় আবার মেয়াদকাল বাড়ানো হয়েছে। তবে এর বাইরে অন্য একটি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করায় গতবছর মোট ২৩৯টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে।
সমাপ্ত প্রকল্পের মধ্যে বাস্তবায়নকাল বেড়েছে ১৫৭টির এবং ব্যয় বেড়েছে ৭৫টি প্রকল্পের। শুধু প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে এমন প্রকল্পের সংখ্যা ১২। আর ব্যয় না বাড়িয়ে শুধু বাস্তবায়নকাল বেড়েছে ৯৪টি প্রকল্পের, যা মোট সমাপ্ত প্রকল্পের ৩৯ শতাংশ। ব্যয় ও বাস্তবায়নকাল উভয়ই বেড়েছে এমন প্রকল্প ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশ প্রকল্পের।
তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে শেষ হওয়া ২৩৯ প্রকল্পের মেয়াদকাল ছিল গড়ে ৩ দশমিক ৫২ বছর। কিন্তু প্রকল্পগুলো শেষ হতে সময় লেগেছে গড়ে ৬ দশমিক ৪৪ বছর। এ হিসেবে প্রতিটি প্রকল্পে অতিরিক্ত সময় লেগেছে ২ দশমিক ৯২ বছর যা, মোট বরাদ্দ সময়ের চেয়ে ৮৩ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে প্রতিটি প্রকল্পের গড় প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ১২৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। কিন্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে লেগেছে গড়ে ১৬৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রতিটি প্রকল্পে গড়ে অতিরিক্ত ব্যয় ৪০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ হিসেবে ২৩৯টি প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের পল্লী সড়কে হালকা যানবাহন চলাচলযোগ্য সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পটি সংশোধন করে কয়েক দফায় মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়। ৯ বছর পর প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়েছে গত জুলাইয়ে। তবে এ প্রকল্পটিতে এরই মধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে ৩৮৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এ হিসেবে প্রকল্পটিতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৩ গুণ।
একই বিভাগের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি ১৯৯৮ সালে শুরু হয়। দুই দফায় সংশোধন করে ১৪ বছর পর এটি শেষ হয় গত জুনে। এ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৮৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। পরে সংশোধন করে বরাদ্দ দেয়া হয় ৭৫৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৫০০ কোটি টাকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পল্লী অঞ্চলে সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ৪০০ কোটি টাকার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়েছে ৪৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ৮২৭ কোটি টাকার বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেট জেলা প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৯৯৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
জানা যায়, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোতে সবচেয়ে বেশি দীর্ঘসূত্রতা অবলম্বন করা হয়েছে। ২০০২ সালে নেয়া ঘোড়াশাল তাপবিদ্যেকন্দ্রের ১ ও ২ নম্বর ইউনিট পুনর্বাসন ও আধুনিকীকরণ প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু প্রকল্পটির ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে সংশোধন করা হয়। দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় গত অর্থবছরে। ফলে ১১৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকার প্রকল্পে ব্যয় হয় ২৫২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
একই মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে আশুগঞ্জ বিদ্যুত্ কেন্দ্র কমপ্লেক্সের ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটের পুনর্বাসন ও আধুনিকায়ন প্রকল্পের জন্য ২০০০ সালে বরাদ্দ ছিল ৮৪৮ কোটি টাকা। কাজ শেষ না হওয়ায় সংশোধন করে এ প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয় ১ হাজার ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। একইভাবে ১৯৯৮ সালে শুরু করা সিলেট ৯০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড বিদ্যেকন্দ্র দুই দফায় সংশোধন করে ৫০৫ কোটি ৯২ লাখ টাকার প্রকল্প বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৭১৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি মাথায় না রেখে লাগামহীনভাবে প্রকল্প অনুমোদন দেয়ায় এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলেছিল এসব প্রকল্প। আর এ সময়ে বড় অঙ্কের মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে। এ অবস্থা নিরসনে রাজনৈতিক বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না নিয়ে চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব মোজাম্মেল হক খান বৃহস্পতিবার আমার দেশ- কে বলেন, কোনো কারণে সময়মত কাজ শেষ না হলে প্রকল্পের মেয়াদকাল বাড়াতে হয়। নতুন করে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির সময় নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য, শ্রমিকদের বেতন, জমি অধিগ্রহণের ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা হয়। এ অবস্থায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়। গত বছরে সমাপ্ত ঘোষিত কোনো প্রকল্পে অসঙ্গতি থাকলে তা দূর করার পাশাপাশি দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হবে বলে জানান আইএমইডি সচিব।
উল্লেখ্য, চরম অর্থ সঙ্কটেও একটার পর একটা উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় ৬৪টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া বিতর্কিত প্রকল্পগুলোতে। অর্থবছরের শুরুতেই সারা বছরের বরাদ্দের তিনগুণের বেশি প্রকল্প অনুমোদন দেয়ায় অন্যান্য প্রকল্পের অর্থায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে চলতি বছরের উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন আশঙ্কায় পড়েছে। এ অবস্থায় অসময়ে এডিপি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)

Wednesday 23 November 2011

একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে জনবল নিয়োগে জালিয়াতি : লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে ১৪শ’ কোটি টাকার এ প্রকল্প

এম এ নোমান

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে জনবল নিয়োগে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। দলীয় বিবেচনায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়া, এমনকি কোনো ধরনের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বাছবিচার না করে পাইকারি হারে শত শত লোক নিয়োগের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। গ্রামের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত ১৪শ’ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি এখন লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ প্রকল্পে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়োগবিধি অনুসরণ করা হয়নি। নিয়োগের জন্য আবেদন করেননি এমন ব্যক্তিকেও প্রকল্পের কর্মকর্তা হিসেবে শুধু দলীয় যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা দেশের ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি বলে জানান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নিয়োগ জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধানে এরই মধ্যে কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কার্যাবলির কেন্দ্রবিন্দু এবং প্রতিটি গ্রামকে একটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলে ২০০১ সালের ২ জানুয়ারি ২৪৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর আগেই মাঠপর্যায়ে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। ফলে বিগত বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির অভিযোগে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এসে বন্ধ হওয়া এ প্রকল্পটি আবার চালু করে। চার বছর মেয়াদের এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে ৬৪ জেলার ৪৮২ উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। পরে প্রকল্পের জন্য ৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে। একইসঙ্গে এই প্রকল্পের জন্য ৭ হাজার ৩৫৫ জনের জনবল নিয়োগেরও প্রস্তাব করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের আগেই সারা দেশে গণহারে লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়া হয়েছে।
জনবল নিয়োগে জালিয়াতি : প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সারা দেশে উপজেলা সমন্বয়কারী, মাঠসংগঠক ও কম্পিউটার অপারেটর কাম হিসাব সহকারী পদসহ অন্য পদগুলোতে কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই লোকবল নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়। নিয়োগ পাওয়ার জন্য আবেদন করেননি, আবেদন করলেও লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেননি এমন ব্যক্তিরাও শুধু দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পান। জেলা পর্যায় থেকে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ আসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। এসব নিয়োগের সঙ্গে সরকারের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় নিয়োগ অনুমোদনকারী পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের নিয়োগ প্রক্রিয়া বিষয়ে তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। গত ৩ অক্টোবর এ কমিটি প্রকল্পের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠায়।
তদন্তে জালিয়াতি প্রমাণিত : তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্বনির্দেশনা অনুযায়ী একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত উপজেলা সমন্বয়কারী, মাঠসংগঠক ও কম্পিউটার অপারেটর কাম হিসাব সহকারী পদে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থীদের সংরক্ষিত জীবনবৃত্তান্ত, নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষার খাতাপত্র, মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে চূড়ান্ত নিয়োগ তালিকার তুলনা ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এসব কাজ করতে গিয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজনের বিষয়ে খতিয়ে দেখা গেছে যে, তাদের আবেদনপত্র সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে ডকেট হয়ে আসেনি। প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ের রেকর্ডেও তাদের তালিকাভুক্তির কোনো তথ্য নেই। কারও কারও আবেদনের সঙ্গে ফর্ম ক্রয়ের রসিদ সংযুক্ত নেই। লিখিত পরীক্ষার হাজিরায় তাদের স্বাক্ষর নেই। নিয়োগপ্রাপ্তদের কয়েকজনের নাম লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তালিকায় নেই। মৌখিক পরীক্ষার হাজিরায়ও তাদের নাম নেই। মৌখিক পরীক্ষার মূল রেজাল্ট শিটে তাদের নাম নেই। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি যেহেতু স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন, সেহেতু প্রকল্পের জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে এত বড় জালিয়াতির বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা দ্বারা তদন্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মহোদয়কে অনুরোধ করা হলো।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, শুরু থেকেই এ প্রকল্পটি নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। প্রকল্পের পুরো টাকায় সরকারের নিজস্ব ফান্ড থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে। ফলে এতে দাতা গোষ্ঠী বা সংস্থাগুলোরও কোনো হস্তক্ষেপ বা তদারকি নেই। এ সুযোগেই পুরো প্রকল্পটি ঘিরে দুর্নীতির আখড়া তৈরি হয়েছে।

ডাক্তারদের পদোন্নতিতে নগ্ন দলীয়করণ : শত শত মেধাবী চিকিত্সক পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ায় ক্ষোভ

স্টাফ রিপোর্টার

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ডাক্তারদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে এবার নগ্ন দলীয়করণ হয়েছে। সোমবার রাত দুইটায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রায় দু’হাজার ডাক্তারের পদোন্নতির তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাদের একদিনের সময় দিয়ে গতকালের মধ্যেই মন্ত্রণালয়ে যোগদানের কথা বলা হয়। সে মোতাবেক পদোন্নতিপ্রাপ্ত দলীয় ক্যাডার চিকিত্সকরা গতকালই মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। বঞ্চিত চিকিত্সকের কেউ যাতে আদালতে যাওয়ার সুযোগ না পান সেজন্য তড়িঘড়ি যোগদানের কথা বলা হয়।
এ পদোন্নতি নিয়ে চিকিত্সকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে পিএসসি’র মাধ্যমে সরকারি ডাক্তারদের পদোন্নতি হতো। কিন্তু বর্তমানে আওয়ামী লীগ সমর্থক ডাক্তারদের সংগঠন স্বাচিপের সভাপতি মন্ত্রী হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পিএসসি নয়, ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটির (ডিপিসি) মাধ্যমে পদোন্নতি হবে। সে অনুযায়ী এ পদোন্নতি হয়েছে। চিকিত্সকদের মধ্যে যারা শিক্ষকতার জন্য উপযুক্ত তাদের আলাদা পরীক্ষা নেয়া হতো। এছাড়া পাবলিকেশন, জ্যেষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা দেখে পদোন্নতি দেয়া হতো। এবার এগুলো লঙ্ঘন করে শুধু দলীয় এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। ফলে শত শত মেধাবী চিকিত্সক পদোন্নতি থেকে বাদ পড়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতির এ নগ্ন দলীয়করণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ড্যাব। ড্যাব বলেছে, ডিপিসি’র মাধ্যমে যে প্রহসনের পদোন্নতি হয়েছে তা বাতিল করতে হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগকে দলীয়করণের উদ্দেশে স্বাচিপ নেতা বা সমর্থকদের প্রাধান্য রয়েছে পদোন্নতির তালিকায়। দেড় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন স্বাচিপ নেতারা পদোন্নতি পেলেও ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিত্সক পদোন্নতি পাননি। নিয়মবহির্ভূত এ পদোন্নতিতে দেশজুড়ে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়মশৃঙ্খলায় অবনতি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিলেকশন কমিটির এ পদোন্নতি সংক্রান্ত আদেশের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়ার কথাও উল্লেখ করেন কেউ কেউ। একই সঙ্গে পদোন্নতি সংক্রান্ত আদেশে চাকরি ছেড়ে দেয়া বরিশালের এক গাইনি চিকিত্সকের নাম থাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে।
ওয়েবসাইটে প্রদত্ত স্বাস্থ্য বিভাগের এ আদেশ এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সোমবার দেশজুড়ে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রায় দু’হাজার পদোন্নতিপ্রাপ্ত চিকিত্সকের মধ্যে বরিশাল বিভাগের ৫ জন রয়েছেন। এর মধ্যে নাজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. যোগেশ চন্দ্র রায়কে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক পদে, ভোলার চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আতোয়ার রহমান এবং বরগুনার চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন এএইচএম জহিরুল ইসলামকে একই পদে নিয়মিত করা হয়েছে। ভান্ডারিয়া থানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবদুল করিম শেখকে ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদফতরে সহকারী পরিচালক (অর্থ) এবং বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগে সহকারী পরিচালক চলতি দায়িত্বে থাকা ডা. খান মোস্তাক আল মেহেদীকে সহকারী পরিচালক পদে নিয়মিত করে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত এ আদেশে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ৫ চিকিত্সকই স্বাচিপ নেতা ও সমর্থক। অভিযোগ উঠেছে, বিভাগজুড়ে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হতে অনেক যোগ্য এবং সিনিয়র চিকিত্সককে বঞ্চিত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অপর এক আদেশে দেশজুড়ে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ৪৮৩ জন শিক্ষককে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের ১৫ জন চিকিত্সক রয়েছেন, যার ১১ জনই স্বাচিপ নেতা ও সমর্থক। বরিশালে গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) চিকিত্সক ডা. সেলিনা পারভিনকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাকি ১৪ জনকে সহকারী অধ্যাপক চলতি দায়িত্ব থেকে পূর্ণাঙ্গ সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
সহকারী অধ্যাপক চলতি দায়িত্ব থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত চিকিত্সকরা হলেন কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবির, ডা. রনজিত্ খান, মেডিসিন বিভাগের ডা. ভাস্কর সাহা, ডা. আনোয়ার হোসেন, ফার্মাকোলজির ডা. অধীর কুমার সাহা, অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের ডা. কামরুজ্জামান খান, ফরেনসিক বিভাগের ডা. আখতারুজ্জামান তালুকদার, গ্যাস্ট্রোলজির ডা. স্বপন কুমার সরকার, শিশু বিভাগের অসীম কুমার সাহা, এনাটমির ডা. গোলাম রহমান, প্যাথলজির ডা. ফায়জুল বাসার, নিউনেটোলজির ডা. তাহাসুনুল আমিন, হেপাটোলজির ডা. মো. জমসেদ আলম এবং মাইক্রো বায়লোজি বিভাগের ডা. শহিদুল ইসলাম।
এ আদেশে সহকারী অধ্যাপকের চলতি দায়িত্ব থেকে পূর্ণ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন নগরীর প্রতিষ্ঠিত গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. জি কে চক্রবর্তী। অথচ অনেক আগেই তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় তার পদোন্নতি নিয়ে হাস্যরসসহ নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে নগরজুড়ে। আর আদেশের তালিকায় তার নাম থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিলেকশন কমিটির দায়িত্ব পালনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
এদিকে পদোন্নতির তালিকা প্রকাশের পর পর সারাদেশে চিকিত্সক অঙ্গনে শুরু হয়েছে ক্ষোভ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিত্সক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ পদোন্নতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট অনিয়ম করা হয়েছে। অনেক যোগ্য ও সিনিয়র চিকিত্সককে বঞ্চিত করে অযোগ্য ও জুনিয়র চিকিত্সককে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বাচিপ নেতাদের লম্বা তালিকা দলীয়করণের প্রমাণ দেয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দাবি করা সরকারের অধীনে পদোন্নতির তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের কোটাও রাখা হয়নি বলে দাবি করেন অনেকেই। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, পদোন্নতির তালিকায় শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে দেড় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ৬ চিকিত্সক পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ ৫ বছর, ৮ বছর, ৯ বছর, ১০ বছর, ১২ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৪-১৫ বছর পর্যন্ত শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকার পরও পদোন্নতি হয়নি প্রায় ৩০ শিক্ষকের। অভিযোগকারীদের মতে, যোগ্যতা এবং সিনিয়র-জুনিয়রের বিষয়টি না মেনে নিয়মবহির্ভূত এ পদোন্নতির ফলে স্বাস্থ্য বিভাগে নিয়মশৃঙ্খলায় অস্থিরতা দেখা দেবে। পদোন্নতির এ আদেশের বিরুদ্ধে অনেকেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা করছেন বলেও জানান। শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের এক সাবেক অধ্যক্ষ পদোন্নতির ক্ষেত্রে একই অভিযোগ করে বলেন, এর আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষার মাধ্যমে এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে পদোন্নতি দেয়া হতো। কিন্তু এ সরকারের আমলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে এ পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ কমিটি প্রণীত নীতিমালাও মানা হয়নি।
পদোন্নতিতে নগ্ন দলীয়করণে ড্যাবের তীব্র প্রতিবাদ : ডিপিসির মাধ্যমে পদোন্নতির প্রকাশিত ফলাফলে ড্যাব কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. একেএম আজিজুল হক ও মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন এক যুক্ত বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ ও নগ্ন দলীয়করণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে স্বাচিপের সভাপতি মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে স্বাস্থ্য খাতে দলীয়করণের মহোত্সব শুরু হয়। স্বাচিপ প্রভাবিত প্রশাসন শুধু বিরোধীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বদলি এবং নানাভাবে হয়রানি করেই ক্ষান্ত হয়নি; সর্বশেষ ডিপিসি’র মাধ্যমে শুধু দলীয় আনুগত্যকেই বিবেচনায় নিয়ে যে পদোন্নতির ফল প্রকাশিত হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে মেডিকেল শিক্ষা ও চিকিত্সা ব্যবস্থায় ধ্বংসের আলামত দেখা যাচ্ছে। এই ডিপিসি’তে শুধু জ্যেষ্ঠতাই লঙ্ঘন করা হয়নি, পদোন্নতির জন্য যে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, প্রকাশনার প্রয়োজন তা বিবেচনায় আনা হয়নি। যেভাবে যোগ্য, অভিজ্ঞ ও দলনিরপেক্ষ শিক্ষকদের বঞ্চিত করে অযোগ্য-অনভিজ্ঞদের এ ডিপিসি’র মাধ্যমে দলীয় আনুগত্যের পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হলো তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই।
ড্যাব নেতারা এই অবৈধ ডিপিসি’র মাধ্যমে পদোন্নতির নামে যে প্রহসনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে, তা অবিলম্বে বাতিল এবং তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। পাশাপাশি মেডিকেল শিক্ষা ও চিকিত্সা ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে দলনিরপেক্ষ প্রশাসনের মাধ্যমে জ্যেষ্ঠতা, মেধা ও যোগ্যতার নিরিখে পদোন্নতির ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানাচ্ছি।

Monday 31 October 2011

শেয়ারবাজারে পতন অব্যাহত অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি



অর্থনৈতিক রিপোর্টার
কোনো উদ্যোগেই যখন পতন ঠেকানো যাচ্ছে না, তখন অর্থমন্ত্রীর ‘শেয়ারবাজার কীভাবে ঠিক হবে জানি না’—এমন মন্তব্যে আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি এখন শেয়ারবাজারে। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের জের ধরে গতকাল লেনদেনের শুরুতেই বাজারে বড় ধরনের ধস নামে। প্রথম এক ঘণ্টায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচকের পতন ঘটে প্রায় ১৯০ পয়েন্টের মতো। এ সময় ডিএসই সাধারণ সূচক ৫ হাজার ১১৮ পয়েন্টে নেমে আসে। মাত্র ৩টি ছাড়া সব কোম্পানির শেয়ারের দর কমে যায়। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা দরপতনের জন্য অর্থমন্ত্রীকে দায়ী করে অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কয়েকশ’ বিনিয়োগকারী ডিএসই চত্বরে বিক্ষোভ সামবেশ করে। এরপর সোয়া দুইটার দিকে মানববন্ধন কর্মসূচিতে এক হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেন। এর পর সূচক ‘রহস্যজনক’ভাবে বাড়তে শুরু করে। কিন্তু তা কিছু সময়ের জন্য। এরপর সূচকের পতন ঠেকানো যায়নি। আগের দিনের তুলনায় ৪৮ পয়েন্ট কমে দিনশেষে ডিএসই সাধারণ সূচক ৫ হাজার ২৫৮ পয়েন্টে এসে দাঁড়ায়। মঙ্গলবার ‘শেয়ারবাবাজার কীভাবে ঠিক হবে জানি না’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার পর পদে থাকার সব যোগ্যতা অর্থমন্ত্রী হারিয়ে ফেলেছেন বলে বিনিয়োগকারীরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, যে দেশের অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনো কিছু করতে পারেন না, তাকে আর ওই পদে রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনকে ‘রাজনীতিকীকরণ’ করা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তারও তীব্র সমালোচনা করেন ভুক্তভোগীরা। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তারা বলেন, আমরা পুঁজি হারিয়ে গত ১০ মাস আন্দোলন করছি। বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দাবি জানিয়ে আসছি।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি সেলিম চৌধুরী বলেন, অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজার নিয়ে বক্তব্যে তার অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার পর তার পদত্যাগ করা উচিত ছিল। বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনকে রাজনীতিকীকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা কাউকে ডেকে আনিনি। তারা নিজেরাই এসেছিলেন। যে কেউ আমাদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করলে আমরা তাদের স্বাগত জানাতেই পারি। অর্থমন্ত্রী নিজেও যদি আসতেন আমরা স্বাগত জানাতাম।
প্রসঙ্গত, গত রোববার থেকে বিনিয়োগকারীরা ডিএসই চত্বরে অবস্থান নিয়ে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন শুরু করে। কর্মসূচির প্রথম দিনেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, জেএসডির চেয়ারম্যান আ স ম আবদুর রবসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা সংহতি প্রকাশ করেন। এ কারণে এরপর থেকে বিনিয়োগকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। পুলিশের হয়রানিতে কোথাও বসতে না পেরে মঙ্গলবার কর্মসূচি স্থগিত করে বিনিয়োগকারীরা।
ইবিএল সিকিউরিটিজ হাউসে লেনদেনকারী ইকবাল খান রিপন নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, আমাদের এখানে কোনো রাজনীতি নেই। আমরা বাধ্য হয়ে আন্দোলন করছি। গত ৯ থেকে ১০ মাস পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা আন্দোলন করে আসছে। তখন কোনো রাজনৈতিক নেতা আসেননি। কিন্তু এ সময় আপনি (অর্থমন্ত্রী) শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য কী করেছেন। এখন বলছেন, শেয়ারবাজার কীভাবে ঠিক হবে জানি না। শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুট হয়ে যাওয়ার পর এ বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, কারসাজির সঙ্গে অর্থমন্ত্রী জড়িত।
আরপি সিকিউরিটিজ হাউসে লেনদেন করে থাকেন আসলাম ওয়াহিদ নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যারা সংহতি প্রকাশ করেছিলেন তারা তো ব্যবসায়ী নয়, রাজনৈতিক নেতা। আর রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিনিয়োগকারীদের পাশে দাঁড়ানো তো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে আন্দোলনকে রাজনীতিকীকরণ মন্তব্যের অর্থই হচ্ছে, তিনি রাজনৈতিক কালচার সম্পর্কে জানেন না।
ফারইস্ট সিকিউরিটিজে লেনদেনকারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, শেয়ারবাজারের জন্য আগামীতে ৩ কোটি ভোটার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যাবে। আমরা আওয়ামী লীগ করতাম। কিন্তু এখন আমরা আর এ দলকে সমর্থন জানাতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে বিনিয়োগকারীরা মহাসমাবেশের ডাক দিতে বাধ্য হবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা রাজনীতি করতে আসিনি, নেতা হতে আসিনি। বিভিন্ন উত্স থেকে আমরা অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছি। মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। এখন আমাদের ইক্যুয়িটি নেগেটিভ হয়ে গেছে। মার্কেট ঠিক হলে আমরা আন্দোলন করব না, আমরা চলে যাব।
ডিএসইতে আগুন আতঙ্ক : দুপুর ১২টার দিকে ডিএসইর এনেক্স ভবনের ৭ তলায় আনোয়ার সিকিউরিটিজ হাউসের সামনে ঝোলানো ইন্টারনেটের তারে আগুন দেখতে পায় বিনিয়োগকারীরা। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন হাউস থেকে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে আসে। অবশ্য আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে চন্দন নামে ডিএসইর একজন কর্মী অগ্নিনির্বাপণ গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে। এর ফলে কোনো ধরনের ক্ষতি হয়নি। ওই জায়গায় একটি দিয়াশলাইয়ের বাক্স পাওয়া গেছে বলে তিনি জানান।
বিক্ষোভ ও মানববন্ধন : শেয়াবাজারে সূচকের বড় ধরনের পতনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে হাজারখানেক বিনিয়োগকারী অংশ নেয়। বিক্ষোভকারীদের সব ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তুতে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিনিয়োগকারীরা অবিলম্বে তার পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের বিরুদ্ধেও স্লোগান দেন। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরেরও পদত্যাগ দাবি করেন তারা। বেলা সোয়া দুইটার দিকে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। ইত্তেফাক মোড় থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর পর্যন্ত এ মানববন্ধন বিস্তৃত হয়। কর্মসূচি চলাকালে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ ছিল।
পুঁজি হারিয়ে অসুস্থ এক বিনিয়োগকারী : শেয়ারবাজারে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলেও এখন তা মাত্র ৫৩ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাত্ পুঁজিবাজারে লাভের আশায় বিনিয়োগ করলেও তার বিনিয়োগের ৭৭ লাখ টাকাই হাওয়া হয়ে গেছে। লোকশানের এ ধকল সইতে না পেরে গতকাল আনোয়ার হোসেন নামে এ বিনিয়োগকারী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি শেষ হয়ে গেছি। আমাকে গুলি করুন। এক সময় তিনি অসুস্থ হয়ে যান। জানা গেছে, শেয়ারবাজারে পুঁজি হারানোর কারণে তিনমাস ধরে বাসায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। স্ত্রী-সন্তানদেরও খবর নিতে পারছেন না। বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি।
বাজার পরিস্থিতি : গতকাল দিনের শুরুতে সূচকের বড় ধরনের দরপতন হলেও দিনশেষে ৪৮ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট বেড়ে ডিএসই সাধারণ সূচক ৫ হাজার ২৫৮ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৫৫টি কোম্পানির মধ্যে ১০০টির দর বাড়লেও কমেছে ১৪২টির। অপরিবর্তিত ছিল ১৩টির দর। দিন শেষে সূচকের পতন হলেও লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। আগের দিনের তুলনায় ৬৭ কোটি ২০ লাখ টাকা বেড়ে দিন শেষে ২৭৭ কোটি ৭১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে।
মার্জিন ঋণের শর্ত শিথিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ : পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের পথ সুগম করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মার্জিন ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল করার ইঙ্গিত দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কোনো ব্যাংক মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ করলে তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো আপত্তি নেই। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিলের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আবেদন করলে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিবাচকভাবে তা বিবেচনা করবে। তাছাড়া ব্যাংক বা তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলো মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ করলেও এতে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকগুলো বা তাদের সহযোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (সাবসিডিয়ারি) যে মার্জিন ঋণ দেয়, এর সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বিধিনিষেধ নেই। ব্যাংকগুলো নিজস্ব বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদ মওকুফ করতে পারে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগকৃত অতিরিক্ত অর্থ নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনার সময়সীমা ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইনে বর্ণিত নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। আজ বৃহস্পতিবার ব্যাংকাররা বৈঠক করে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে বলে জানা গেছে।
নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাংক তার মোট দায়ের ১০ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। তবে গত বছর ব্যাংকগুলো নিয়ম ভেঙে দুই/তিন গুণ বেশি বিনিয়োগ করে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর গড় বিনিয়োগ তাদের দায়ের ৪ শতাংশের মতো।

Sunday 2 October 2011

এমপি অধ্যক্ষ মতিউরের সপরিবারে দখলবাজিযাঁরা ভোট দিয়ে অধ্যক্ষ মতিউর রহমানকে সংসদে পাঠিয়েছেন অভিযোগ তুলছেন তাঁরাও। এলাকাবাসী বলছে, এমপি ও তাঁর পরিবারের দুই সদস্যের অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার রহস্য হচ্ছে অনিয়ম-দু















শফিকুল ইসলাম জুয়েল, ময়মনসিংহ থেকে ফিরে
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলেছিলেন, তাঁর একটি গরুর খামার আছে। এটিই তাঁর আয়ের একমাত্র উৎস, পরিবারের সদস্যদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। ওই সাক্ষাৎকারে নিজেকে সৎ দাবি করে মতিউর রহমান বলেন, তিনি রিকশা-ভ্যানে চলাফেরায় অভ্যস্ত_এমপি নির্বাচিত হতে পারলে জনগণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন। আর আওয়ামী লীগের এমপি হওয়ার পর আড়াই বছরে তিনি এখন বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক। এক কোটি ২২ লাখ টাকায় কিনেছেন একটি প্রাডো, ৩০ লাখ টাকায় একটি ভঙ্ িওয়াগন গাড়ি। বাড়ির প্রতিটি ঘরে লাগিয়েছেন এসি। ঘরে তুলেছেন এলসিডি টিভিসহ প্রায় ১০ লাখ টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক আসবাবপত্র।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে মতিউর রহমানের ভাই ও আফাজ উদ্দিনের সম্পদের বিবরণ জানতে চাওয়া হয়। আফাজ তাঁর আইনজীবী অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান খোকনের মাধ্যমে দেওয়া হিসাবে বলেন, তাঁর দোচালা টিনের ছোট একটি বাড়ি, ১২টি মুরগি, আটটি হাঁস, ছয়টি ছাগল আছে। নগদ অর্থ নেই। ভাই এমপি হওয়ার পর আফাজ নামে-বেনামে কিনছেন লাখ লাখ টাকার জমি। ঢাকার উত্তরায় প্রায় ৮০ লাখ টাকায় কিনেছেন অত্যাধুনিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। তিনি প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার না করলেও প্রায় সময় অন্তত ১৫ থেকে ২০টি মোটরসাইকেলে মহড়া দিয়ে চলাচল করেন।
একইভাবে এমপির ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর ছেলে মুহিতউর রহমান শান্ত এবং পিএস সাঈদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যাঁরা ভোট দিয়ে মতিউর রহমানকে সংসদে পাঠিয়েছেন, অভিযোগ তুলছেন তাঁরাও। এলাকাবাসী বলছেন এমপি ও তাঁর পরিবারের দুই সদস্যের এই অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার রহস্য হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি, দখল-চাঁদাবাজি এবং টেস্ট রিলিফ (টিআর), কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচির অর্থ লুট।
কাজ না করেই অর্থ পকেটে : গত সপ্তাহে টানা চার দিন ময়মনসিংহ সদর এলাকায় অনুসন্ধান করে ক্ষমতাসীন দলের এমপির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ পাওয়া যায়। এলাকাবাসী বলছে, এমপি, তাঁর ছেলে শান্ত ও ভাই আকুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফাজ উদ্দিন ক্ষমতার ত্রিমুখী অপব্যবহার করছেন। তাঁদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলেও কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। রাস্তা ও ভবন নির্মাণের অধিকাংশ কাজই বাজার দরের দ্বিগুণেরও বেশি মূল্যে হাতিয়েছেন এবং কাজ না করেই অর্থ তুলে আত্মসাৎ করেছেন এমপির ভাই আফাজ উদ্দিন।
'দাপুনিয়া-বাড়েরারপাড় কাঁচা-পাকা রাস্তাটিতে গত আড়াই বছরে এক কোদাল মাটিও পড়েনি। মেরামত হয়নি ভেঙে পড়া ব্রিজগুলো। ফলে রাস্তায় এখন উঁচু-নিচু গর্ত, কোথাও কোথাও হাঁটুপানি আর পিচ্ছিল কাদার ছড়াছড়ি। ফলে গাড়ি দূরের কথা, রিকশা-ভ্যানে চলাচল করা দায়। রাস্তাটির কারণে বাড়েরারপাড় গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ হাসপাতাল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সদরে যেতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়।' কালের কণ্ঠকে বলছিলেন দাপুনিয়া-বাড়েরারপাড় গ্রামের বাসিন্দা ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সাবেক ডেপুটি প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা কবীর আহমেদ।
পরে খোঁজ নিয়ে ও এলজিইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দাপুনিয়ার এ রাস্তাটি সংস্কারের লক্ষ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছরে এলজিইডি ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ১৫ টাকা বরাদ্দ দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমইঅ্যান্ডএমইকে। নির্দেশনা ছিল, ২০০৯ সালে ৯ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে ২০১০ সালে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাস্তাটি সংস্কারের। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাত্র ১৫ শতাংশ কাজ করেই পুরো বিল তুলে নিয়েছে। জানা যায়, ঠিকাদারি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন। তবে মতিনের ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কাজটি নিয়েছিলেন এমপির ভাই আফাজ উদ্দিন।
ময়মনসিংহের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও পরপর তিন বছর জেলার সর্বোচ্চ করদাতার পুরস্কার পাওয়া ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চু ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'সরকার ক্ষমতা নেওয়ার প্রথম দিকে কিছু দরপত্রে অংশ নিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও কাজ পায়নি আমার প্রতিষ্ঠান। প্রতিবাদ করায় এমপির ভাই ও ছেলের সন্ত্রাসীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। বিচারের দাবিতে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও মামলা করতে পারিনি, এমনকি জিডিও নেয়নি পুলিশ। সর্বশেষ নিরুপায় হয়ে ময়মনসিংহের কাজে অংশ নেওয়া ছেড়ে এখন কিশোরগঞ্জ-জামালপুরে প্রতিযোগিতায় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ করছি।'
গত ২৩ আগস্টের এলজিইডির কাজের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএস প্রাইম ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এইড আজামতপুর পূর্বপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন সংস্কারের কাজ পায়। কাজটি ২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারির মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা থাকলেও মাত্র ২৫ শতাংশ কাজ করেই ১৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বারিরা উজানপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন সংস্কারের কাজ সমপরিমাণ অর্থে ও একই সময়ের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা ছিল, কাজ না করেই পুরো টাকা তোলা হয়। একই প্রতিষ্ঠান আকুয়া ফিরোজ লাইব্রেরি মোড় থেকে মাসকান্দা পাড়াইল রাস্তা উন্নয়নের জন্য ১৮ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৮ টাকা তুলে নিলেও কাজ করেছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। এ কাজটি ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর শুরু করে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর শেষ করার নির্দেশনা ছিল। প্রতিষ্ঠানটি আকুয়া নাজির ব্যাপারীর রাস্তার কাজ পেলেও মাত্র ৩৫ শতাংশ শেষ করেই ৩১ লাখ ৯২ হাজার ২৩৩ টাকা তুলে নিয়েছে। এ কাজটি ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর শুরু করে গত বছরের ৮ আগস্ট শেষ করার নির্দেশনা ছিল। এসব কাজ এমপির ভাগ্নে বুলবুলের প্রতিষ্ঠানের নামে হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করেছেন এমপির ভাই আফাজ উদ্দিন।
পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনের মালিকানাধীন এমইঅ্যান্ডএমই প্রতিষ্ঠান সদর উপজেলাধীন দাপুনিয়া বাড়েরারপাড় রাস্তা উন্নয়নের জন্য ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ১৫ টাকা তুলে নিলেও কাজ করেছে মাত্র ১৫ শতাংশ। এ কাজটি ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর শুরু করে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর শেষ করার নির্দেশনা ছিল। একই প্রতিষ্ঠান চোরখাই ভাবখালী পুরাতন বাজার হয়ে ভাবখালী ইউপি সড়ক মেরামতের কাজ নিয়ে মাত্র ৬০ শতাংশ শেষ করেই পুরো বিলের ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিও নিয়ন্ত্রণ করেন আফাজ উদ্দিন।
আফাজ উদ্দিনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সব্যসাচী এন্টারপ্রাইজ এলজিইডির আওতাধীন আইআরআইডিপি প্রজেক্টে ফুলবাড়িয়া রোড থেকে খলপা (আর্মি বাইপাস) পর্যন্ত কার্পেটিংয়ের জন্য কাজ পেয়ে মাত্র ৪০ শতাংশ শেষ করেই ৩৫ লাখ ১৭ হাজার ২১৭ টাকা তুলে নিয়েছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর দেওয়া কাজটি চলতি বছরের ২০ জুলাই শেষ করার নির্দেশনা ছিল। একই প্রতিষ্ঠান একই সময়ে কাজ শেষ করার নির্দেশনা নিয়ে মোড়লপাড়া থেকে চারপাড়া সড়ক সংস্কারের কাজ পায়। কিন্তু মাত্র ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ করেই পুরো বিলের ২৪ লাখ ২৫৭ টাকা তুলে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এলজিইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব প্রকল্পের কাজ বাকি না থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।
সরকারি জমি দখল : ১ দশমিক ১৫ একর খাসজমির দখল নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান একাডেমী (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) এই নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমপি নিজের নামেই প্রতিষ্ঠানটি করেছেন। পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধিত) আইন, ২০১০ লঙ্ঘন করে জলাশয় ভরাটের পর ভবন নির্মাণ করা হয়। এরই মধ্যে জমি বরাদ্দ নেওয়ার প্রায় সাড়ে তিন মাস পার হলেও মূল্য বাবদ ১২ কোটি ৫২ লাখ ৬৬ হাজার চার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি এমপি। অথচ এরই মধ্যে চালু করা হয়েছে স্কুল-কলেজ। ২০০৬ সালে এই জমি শহীদ জিয়াউর রহমান টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের নামে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. তৌফিকুল আজিম ১৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় বরাদ্দ নেন। সেই জমি এখন বর্তমান এমপি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশসহ বিশেষ তদবিরের মাধ্যমে নিজের নামের প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ নেন।
আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ অধ্যক্ষের জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের ১৫ শতাংশ জমির ওপর স্থাপিত বাড়িটিতে ১৯৬৯ সাল থেকেই বসবাস করে আসছেন কলেজটির প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। অথচ ২০০২ সালের ৩০ জুন তিনি কলেজ থেকে অবসর নেন এবং শহরে এমপির নিজস্ব বাড়িও আছে। এদিকে কলেজ ক্যাম্পাসের বাড়ি বরাদ্দ না পেয়ে বর্তমান অধ্যক্ষ এ কে এম আজহারুল ইসলাম এখন থাকেন অন্য স্থানে।
এমপি মতিউর রহমান ও স্ত্রী নুরুন্নাহার শেফালীর নামে আকুয়া মৌজায় ৬৫ শতাংশ অর্পিত সম্পত্তি অবৈধ দখলদারের কাছ থেকে পানির দরে কিনে টিনের বাউন্ডারি দেওয়া হয়েছে। এখন খারিজের চেষ্টা চলছে। কিন্তু অর্পিত সম্পত্তি ব্যক্তি নামে খারিজ করতে রাজি হননি সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তা। ফলে বিষয়টি ঝুলে আছে।
দাপুনিয়া জেলা পরিষদের মালিকানাধীন প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের তিন একর খাসজমি (দাপুনিয়া বাজারসংলগ্ন ফুলবাড়িয়া সড়কঘেঁষা) দখল করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে প্রায় দেড় বছর ধরে দখলে রেখেছেন এমপির ছোট ভাই আফাজ উদ্দিন।
এমপিপুত্র শান্ত নির্বাচনের আগে জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এখন চলেন রাজকীয় ভঙ্গিতে। জানা যায়, ডেঙ্গু ব্যাপারী রোডের প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের ৭ শতাংশ অর্পিত সম্পতি দখলে নিয়ে নিজের নামে দলিল করে নিয়েছেন এমপিপুত্র শান্ত। রামকৃষ্ণ মিশন রোডে জাতীয় পার্টির নেতা এম এ হান্নানের মালিকানাধীন প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের ৮ শতাংশ জমি বিজ্ঞান কলেজের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দখল করে নিয়েছেন শান্ত।
ময়মনসিংহ পৌরসভার কয়লাওয়ালাপাড়ার মোড়ে বাদল ভৌমিকের মালিকানাধীন প্রায় ছয় কোটি টাকা মূল্যের ২০ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছেন এমপিপুত্র। ময়মনসিংহ সদরের ছোট বাজারের ৬৩ শতাংশ অর্পিত সম্পত্তিও দখল করেছেন শান্ত। ব্যক্তিমালিকানাধীন হিসেবে শান্তর নামে রেজিস্ট্রি করা এ জমির দলিলে দুই কোটি টাকার সম্পত্তির দাম ধরা হয়েছে মাত্র ১৫ লাখ টাকা। এটি জেলা প্রশাসন এক বছর ধরে তদন্ত করে যাচ্ছে। গত বছরে বাসাবাড়ি এলাকায় হকার্স মার্কেটের ১৫ শতাংশ জমি দখল করে ১২টি ঘর নির্মাণের পর দোকান হিসেবে প্রতিটি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকায় বিক্রি করেন এমপিপুত্র শান্ত। পরে জেলা প্রশাসনের অভিযানে অবৈধ স্থাপনা হিসেবে সেসব দোকান ভেঙে দেওয়া হয়; যদিও দোকানের মালিকদের কেউই এখনো টাকা ফেরত পাননি, যাঁদের অনেকেই এখন নিঃস্ব।
অভিযোগ উঠেছে, শান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেও জমির দখল নিয়েছেন। এমপির আকুয়া এলাকার বাড়ি যাওয়ার পথে জেলা প্রশাসনের মালিকানাধীন প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের ৫ শতাংশ জমি দখল করে তিনটি বড় ঘর নির্মাণসহ 'প্রতিশ্রুতি ক্রীড়াচক্র' ক্লাবের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন তিনি। এর প্রায় ১০০ গজ দূরে দুই কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ১০ শতাংশ জমি দখল করে ঝোলানো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা একাডেমীর সাইনবোর্ড। মুক্তিযোদ্ধা একাডেমীর ওই অফিসে পর পর তিন দিন ঘুরেও তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
এ ছাড়া সরকারি জমি দখলের চেষ্টায় দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে বাসাবাড়ি এলাকার ২৫ শতাংশ খাসজমি উত্তরণ বহুমুখী সমিতির নামে এবং আরো ২৫ শতাংশ খাসজমি ডিজিটাল বহুমুখী সমবায় সমিতির নামে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
শান্তর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সারিন্দা রেস্টুরেন্টের মালিক সুরুজ্জামানের ছেলে মাকসুদ তাঁদের মালিকানাধীন ব্রিকফিল্ডের পাশের জেলা প্রশাসনের (আকুয়া মৌজা) প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের ৬৬ শতাংশ খাসজমি দখল করে টিনের বাউন্ডারি দিয়ে এখন নিজ নামে রেজিস্ট্রির চেষ্টা করছেন।
দুস্থদের অর্থ লুট : ময়মনসিংহ সদর আসনের নামে গত আড়াই বছরে টিআর, কাবিখা, কাবিটার জন্য বরাদ্দ করা অর্থের বেশির ভাগই আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি কাবিটার ৯০ লাখ টাকা বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে 'ভুয়া প্রতিষ্ঠান' ও 'ম্যানেজড' ব্যক্তির নাম ব্যবহৃত হয়। শোনা যায়, বেশির ভাগ কাজে ৫০ হাজার টাকার চেক দিয়ে ৪০ হাজার টাকা ফেরত নিয়েছেন এমপিপুত্র।
জানা যায়, এমপির নিজের নামে করা কলেজের মাটি ভরাট, স্থাপনা নির্মাণ ও আসবাবপত্র_সবই করা হয়েছে সরকারি টাকায়। এ ক্ষেত্রে অর্থায়ন করা হয়েছে এডিপির বরাদ্দের ৪০ লাখ টাকা এবং এমপির নামে বরাদ্দের টিআরের ২৫ টন চাল ও কাবিখার ৩০ লাখ টাকা।
দাপুনিয়া ইউনিয়নের ডিকে উচ্চ বিদ্যালয়কে কাবিটার বরাদ্দ থেকে দুই দফায় সাড়ে তিন লাখ টাকা দিলেও তা আত্মসাৎ করা হয়। টেলিফোনে জানতে চাইলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রহমান বলেন, 'প্রথম দফায় ৫০ হাজার টাকা পেয়ে কিছু কাজ করেছি। পরের তিন লাখ টাকার খবর আমার জানা নেই।'
কাওয়ালতী নামাপাড়া ফকিরবাড়ী হাফেজিয়া মাদ্রাসার নামে কাবিটার ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পান আওয়ামী লীগ নেতা হারুনূর রশিদ। এর ৪০ হাজার টাকা ফেরত দিতে হয় এমপিপুত্রের কাছে। বরাদ্দ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাওয়ালতী নামাপাড়া ফকিরবাড়ী ফোরকানিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক শিবলী টেলিফোনে বলেন, 'শুনেছি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তবে আমার মাদ্রাসা তা পায়নি। আর বাস্তবে এ গ্রামে কোনো হাফেজিয়া নয়, রয়েছে ফোরকানিয়া মাদ্রাসা।'
এমপিপুত্র শান্তর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ঘাগরা ইউনিয়ন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পাড়াইল উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মামুনের নামে আড়াই লাখ টাকার পাঁচটি প্রকল্প দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। তবে কোনো প্রকল্প ও টাকা পাননি বলে দাবি করেন মামুন। একই ইউনিয়নের সুহিলা গ্রামের বেলালও পেয়েছেন ছয়টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের নামে বরাদ্দ হওয়া তিন লাখ টাকার মধ্যে আড়াই লাখ টাকাই শান্তকে দিতে হয়েছে। বেলালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি একটি প্রকল্প পেয়েছেন এবং এর মাস্টাররোল সম্প্রতি জমা দিয়েছেন। শান্তকে টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি নিরুত্তর থাকেন।
টিআর, কাবিটা, কাবিখা বাস্তবায়ন নীতিমালায় বলা আছে, অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রজেক্ট কমিটির সভাপতিকে ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি/চেয়ারম্যান, প্রতিষ্ঠানপ্রধান কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হতে হবে, যার কোনো কিছুই মানা হয়নি।
ক্ষমতার অপব্যবহার : স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নিযোগপ্রক্রিয়ায় এমপির স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বোর্ডের সদস্য নন, এমনকি আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। অথচ নিয়োগ বোর্ডে হারহামেশাই হাজির হন এমপি। পরে নিজস্ব প্রার্থীদের নিয়োগ করতে চাপ দেন। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন পদে নিয়োগে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়ে থাকেন এমপি ও তাঁর পুত্র। এ ছাড়া ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট, সিএমএমইউ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, গৃহায়ণ ও গণপূর্তসহ সব প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারে এমপিপুত্র শান্তকে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত চাঁদা না দিয়ে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারে না।
২১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ঠিকাদার সেলিম অভিযোগ করেন, 'পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সুনামগঞ্জ ভবন তৈরির এক কোটি ৬২ লাখ টাকার দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য গত ৬ সেপ্টেম্বর দরপত্র ফেলতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এমপিপুত্র শান্তর নির্দেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা শাহজাদ ও তাঁর ক্যাডার বাহিনী হুমকি দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দেয়। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ পারমাণবিক কেন্দ্রের ভবন নির্মাণের দরপত্রে পাঁচ কোটি টাকার কাজের প্রায় দুই কোটি টাকার কাজই নিজস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে দিয়েছেন শান্ত।'
হাইকোর্টের নির্দেশনার কারণে ২০০১ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের কাচারিঘাট বালুমহালের ইজারা বন্ধ থাকলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইজারা ছাড়াই ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এখান থেকে প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার টাকা আয় করছে এমপির পরিবারের লোকজন। এ বালুমহাল দখল নিয়ে খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এমপির ভাই মমতাজ মোটর মালিক সমিতির নেতৃত্ব নিয়ে নেন। অথচ ২০১০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোটর মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি সৈয়দ ফারুকীর নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ ছিল। এমপির ভাগ্নে বুলবুল খাগদহর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে পরাজিত হওয়ার পর সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় ভাঙচুর করেছেন।
একইভাবে এমপির পিএস সাঈদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে ময়মনসিংহের শহরতলি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে ও সানকিপাড়ায় জমি কিনে দুটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন বলে জানা যায়।
অভিযোগ অস্বীকার : সার্বিক অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মতিউর রহমান এমপি টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার প্রতিপক্ষরা অসত্য অভিযোগ করে আসছে। আমরা দলকে ভালোবাসি। কোনো ক্ষমতার অপব্যবহার করি না।' কলেজের নামে জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ করা জমির টাকা পরিশোধ প্রসঙ্গে বলেন, দ্রুতই এর সমাধান হবে। নিজের কলেজে সরকারি অর্থ বরাদ্দ নেওয়া প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য মতিউর রহমান বলেন, 'আমি শিক্ষক মানুষ। শিক্ষা সম্প্রসারণে সব সময়ই কাজ করেছি। সাম্প্রতিক বরাদ্দও এরই অংশ।'
এমপিপুত্র মুহিতউর রহমান শান্তও অভিযোগ অস্বীকার করে টেলিফোনে বলেন, 'আমি সরকারি জমি দখল করিনি। আর ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে টিআর, কাবিখা, কাবিটার অর্থ বরাদ্দ হলে তা খতিয়ে দেখা হবে।' বিজ্ঞান কলেজের নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল প্রসঙ্গে বলেন, 'জমিটি কলেজের নামে ভাড়া নেওয়া হয়েছে।' টেন্ডারবাজি প্রসঙ্গে বলেন, 'আমার অগোচরে ছাত্রলীগের ছেলেরা কিছু করলেও তা আমার জানা নেই।'
এমপির ভাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আফাজ উদ্দিন সরকার বলেন, 'আমি উপজেলা পরিষদের জমি এক বছরের জন্য লিজ নিয়েছি।' লিজ নেওয়া জমিতে সাইনবোর্ড টাঙানো প্রসঙ্গে কোনো উত্তর দেননি। আর পুরো কাজ না করেই বিল তুলে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি ঢাকা থেকে কাজের সময় বাড়িয়ে নিয়ে রানিং বিল তুলেছি।' এত অর্থ আয় প্রসঙ্গে বলেন, 'আমি ব্যবসা করে টাকা কামাই।' অভিযোগ প্রসঙ্গে এমপির পিএস সাঈদ বলেন, 'আমার কোনো বাড়ি-সম্পদ নেই। আমি আগেও জিরো ছিলাম, এখনো জিরো।'
প্রশাসনের বক্তব্য : সরকারি জমিতে আফাজ উদ্দিনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড প্রসঙ্গে দাপুনিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাসানুল ইসলাম বলেন, 'বিষয়টি সঠিকভাবে আমার জানা নেই। তবে ওই এলাকায় পৌরসভার বেশ কিছু জমি আছে, যার অধিকাংশই লিজ দেওয়া রয়েছে।'
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার টিআর, কাবিটা, কাবিখার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নুরুল হুদার মোবাইলে বারবার রিং করলেও তিনি ধরেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অফিসের অন্য এক কর্মকর্তার দাবি, 'সরকারি অনুদানের ২০ ভাগ কাজও মাঠপর্যায়ে হয়নি। বরাদ্দ করা অর্থ শুধু লুটই হয়েছে।'
এলজিইডির ময়মনসিংহ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, কাজগুলোর বিল উপজেলা পরিষদ থেকে ইউএনওর তত্ত্বাবধানে হয়। তবে কাজ না করে টাকা তোলা হলে সেটা অবশ্যই অনিয়ম।
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক লোকমান হোসেন মিয়া টেলিফোনে বলেন, কলেজের জমির টাকা লিখিতভাবে চাওয়া হয়েছে। আর জেলা প্রশাসনের কিছু জমি অবৈধ দখলে থাকতে পারে। তবে তা দখলমুক্ত করে পুনরুদ্ধার করা হবে।

Saturday 1 October 2011

সব টাকা যাচ্ছে সরকারের পেটে : বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক ঋণের আকাল

সৈয়দ মিজানুর রহমান
মাত্র কয়েক বছর আগেও দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক ছিল বেসরকারি খাতে বৃহত্ ঋণের বড় জোগানদাতা। দেশের মুদ্রাবাজারেও অর্থের জোগানদাতা হিসেবে এসব ব্যাংকই বড় ভূমিকা রাখত। তবে দিনবদলের পাল্লায় পড়ে এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা এখন খুবই নাজুক।
সরকারি ব্যাংকে গিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তারা টাকা পাচ্ছেন না। আর সরকারি ব্যাংকের বেহাল দশার মধ্যেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এখন দৈন্য দশায়। সরকারি-বেসরকারি গোটা ব্যাংকিং খাতেই ঋণের আকাল শুরু হয়েছে। শিল্পে তো নয়ই, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের স্বল্পমেয়াদে দৈনন্দিন কাজেও অর্থের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। বছরজুড়েই এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন ব্যাংকগুলোর জন্য সামনে আরও বিপদ আসছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সরকার ব্যাংকগুলোর সব টাকাই নিয়ে নিচ্ছে। সরকারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাকাল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়েছে ব্যাংকে নগদ জমার হার শিথিল করতে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে গড়ে প্রতিদিন ৪৮৬ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৪৫৬ কোটি, জনতা ব্যাংক এক হাজার ২৪৬ কোটি ও অগ্রণী ব্যাংক ১ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা ধার করছে। মূলত সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়েই মুদ্রাবাজার থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে এসব ব্যাংককে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে ৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা এবং তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া হয়েছে ৩ হাজার ২২২ কোটি টাকা।
এর আগে চলতি অর্থবছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে মোট ঋণ নেয় ৫ হাজার ২২৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ সময়ে আগে নেয়া ঋণের এক টাকাও পরিশোধ করতে পারেনি সরকার। অথচ গত বছরও একই সময়ে পরিশোধ হয়েছিল ৫৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা ঋণ।
ব্যাংকিং খাত থেকে বেপরোয়া ঋণ গ্রহণ সরকারের অর্থব্যবস্থা ব্যাংক ঋণনির্ভর হওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। পরিচালনা ব্যয় মেটাতে সরকার ব্যাংকিং খাতের ওপর এত বেশি নির্ভরশীলতার নজির অতীতে আর নেই বলেও মনে করেন তারা। আর সরকারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে বেসরকারি খাতে শিল্প বিনিয়োগে বড় আকারের ঋণ দেয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বাড়তি চাহিদা পূরণে ছাপছে নতুন টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তফসিলি ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ কমে আসে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ করলে, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে তা তুলে নিতে না পারে, তবে শেষ পর্যন্ত নতুন টাকা বাজারে বেড়ে যায়। আর এতে বাড়ে দ্রব্যমূল্য।
এদিকে, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলও (আইএমএফ) সরকারের অতিমাত্রায় ব্যাংক ঋণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইএমএফের একটি মিশন সরকারকে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার বাণিজ্যিক ব্যাংক নগদ অর্থের ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোকে ঋণ দিতে গিয়েই এই চাপ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সরকার ১ হাজার ৭৫০ কোটি, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ কোটি ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
এছাড়া দুই মাসে বিভিন্ন মেয়াদি বন্ড প্রাইমারি ডিলারদের মাধ্যমে নিলাম করে সরকার ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত অর্থবছরে বন্ডের মাধ্যমে সরকার ঋণ নিয়েছিল ১৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদায়ন হয়েছে মাত্র ৪৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার বন্ড। জানা গেছে, ঋণ গ্রহণের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ প্রদানও ব্যাংকগুলোর তারল্যে চাপ সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক তদবিরের কারণে ব্যাংকগুলোকে তড়িঘড়ি করে বেশকিছু ঋণ দিতে হয়েছে। ফলে সাধারণ উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। সাধারণ উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ঋণ আবেদন গ্রহণ না করতেও মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শাখাকে।
জানা গেছে, সরকারের সামগ্রিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৯ হাজার ২৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত এক বছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২০ হাজার ৩৯১ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে ২৭ হাজার ২০৮ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উত্স থেকে ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা এবং ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ৮ হাজার ২৫১ কোটি টাকা নেয়া হবে। বর্তমান হারে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিতে থাকলে বছরের অর্ধেক সময়েই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, গত প্রায় দেড় বছর ধরেই সরকারি ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে না। তবে অতিসম্প্রতি ঋণের আবেদন নেয়াও বন্ধ করে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী গতকাল আমার দেশকে জানান, ‘আমরা ব্যাংক ঋণ পাচ্ছি না। ছোট ঋণ প্রাপ্তিতে আগে সমস্যা ছিল না। গত দুই মাস ধরে ঋণের আবেদনও নেয়া হচ্ছে না সরকারি ব্যাংকে। একই অবস্থা বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতেও।’ কারণ জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও ইএবি’র সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘শেয়ারবাজারে ধসের পর অনেক ব্যাংক নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুত্ সঙ্কটের ফলে এতদিন শিল্পে বিনিয়োগ হয়নি, এখন কিছুটা উন্নতির দাবি করা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু এখন আবার সরকার ব্যাংকের সব টাকা নিয়ে নিচ্ছে। ফলে বিনিয়োগে মন্দা স্থায়ী রূপ নিতে পারে।’
এদিকে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক সঙ্কটের কারণে নগদ অর্থের জমার ক্ষেত্রে শর্ত কিছুটা শিথিল করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সিকিউরিটিজে (ট্রেজারি বিল ও বন্ড) বিনিয়োগ করতে পারবে সংশ্লিষ্ট মাসে রক্ষিতব্য সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদের (এসএলআর) ৭৫ শতাংশ। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশন থেকে জারিকৃত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। এ নির্দেশনা আগামী ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সাময়িকভাবে ব্যাংকের সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের পরিমাণ সংশ্লিষ্ট মাসের এসএলআরের ৫০ শতাংশের স্থলে ৭৫ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হলো। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর নগদ টাকা জমা রাখার প্রবণতা কমে যাবে। ফলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা সহজ হবে।
সরকার বেপরোয়া ঋণ নিলেও এই ঋণের টাকা কোথায় যাচ্ছে তার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে সরকারের ভেতরেই প্রশ্ন উঠছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বেহাল দশা চলছে। ফলে ঋণের টাকায় যে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে তা মানতে নারাজ অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজ বলেন, সরকারের ঋণের টাকার হিসাব দেয়া দরকার। এভাবে খরচ করতে থাকলে একসময় ব্যাংকিং খাত যেমন সমস্যায় পড়বে, তেমনি গোটা অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।

Saturday 24 September 2011

সাড়ে ৩ কোটি টাকার টেন্ডার ভাগ করে নিয়েছেন যুবলীগ নেতারা

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিআরই) শাখার রাস্তা মেরামত ও সংস্কার কাজের ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকার টেন্ডার নিজেদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে ভাগ করে নিয়েছে স্থানীয় যুবলীগ নেতারা। টেন্ডার দাখিলের আগেই সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা গোপনে বৈঠক করে এ কাজ হাতিয়ে নেয়। সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধের বিএল স্কুল থেকে রানীগ্রাম গ্রোয়েন পর্যন্ত নিচের অংশের রাস্তা মেরামত ও সংস্কার কাজের জন্য দরপত্র (কাজের নাম-আরএসএইচপি, প্যাকেজ নং-১) আহ্বান করে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বুধবার দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন এবং ওই দিন বিকাল ৩টায় দরপত্র বাক্স খোলা হলেও এর আগে স্থানীয় যুবলীগের একটি গ্রুপ সিন্ডিকেট করে এসব সিডিউল হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে। তারা বৈঠক করে যুবলীগ নেতাদের কাজ দেয়ার বিষয়টি ঠিকাদারদের জানিয়ে দেয়। এ বৈঠক আহ্বানকারী যুবলীগ নেতাদের ওই গ্রুপ। যে কারণে শুধু সিরাজগঞ্জে ৩৮ এবং বগুড়ায় ৩টি সিডিউলসহ ৪১টি বিক্রি হলেও দাখিল হয়েছে মাত্র ৬টি। বৈঠকে সমঝোতা অনুযায়ী পিয়াস কনস্ট্রাকশনকে কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে সূত্রে জানা গেছে। টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান। সিরাজগঞ্জ জনতা ব্যাংক মাছুমপুর শাখা ও বগুড়া জনতা ব্যাংকে এসব সিডিউল বিক্রি করা হয়। সিরাজগঞ্জ জনতা ব্যাংক মাছুমপুর শাখার
সহকারী ম্যানেজার জয়নাল আবেদীন জানান, গত ২১ আগস্ট টেন্ডারের বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় প্রকাশের পর গত ১৩, ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর আমাদের কাছে ৩৮টি সিডিউল বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। সবগুলো সিডিউল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। বুধবার দরপত্র দাখিলের জন্য সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিআরই) শাখায় টেন্ডার বাক্স দেয়া হয়। পুলিশ সুপার কার্যালয়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান সোহেল ১টি এবং বিআরই শাখায় ৬টি দরপত্র দাখিল করা হয়। সমঝোতার কারণে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তার দাখিল করা দরপত্র প্রত্যাহার করে নেয় বলে ঠিকাদার সূত্রে জানা গেছে। বুধবার সকাল থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকায় অবস্থান নেয়। তারা অফিসের ভেতরে না গেলেও বাইরে অবস্থান করতে থাকে। ঠিকাদারদের দরপত্র দাখিল না করার জন্য অনুরোধ করা হয় এবং বিক্রি হওয়া ৪১টি সিডিউল রাতে ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয় বলে সূত্রে জানা গেছে। এ কাজের একটি অংশ সিডিউল ক্রয়কারী ঠিকাদারদের মধ্যে বিতরণ করার কথা রয়েছে। গত ৯ দিনের ব্যবধানে একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি টেন্ডার হাতিয়ে নিল যুবলীগ নেতারা। তবে এ যুবলীগ নেতাদের নিজস্ব কোনো ঠিকাদারি লাইসেন্স নেই। অন্য ঠিকাদারের লাইসেন্সে তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কাজগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ শক্তিশালী প্রকল্পের ৫ কোটি টাকার টেন্ডার সমঝোতা হয়। সেই টেন্ডারে মাত্র ৩টি সিডিউল দাখিল করা হয়। এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট গত ১৩ সেপ্টেম্বর আমার দেশ-এ প্রকাশিত হওয়ার পর জেলাজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। যে কারণে এবার লোক দেখানোর জন্য ৬টি সিডিউল দাখিল করা হয়। এটি সমঝোতার বৈঠকে সিদ্ধান্ত বলে জানা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরই শাখার) উচ্চমান সহকারী আবদুস সাত্তার জানান, সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধের নিচের অংশের সড়কে সরকারি বিএল স্কুল থেকে রানীগ্রাম গ্রোয়েন পর্যন্ত এ সড়কে সংস্কার কাজের জন্য সাড়ে ৩ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। কাজে সমঝোতা হয়েছে তা আমরা জানি না। এ ব্যাপারে কোনো ঠিকাদার আমাদের কাছে অভিযোগও করেনি।
টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিআরই) শাখার এসডি আনোয়ার সাদাদ বলেন, টেন্ডার বাক্স থেকে দরপত্র খোলা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত কাজের বিষয়টি ঠিক হয়নি। কোন প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে জানতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।

Wednesday 21 September 2011

রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ১০ ব্যাংক : ক্ষমতাসীনদের ভাগবাটোয়ারা



সৈয়দ মিজানুর রহমান
ব্যাংকিং খাতে চলমান তীব্র তারল্য সঙ্কট, দেশের নাজুক অর্থনীতি এবং বর্তমানে ১৭টি ব্যাংক ঝুঁকিতে থাকার পরও মহাজোট সরকার নতুন করে আরও অন্তত ১০টি ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে যাচ্ছে। লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে শুরুতেই বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজনের অনেকেই পাচ্ছেন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন। আবার লাইসেন্স পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে চলছে কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যও।
এদিকে নতুন ব্যাংকের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা নেই। বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান জানান, বাস্তবেই আমাদের অর্থনীতি এতো বড় না, তাই বেশিসংখ্যক ব্যাংক দেয়ার সুযোগও এখন নেই। এ দিকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোরভাবে দেখছে। তবে সরকার যতগুলো ব্যাংক চাচ্ছে আমাদের সেই চাহিদা পূরণের সুযোগ নেই। নতুন ব্যাংক বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি সরকারের একটি রাজনৈতিক ইচ্ছা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আরও নতুন ১০টি ব্যাংকের অনুমোদন দিতে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ৪টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে বাকি ৬টির বিষয়ে আরও বিশদ আলোচনার কথা বলা হয়েছে পর্ষদ বৈঠকে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পর্ষদ বৈঠকে বলা হয়, নতুন ব্যাংক পেতে ৮২টি আবেদন জমা আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। বর্তমান সরকারের আমলে ২০টি আবেদন জমা পড়েছে। মূলত বর্তমান সরকারের আমলে করা আবেদনের মধ্য থেকেই বাছাই হবে, কারা পাবেন নতুন ব্যাংক। তবে এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় তালিকা পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছে তাদের পছন্দের নতুন ব্যাংকগুলোর নাম। আর এর মধ্যে আছে ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়স্বজন।
এদিকে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের গাইডলাইন বদলে ফেলা হচ্ছে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার শর্ত শিথিল করতেই এই খসড়া বদলে ফেলা হচ্ছে বলে জানা গেছে। আগের গাইডলাইনে এমন শর্ত ছিল যে, ‘ঋণখেলাপি এবং করখেলাপি এমনকি গত ৫ বছরের মধ্যে খেলাপি ছিলেন এমন কেউ নতুন ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না’।
জানা গেছে, নতুন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তালিকা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকা অনুযায়ী বর্তমান সরকারের আমলে নতুন ব্যাংকের জন্য আবেদন করা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের তালিকায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস ও শেখ সালাহ উদ্দিন। তাদের ব্যাংকের নাম দেয়া হয়েছে মধুমতি ব্যাংক। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং সরকারি হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর একাই চেয়েছেন দু’টি ব্যাংক। এর একটির নাম দেয়া হয়েছে ফারমার্স ব্যাংক ও অন্যটির নাম এসএমই ব্যাংক। দি ফারমার্স ব্যাংক গুলশানে অফিস খুলে এরই মধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল ‘রূপায়ণ ব্যাংক’ নামে নতুন ব্যাংকের আবেদন করেছেন।
শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের নামেও কয়েকটি ব্যাংকের আবেদন করা হয়েছে। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নামে সেলফ এমপ্লয়মেন্ট ব্যাংক নামে একটি ব্যাংকের আবেদন এসেছে। ড. এসএম শওকত আলী ‘ক্যাপিটাল ব্যাংক’, এনজিও ব্যক্তিত্ব অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম ‘টিএমএসএস ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক’, ড. মো. শামসুল হক ভূঁইয়া ‘অ্যাপোলো ব্যাংক’ নামে নতুন ব্যাংক চেয়েছেন। প্রবাসী কমার্শিয়াল ব্যাংক নামে নতুন ব্যাংক চেয়েছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা ফরাসত আলী। তার সঙ্গে আছেন ব্যবসায়ী নেতা কুতুবউদ্দিন। দি ব্যাংক অব এনআরবি’র আবেদন করেছেন মোল্লা ফজলুর রহমান, নিজাম চৌধুরী ও আরিফুর রহমান। আরবান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আবেদনে নাম আছে সাজ্জাদুল ইসলাম, মো. হেলাল মিয়া ও বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহসীন উদ্দিনের। ডাইনামিক ইসলামী ব্যাংকের আবেদনকারীরা হলেন বারেকুর রহমান, মো. হেলাল মিয়া ও তাজুল ইসলাম। রয়েল ব্যাংকের প্রস্তাবক হচ্ছেন নুরুল কাইয়ুম খান, জাহাঙ্গীর আলম খান ও আজিজুল খান চৌধুরী। কে টি আহমেদ আবেদন করেছেন বন্ড অ্যান্ড মর্টগেজ ব্যাংক (বিএমবি) প্রতিষ্ঠার। এক্সপ্রেস নামে ব্যাংক পেতে আবেদন করেছেন নাসিম আহমেদ, শাহরিয়ার আলম ও এবাদুল করিম।
দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিদেশি ব্যাংক আছে ১৮টি। এর বাইরে বেসরকারি ব্যাংক ৩০টি। মোট ৪৮টি ব্যাংক রয়েছে দেশে। এর বাইরে ৬০টি বীমা কোম্পানি আছে। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে এরশাদের আমলে (১৯৮২-১৯৯০) অনুমোদন দেয়া হয় ৯টি ব্যাংকের। বিএনপি আমলে (১৯৯১-১৯৯৬) ৮টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) দেয়া হয় ১৩টি বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন। তবে (২০০১-২০০৬) পর্যন্ত দ্বিতীয় মেয়াদে বিএনপির আমলে এবং সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশে আর কোনো ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়নি।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি অথবা তার পরিবারের কোনো সদস্য কোনো ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি হলে এবং সরকারের কাছে করখেলাপি হলে তিনি প্রস্তাবিত ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। এমনকি কেউ গত ৫ বছরের মধ্যে ঋণ বা করখেলাপি থাকলে এবং এ বিষয়ক কোনো মামলা অনিষ্পন্ন থাকলে তিনি নতুন ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। নতুন ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা এবং শুধু সাধারণ শেয়ারের মাধ্যমে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন গঠিত হবে। ব্যবসা শুরুর তারিখ থেকে ৩ বছরের মধ্যে বাজারে শেয়ার ছেড়ে পরিশোধিত মূলধনের সমপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। ৫ শতাংশ অথবা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ শেয়ারধারী উদ্যোক্তার মূলধন সংরক্ষণ চুক্তি সই করতে হবে এবং চুক্তির মাধ্যমে তারা অঙ্গীকার করবেন, ভবিষ্যতে নতুন ব্যাংকটি যদি কখনও মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় তাহলে উদ্যোক্তারা ঘাটতি মূলধন সরবরাহ করবেন। একজন উদ্যোক্তা সর্বনিম্ন এক কোটি টাকার শেয়ার এবং সর্বোচ্চ মোট মূলধনের ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা কোনো পরিবারের সদস্যরা একক, যৌথ বা উভয়ভাবে প্রস্তাবিত ব্যাংকের মোট মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবেন না। উদ্যোক্তাদের তাদের আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শিত নিট সম্পদ থেকে প্রস্তাবিত ব্যাংকের মূলধন সরবরাহ করতে হবে। তবে এসব শর্ত থাকলে ক্ষমতাসীনদের অনেকেই ব্যাংক পাবেন না। ফলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে তাদের নতুন ব্যাংকের গাইডলাইন বা খসড়া পরিবর্তনের।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার কার্যক্রম শুরুর তাগিদ আসে গত জুনে। এর পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি জরিপ কার্যক্রম শুরু করে, যা পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভায় প্রতিবেদন আকারে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীতা বিষয়ে এই প্রতিবেদনে সরাসরি নতুন ব্যাংকের বিরোধিতা করা না হলেও, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বুঝানো হয়, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে নতুন আর কোনো ব্যাংকের দরকার নেই। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অর্থনীতির আকার বাংলাদেশের মতো। শ্রীলঙ্কায় ব্যাংকের সংখ্যা ৩৭টি এবং পাকিস্তানে ৪৫টি। বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৪৮টি। তুলনামূলকভাবে বড় অর্থনীতির দেশ মালয়েশিয়ায় ব্যাংকের সংখ্যা ৩১টি এবং ভারতে ১৬৩টি। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আমাদের দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংক বেশি। এর আগে ২০০৫ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ২৭২তম সভায় বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংক স্থাপন সংক্রান্ত একটি নীতিমালা উপস্থাপন করা হলে পর্ষদ তা অনুমোদন করে। তবে তার অর্থ এই ছিল না যে, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। বরং দেশের অর্থনীতি ও অর্থবাজারের আকার, সঞ্চয় সৃষ্টি ও মূলধন গঠনের হার, আর্থিক খাতের গভীরতা, বিদ্যমান ব্যাংকিং অবকাঠামো ও ব্যাংকিং সেবার চাহিদা এবং ব্যাংকগুলোর প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান প্রভৃতি বিবেচনায় নতুন কোনো ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ যুক্তিসঙ্গত হবে না মর্মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ ওই সময় মতামত দেয়।
এদিকে আইএমএফ’র তরফ থেকেও বাংলাদেশে এ মুহূর্তে নতুন ব্যাংকের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলে সাফ জানিয়ে দেয়। সম্প্রতি সংস্থাটির প্রধান ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন ব্যাংকের বিরোধিতা করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত অনুমোদন না দিলেও এর আগেই নতুন ব্যাংকের নামে অনেকেই অফিস চালু করেছেন বলে জানা গেছে। গুলশান-১-এর জব্বার টাওয়ারে খোলা হয়েছে প্রস্তাবিত ফারমার্স ব্যাংকের অফিস। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ফারমার্স ব্যাংকের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, এভাবে কার্যালয় খুলে কার্যক্রম চালানো নজিরবিহীন।
নতুন ব্যাংক বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়টি সরকারের একটি রাজনৈতিক ইচ্ছা। তিনি বলেন, সরকার বেসরকারি খাতে আরও কিছু নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার পক্ষে। তবে ঠিক কয়টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার নতুন ব্যাংক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এর আগে অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইআরএফ আয়োজিত এক সেমিনারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি সরকারের একটি রাজনৈতিক ইচ্ছা। দলীয় লোকজনকে সুবিধা দেয়ার জন্যই নতুন ব্যাংক কিনা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। অন্যদিকে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান জানিয়েছেন, ‘আমরা যখন দেখলাম সরকার নতুন ব্যাংক করবেই তখন একটি সমীক্ষাকে সামনে রেখে নতুন কিছু শর্ত দিয়ে একটি খসড়া বা গাইডলাইন তৈরি করেছি। এতে কঠিন অনেক শর্তই আছে। প্রকৃত উদ্যোক্তা ছাড়া অন্যরা হয়তো নতুন ব্যাংক পাবেন না। তবে নতুন ব্যাংক সংখ্যায় খুবই সীমিত হবে। হয়ত ২/৪টি অনুমোদনের বিষয় ভাবছে বোর্ড।’ আপনার ওপর রাজনৈতিক চাপ আছে কিনা? থাকলে কারা দিচ্ছে? জানতে চাইলে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘ব্যক্তি হিসেবে আমি হয়ত কোনো মতের বা আদর্শের হতে পারি, তবে যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারে বসি তখন আমার কাছে সেটি ক্ষীণ। আমি বিশ্বাস করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেয়া যায় না। তবে সরকার চাইছে কিছু ব্যাংকের অনুমোদন আমরা দেই।’ কাউকে সুযোগ দিতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের শর্ত শিথিল করবেন কিনা—প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। শর্ত মেনে কউ পারলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করবে।

Tuesday 16 August 2011

নোয়াখালীতে সরকারি দলের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জমি দখলের হিড়িক



















ইয়াকুব নবী ইমন, সোনাইমুড়ী (নোয়াখালী)
নোয়াখালীতে ক্ষমতাসীন দলের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সরকারি জাগয়া দখলের হিড়িক পড়েছে। প্রকাশ্যে সরকারি কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি দখল হলেও স্থানীয় প্রশাসন রয়েছে একেবারে নীরব। প্রতিবাদ করলে চাকরি হারানোর ভয় থাকে। ফলে সরকারি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী দখলদারদের সঙ্গে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। আর সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।জানা গেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দলের নাম ভাঙিয়ে একটি দখলদার চক্র নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলায় দলীয় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সরকারি জায়গা দখল করছে। তারা আ’লীগ, শ্রকিম লীগ, সেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদসহ দলের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ভূইফোঁড় সংগঠনের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে সরকারি জায়গা দখল করছে। তাদের দখল তালিকায় রয়েছে সরকারি খাস জমি, সড়ক ও জনপথ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদের ও সম্পত্তি। এসব সরকারি জায়গায় প্রথমে খুঁটি দিয়ে দলের বা সংগঠনের জেলা, উপজেলা, শহর নগর ও কলেজ শাখার অফিসের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়। পরে তা দখল করে ঘর নির্মাণ করে অন্যের কাছে পজিশন বিক্রি করা হয়।দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে সরকারি জায়গা সবচেয়ে বেশি দখল হচ্ছে জেলার সোনাইমুড়ী, বেগমগঞ্জ ও সেনবাগে। এরপরই রয়েছে নোয়াখালী সদর, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, চাটখিল ও কবিরহাট উপজেলা।সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল লতিফ দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে জয়াগ বাজারে সরকারি জায়গা দখল করে ভবন নির্মাণ করে। বিষয়টি এলাকাবাসী সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাসিনা বেগম ও এসিল্যান্ডকে জানালেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেননি। চৌমুহনীর চৌরাস্তায় বেগমগঞ্জ উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মামুনুর রশিদ কিরণের নাম ভাঙিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কয়েক কোটি টাকার জায়গা দখল করে রাতারাতি মার্কেট নির্মাণ করছে দখলদার চক্র। বেগমগঞ্জ থানার মাত্র কয়েকশ গজ দূরে প্রকাশ্যে সরকারি জায়গা দখলের ঘটনা ঘটলেও দখল ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ নিয়ে এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এক সময়ের জেএসডি নেতা আবুল খায়ের চৌমুহনীর দক্ষিণ বাজারে সরকারি খাল দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। সাধারণ ব্যবসায়ীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানালেও আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বেগমগঞ্জের কাজিরহাটে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েক নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধু পরিষদ কাজিরহাট আঞ্চলিক অফিস সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ব্যবসায়ী মফিজের বন্দোবস্তের জায়গাটি দখল করে নিয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। চৌমুহনী রেলওয়ে কোয়ার্টারসংলগ্ন সরকারি জলাশয়ের পাড়ে বেগমগঞ্জ থানা শ্রমিক লীগ প্রধান কার্যালয় ও বেগমগঞ্জ থানা, চৌমুহনী পৌর এবং কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে জমি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেনবাগের শ্রমিরমুন্সি বাজারে জেলা আ’লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম মানিক দলীয় সাইনবোর্ডে সংখ্যালঘুদের জায়গা দখল করে নেয়। এ সময় সেনবাগ থানা পুলিশ টহলে থাকলেও তারা সংখ্যালঘুদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এর আগে বেগমগঞ্জ উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ কিরণ দলীয় প্রভাব খাটিয়ে জেলা জাপা সভাপতি সালাহ উদ্দিন আহম্মদের চৌমুহনী-মাইজদী সড়কের পাশের বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে নেয়। এ নিয়ে বর্তমানে আদালতে মামলা চলছে। নোয়াখালীতে একের পর সরকারি খাল, ডোবা, নালা দখল হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে জেলাব্যাপী দেখা দেয় কৃত্রিম বন্যা। নোয়াখালী সওজ’র প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী শ্যামল বাবু জানান, অভিযোগ পেলে আমরা অবিশ্যই ব্যবস্থা নেব। তাছাড়া তাত্ক্ষণিক দখল ঠেকাতে আমাদের যে লোকবল দরকার, তা নেই। নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী হাবিবুর রহমান জানান, খাল আমাদের হলেও খালের পাশের জায়গা জেলা পরিষদের। কেউ পানি প্রবাহের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি।এ ব্যাপারে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি সরকারি সম্পত্তি দখলের কথা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। সহসা দখল উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেয়া হবে

Wednesday 10 August 2011

সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমি ইজারা নিয়েছেন সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা  জমি কেরুর, লাভের টাকা দলীয় লোকদের পকেটে


















ছবি: প্রথম আলো
কামরুল হাসান ও শাহ আলম | তারিখ: ১১-০৮-২০১১ | ২১৬

দলীয় পরিচয়ের সুবাদে চাকরি হয় কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে। চাকরিতে ঢুকেই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে প্রথম বছর বেনামে ৩৬০ বিঘা জমি ইজারা নেন। এবার নিয়েছেন আরও ১৪১ বিঘা। তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক আবদুল কুদ্দুস। এখন হিজলগাড়ি বাণিজ্যিক খামারের কেরানি। তবে নামমাত্র দরে ইজারা নেওয়া এসব জমি তিনি নিজে আবাদ করেন না। সবই ভাড়া দেন প্রান্তিক চাষিদের কাছে। গত ৩০ জুলাই দুপুরে হিজলগাড়ি খামারে কুদ্দুস নিজের মুখেই বললেন এসব কথা। শুধু কুদ্দুসই নন, তাঁর মতো কেরু অ্যান্ড কোম্পানির অনেক কর্মী এই প্রতিষ্ঠানের জমি ইজারা নিয়ে জমজমাট ব্যবসা ফেঁদেছেন। তবে এসবের কলকাঠি রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। নামে-বেনামে এই নেতা ও কর্মচারীরা নামমাত্র দরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমি ইজারা নিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে তা ভাড়া দিচ্ছেন সাধারণ চাষিদের কাছে। এভাবে তাঁরা কামিয়ে নিচ্ছেন বছরে আড়াই কোটি টাকা। কিন্তু ইজারা নেওয়া জমি ভাড়া দেওয়া বা কারও কাছে হস্তান্তর করা যায় না। এদিকে বছরের পর বছর কাঁচামালের অভাবে লোকসান গুনছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এই অবৈধ ব্যবসার কথা স্বীকার করেছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম আবদার হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কেরু হলো দুর্নীতির আর্কাইভ, অনিয়মের কোনো শেষ নেই। অবশ্য এখন অনিয়ম কিছুটা দূর হয়েছে। কিন্তু এক দিনে সব দূর করা যাবে না।’ কেরু ও এর সম্পদ: চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড একটি ঐতিহ্যবাহী সরকারি প্রতিষ্ঠান। চিনি কারখানা, ডিস্টিলারি কারখানা ও ওষুধ কারখানা—এ তিনটি বিভাগ নিয়ে ১৯৩৮ সালে এ কমপ্লেক্সটি স্থাপিত হয়। তিনটি শাখার মধ্যে ওষুধ কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন ভিনেগার ছাড়া আর কিছু নেই। চিনিকলটি অলাভজনক হয়ে আছে অনেক বছর ধরে। কারখানার খামার বিভাগ সূত্র জানায়, এ প্রতিষ্ঠানের মোট জমির পরিমাণ নয় হাজার ১৬৮ বিঘা (তিন হাজার ৫৫ দশমিক ৮৪ একর)। এর মধ্যে চাষযোগ্য জমি সাত হাজার ৯২ বিঘা। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় অর্ধেক জমি ইজারা এবং অর্ধেক কোম্পানি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চাষ করা হয়। গত বছর ইজারা দেওয়া হয় তিন হাজার ৪৯২ বিঘা। আর এ বছর ইজারা দেওয়া হয়েছে তিন হাজার ৬০০ বিঘা। আগামী বছরের জন্য নতুন করে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ইজারা হয় যে কারণে: বেশি দিন এক জমিতে আখ ভালো হয় না। তাই জমির ভারসাম্য রক্ষায় অন্য ফসল করতে হয়। এ কারণে এসব জমি স্থানীয় চাষিদের কাছে ইজারা দেওয়া হয়। ইজারার মধ্যে যাঁরা ১৮ মাসের জন্য ইজারা নেন, তাঁদের জন্য আখ চাষ বাধ্যতামূলক। আর যাঁরা চার, পাঁচ ও ছয় মাসের জন্য নেন, তাঁরা অন্য ফসল করতে পারেন। শর্তানুসারে মিলের জমিত্রেতামাক, পেঁপে, ভুট্টা ও কলা চাষ করা যায় না। অনিয়ম নেই!: কেরু কোম্পানির জমি ইজারা দেওয়ার আগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তা ছাপাও হয় স্থানীয় পত্রিকায়। সাধারণ বিবেচনায় কোনো অনিয়মই নেই। তবে এ দরপত্রের ব্যাপারে সাধারণ কৃষকেরা কোনো তথ্যই পান না। অভিযোগ আছে, গোপনে এসব ইজারা হয়ে থাকে। তবে মিল কর্তৃপক্ষ গোপন বিজ্ঞপ্তির কথা অস্বীকার করেছে। অস্বীকার করলেও বাস্তবতা হলো, কয়েকজন ক্ষমতাশালী বছরের পর বছর কেরুর কয়েক হাজার বিঘা জমি ইজারা নিয়ে ভোগ করছেন। বিগত চারদলীয় জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভোগ করতেন মূলত কেরু কোম্পানির সিবিএ নেতারা। বর্তমান সরকারের আমলে সিবিএ নেতাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। একজন আল মামুন: সদর উপজেলার ছোট শলুয়া গ্রামের বাসিন্দা ও কেরুর ইক্ষু উন্নয়ন সহকারী (সিডিএ) আবদুল্লাহ আল মামুন এখন সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত বছর তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান এম এ এ এম ট্রেডার্সের নামে নিয়েছেন ৩৪২ বিঘা। এ জমির পুরোটাই তিনি আবার ভাড়া দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর অবৈধ দখল থেকে ১০০ বিঘা জমি উদ্ধার করা হয়েছে। অবৈধ দখলের বিষয়টি চিনি খাদ্য শিল্প সংস্থার তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে বলে সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) নজরুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেরুর কর্মচারী মামুন ২০০৭ সালে সারাবেলা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রথমে তিন বছর মেয়াদে ২৮৫ বিঘা চাষযোগ্য ও ২১০ বিঘা বাগান করার যোগ্য জমি ইজারা নেন। এ জমি তিনি ভাড়া দেন। আর ইজারার বাইরে অনেক জমি দখল করেন। ২০০৮ সালে তিনি মিম এন্টারপ্রাইজের নামে ২১০ বিঘা জমি ইজারা নেন। এ প্রতিষ্ঠানটি তাঁর শ্যালক শামীম আহমেদের নামে। ওই সময় তিনি ৩৩ বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করেন। এ ছাড়া সরকারি জমিতে ভুট্টার চাষ নিষিদ্ধ করা হলেও তিনি পুরো জমি ভুট্টার আবাদের জন্য বিঘাপ্রতি ১০ হাজার টাকায় ভাড়া দেন। কেরুর উপমহাব্যবস্থাপক (খামার) মোহাম্মদ আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চপর্যায়ের একটি দল তদন্ত করে মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মামুন প্রথম আলোকে বলেন, জমি নেওয়ার সময় তিনি কেরুর কর্মচারী ছিলেন না। কর্মচারী হওয়ার পর আর জমি নেননি। জমি অবৈধ দখলে রাখার কথা অস্বীকার করে বলেন, মাপজোকে ভুল হওয়ার কারণে তাঁর শ্যালকের নামে কিছু জমি বেশি ছিল। সে জন্য তিনি বাড়তি টাকাও দিয়েছেন। মূল নিয়ন্ত্রণ কারা করেন: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেরুর জমি ইজারা নিয়ন্ত্রণ করেন চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাংসদ আলি আজগার টগর ও তাঁর লোকজন। সাংসদের অনুপস্থিতিতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত গোলাম ফারুক আরিফ এসব নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সঙ্গে আছেন সাংসদের নিকটাত্মীয় ও দর্শনা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমানসহ দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী। তবে সদর আসনের সাংসদ ছোলাইমান হক জোয়ার্দার সেলুনের লোকজনও এটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। সর্বশেষ গত ২৭ জুলাই দরপত্র জমা দেওয়া নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য দর্শনা, দামুড়হুদা ও চুয়াডাঙ্গায় পৃথক বাক্স রাখা হলেও সেখানে কেউ দরপত্র জমা দিতে পারেন না। দুই সাংসদের লোকজন এসব নিয়ন্ত্রণ করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পরে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দরপত্র জমা করা হয়। কিন্তু অনেকেই আর দরপত্র জমা দিতে পারেনি। সাংসদের ঘনিষ্ঠ গোলাম ফারুক আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন না। তবে সাংসদের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক আছে। এ ব্যাপারে সাংসদ আলী আজগারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি চীন সফরে আছেন। ইজারা পেয়েছেন যাঁরা খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট ইজারা হয়েছে তিন হাজার ৬০০ বিঘা জমি। প্রভাবশালী ৩৮ জন এ জমি ইজারা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাংসদ আলী আজগারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মানিচেঞ্জার ব্যবসায়ী গোলাম ফারুক আরিফ একাই নিয়েছেন তিনটি খামারে ৩১৮ বিঘা। বিঘাপ্রতি তিন হাজার ৩৪৬ টাকা ৫৬ পয়সা দরে তিনি এ জমি ইজারা নেন। এম এম ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয় ১১৫ বিঘা। বিঘাপ্রতি দর মাত্র দুই হাজার ৫০৫ টাকা। জনৈক আবদুর রাজ্জাক নিয়েছেন ৪৬ বিঘা। খালিদ হোসেন নিয়েছেন ১৯ বিঘা। চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান কবির ঘোলদাড়ি বাণিজ্যিক খামারে ৮১ বিঘা জমি এক ফসলের জন্য ইজারা নেন এক হাজার ৬৮৬ টাকা ৮১ পয়সা দরে। যুবলীগের নেতার নামে ওই জমি বরাদ্দ যথাযথ নিয়ম মেনে না দেওয়ার অভিযোগ তোলেন একই খামারের অন্য একজন ইজারাদার। বেগমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত ডিহি গ্রামের আবদুল মান্নান ৩২৭ বিঘা জমি ইজারা নেন। ইজারার জমি তিনি ভাড়া দিয়েছেন বছরে নয় হাজার টাকা বিঘায়। কেরু কোম্পানির চুক্তিভিত্তিক ট্রাক্টরের হেলপার ও বড় শলুয়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম নিজের নামে নিয়েছেন ২৯১ বিঘা। তাঁর ছেলে আবদুল হালিমের নামে নিয়েছেন ১৮ বিঘা। বোয়ালিয়া ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্রের পাহারাদার নেহালপুরের বাসিন্দা মুবারক হোসেন নিয়েছেন ১৯৮ বিঘা। হোগলডাঙ্গার যুবলীগ নেতা শাহীন নিয়েছেন ৯০ বিঘা, তিতুদহের যুবলীগ নেতা আজিজুল হক নিয়েছেন ৬০ বিঘা, সাবেক সিবিএ নেতা ওয়াহিদুর রহমানের ছেলে আলমগীর নিয়েছেন ৫১ বিঘা। আকন্দবাড়ি খামারের কেরানি দর্শনার বাসিন্দা বাবলুর রশিদ ইজারা নিয়েছেন ১১৭ বিঘা। আলমডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা বেলু চৌধুরী নিয়েছেন ১৮৯ বিঘা। প্রথম আলোকে তিনি জানান, এ জমি তিনি চাষিদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। কিছু জমি তাঁর ভাইয়েরা আবাদও করেছেন।