Friday 31 December 2010

নির্মাণকাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ : শরণখোলায় ভারতীয় ত্রাণের ঘর পাচ্ছে বিত্তশালীরা



টিএম মিজানুর রহমান শরণখোলা (বাগেরহাট)

সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত শরণখোলায় ভারত সরকারের অনুদানে দেয়া ত্রাণের ঘর পাচ্ছেন বিত্তশালীরা। নির্মাণকাজেও রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও থেকে যাচ্ছে গৃহহীন অবস্থায়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে শরণখোলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ত্রাণের ঘর নিয়ে অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র। উপজেলার রাজৈর গ্রামের একটি দোতালা বিল্ডংয়ের সঙ্গে ভারত সরকারের অনুদানে আরেকটি ত্রাণের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘরটি ওই বিল্ডিংয়ের মালিক নুরুল আমিন হাওলাদার ত্রাণ হিসেবে পেয়েছেন। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এটি এখন রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হবে বলে তার ছেলে আসাদুজ্জামান হিরু জানান। ত্রাণের পাওয়া ঘর এবং নিজস্ব বিল্ডিংয়ের কাজ একই সঙ্গে চলতে দেখা গেছে।
একই এলাকার ইউনুস মোল্লার দোতলা টিনের ঘরের সামনেই আরেকটি ত্রাণের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানের ভাই মনিরুজ্জামানকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে তিনি এ ঘরটি পেয়েছেন বলে সরলভাবে জানালেন গৃহকর্তার স্ত্রী জরিনা বেগম। অথচ পার্শ্ববর্তী কাঠমিস্ত্রি আ. বারেক মল্লিকের ঘর সিডরে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় তার নাম রয়েছে। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় তিনি ত্রাণের ঘর পাননি বলে অভিযোগ করেন। এভাবেই সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলায় ভারত সরকারের অনুদানে ত্রাণের ঘর বিতরণ করা হচ্ছে।
শুধু এখানেই শেষ নয়, খুলনা-বাগেরহাট রুটের বাস মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলবুনিয়া গ্রামের আতিয়ার রহমান খুলনায় বসবাস করেন। বিত্তশালী এ ব্যক্তির নাম ভারতীয় ত্রাণ পাওয়া ঘরের তালিকায় রয়েছে। এ ধরনের অর্থ-বিত্তের মালিক একই গ্রামের সেলিম তালুকদার, মাওলানা লতিফুর রহমান তালুকদার, হেমায়েতউদ্দিন আকন, আলো আকন, মোস্তফা তালুকদার, রায়েন্দা (সদর) ইউনিয়নের বাসিন্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম কালাম, বন ও পরিবেশ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনসহ অনেকের নাম ত্রাণের ঘরের তালিকায় রয়েছে। অথচ স্থানীয় প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী সিডরে গৃহহীন ৩ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে এখন পর্যন্ত ঘর দেয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি ভারত সরকারের অনুদানে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কি প্রক্রিয়ায় এ ঘর দেয়া হচ্ছে তা স্থানীয় প্রশাসন জানে না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার জহিরুল ইসলাম জানান, এসব অনিয়মের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কারা কীভাবে এগুলো করছে তা তিনি জানেন না বলে উল্লেখ করেন।
উত্তর কদমতলা গ্রামের মো. দেলোয়ার হোসেন শরণখোলা প্রেসক্লাবে গত ২৫ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে জানান, তাদের গ্রামে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে এরই মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে যারা ঘরসহ অন্যান্য সহায়তা পেয়েছেন সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে তারাই এখন ভারত সরকারের অনুদানে দেয়া ঘর পাচ্ছেন। তিনি জানান, তার এলাকার আফজাল মোল্লা, রতি কান্ত, খোকন তালুকদার, দেলোয়ার ব্র্যাক থেকে এবং আব্বাস তালুকদার, ফরিদা বেগম কেয়ার বাংলাদেশের অনুদানে ত্রাণের ঘর পেয়েছেন, তারাই আবার ভারতের দেয়া অনুদানের ঘরও পেয়েছেন। অথচ তিনিসহ অনেকেই সিডরে গৃহহীন হয়ে এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। রাজৈর গ্রামের ৬৫ বছরের বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম জানান, তিনি ঘর পেলেও ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ অপারগতা প্রকাশ করায় বাধ্য হয়ে নিজেই ভিত করার জন্য মাটি কেটেছেন। আনোয়ারার মতো ওই গ্রামের আলেয়া বেগম, পারুল বেগম, দুলাল হাওলাদার, আবুল ফরাজী, আ. রহিমসহ সবার একই অভিযোগ। এছাড়া নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে ঘরের কাজ করা হচ্ছে। ঠিকাদারের লোকজন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশলী ব্যক্তি হওয়ায় এসবের বিরুদ্ধে কথা বলারও সাহস করে না সুবিধাভোগীরা।
এব্যাপারে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খোকন জানান, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় একাধিকবার উপস্থাপন করা হলেও কোনো কাজ হয়নি। ২৭ ডিসেম্বর ফের সমন্বয় কমিটির সভায় রেজুলেশন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতীয় দূতাবাসের নিয়োগকৃত ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটিং (প্রা.) লিমিটেডের মাধ্যমে শরণখোলায় ১ হাজার ৪০০ এবং মোরেলগঞ্জ উপজেলায় ১ হাজার ৪০০ ত্রাণের ঘর নির্মাণের জন্য ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। এরমধ্যে মিজান কনস্ট্রাকশন ও হোসেন কনস্ট্রাকশনকে শরণখোলায় এবং ভোস্ট কনস্ট্রাকশন ও প্রিয়া কনস্ট্রাকশনকে মোরেলগঞ্জে কার্যাদেশ দেয়া হয়। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ নির্বিঘ্নে করার জন্য স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়। ফলে তারা অধিক লাভের আশায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত কাজ করে যাচ্ছেন। এদিকে ভারতীয় দূতাবাসের নিয়োগকৃত এ প্রকল্পের তদারকি সংস্থা ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটিং (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আ. মাজেদ চৌধুরী এবং ইপিসির ইঞ্জিনিয়ার ফয়েজউদ্দিন ও শঙ্কর কুমার গত ২৬ ডিসেম্বর প্রকল্প এলাকা ঘুরে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন

টেন্ডার কমিটিকে পাশ কাটিয়ে ১৪ কোটি টাকার কাজ দেয়ার অভিযোগ

রাজশাহী অফিস

রাজশাহীতে পদ্মার বামতীর সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের ১৪ কোটি টাকার কাজ অস্বাভাবিক নিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার সিদ্ধান্তের অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে বলেও অভিযোগে প্রকাশ। অস্বাভাবিক নিম্ন দর ও অস্বচ্ছ মূল্য ধারণার কারণে কাজের মান খারাপ হবে—এমন মতামত দিয়ে সমন্বিত দ্বিতীয় শহর বন্যা প্রতিরোধ প্রকল্প-২-এর আওতায় রাজশাহীতে পদ্মার বামতীর সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের এ কাজটির জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করেছিল দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। কিন্তু এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঢাকা অফিস থেকে অগ্রহণযোগ্য দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যাদেশ দেয়ার নির্দেশ পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর একটির বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডে ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগও রয়েছে। এ কারণে একাধিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অভিযোগও দেয়া হয়েছে প্রকল্প পরিচালকের কাছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী শহর রক্ষাবাঁধের পুনর্বাসনে গৃহীত তিনটি প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ধৃত দরকে অস্বাভাবিক ও অস্বচ্ছ উল্লেখ করে এডিবি কর্তৃপক্ষের কাছে পুনঃদরপত্র আহ্বানের অনুমতি চেয়ে সুপারিশ করেছিল। মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ প্রতিবেদনটি উপেক্ষা করে সম্প্রতি এডিবির ঢাকা অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যাদেশ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এ প্রকল্পের টাকা এডিবি দিচ্ছে তাই তাদের নির্দেশ আমাদের মানতে হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক স্বীকার করেন, অস্বাভাবিক নিম্ন দরে প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ সম্পন্ন করবে—এ প্রশ্ন আমাদেরও। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর দরপত্রে উদ্ধৃত কাজের মূল্যের শতকরা ৪০ ভাগ টাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে অগ্রিম জমা দিতে রাজি হয়েছে। কাজের মান খারাপ হলে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। তিনি এও মনে করেন, এ কৌশলই কাজের মান নিশ্চিতের একমাত্র শর্ত নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বরে মূল প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী শহর রক্ষাবাঁধের তিনটি গ্রোয়েন টি-বাঁধ সংস্কার ও পদ্মার বামতীর সংরক্ষণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থ সহায়তায় গৃহীত তিনটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনটি প্যাকেজের দরপত্র দাখিলের শেষদিনে ৫০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহাতাব উদ্দিনকে প্রধান করে দরপত্রগুলো মূল্যায়নে ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। কমিটি দরপত্রগুলোতে উদ্ধৃত দর ও শর্ত বিশ্লেষণ করে ২৫ নভেম্বর একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকল্প পরিচালকের দফতরে পাঠান।
টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনের শেষে তাদের সুপারিশ বা অভিমত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। এতে বলা হয়, উদ্ধৃত এবং দেয় দরের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকায় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় কাজের মান খারাপ হতে পারে এবং এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে প্যাকেজগুলোর পুনঃদরপত্র আহ্বানই যুক্তিযুক্ত। তারা এ অভিমত দেন সরকারি সংশোধিত সংগ্রহ নীতিমালা-২০১০-এর আলোকে।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহাতাব উদ্দিন বলেন, আমরা দরপত্রগুলো মূল্যায়ন করে একটি প্রতিবেদনে কাজগুলোর জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বানের সুপারিশ দিয়েছিলাম। এডিবির উপদেষ্টারাও আমাদের মতামতের সঙ্গে একমত ছিলেন। আমরা মনে করি, উদ্ধৃত ও দেয় দরের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য হয়েছে। এত বেশি নিম্ন দরে এসব কাজের গুণগতমান সংরক্ষণ সম্ভব নয়। বিদেশি অনুদানের কাজে দরের চেয়ে মাননিয়ন্ত্রণকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। কাজের গুণগত মান এখানে অধিক বিবেচ্য। তাই পুনঃদরপত্র আহ্বান করা উচিত ছিল।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় প্যাকেজ নং-১৫-এর দরপত্র মূল্য ৬ কোটি ৩৭ লাখ ১ হাজার ৪২৬ টাকা। এ দরের বিপরীতে মেসার্স র্যাব-এমই-এবি নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দর উদ্ধৃত করেছে। প্রতিষ্ঠানটি শতকরা ২৫ দশমিক ৬৪ ভাগ নিম্ন দর দিয়ে তালিকায় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। প্যাকেজ নং-১৬-এর মূল্য ৩ কোটি ১৮ লাখ ২৮ হাজার ৭৬৯ টাকা। এ প্যাকেজের সর্বনিম্ন দরদাতা মেসার্স নিমিতি-কেএসএ শতকরা ২৬ ভাগ নিম্ন দর দিয়ে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা দর উদ্ধৃত করেছে। প্যাকেজ নং-১৭-এর মূল্য ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬৪ হাজার ৩৮২ টাকা। এ প্যাকেজের সর্বনিম্ন দরদাতা মেসার্স আলম শতকরা ২৮ দশমিক ২৫ ভাগ নিম্ন দর দিয়ে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ৬৯৬ টাকা দর উল্লেখ করেছে।
এ তিনটি প্যাকেজে অংশগ্রহণকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অভিযোগ করে বলেন, প্যাকেজ নং-১৫-এর নিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ২২ এপ্রিল রাজশাহী পাউবোতে ব্যাপক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের পর বিপুল পরিমাণ কাগজপত্র পুকুরে নিক্ষেপ করে বিনষ্টের অভিযোগ রয়েছে। বিগত দিনে এরাই পাউবোতে সন্ত্রাস করে টেন্ডার বাগিয়ে নিত। এরাই প্রকল্প পরিচালককে ফোনে হুমকি দিয়ে কাজ তাদেরই দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, আলোচিত প্যাকেজগুলোর পুনঃদরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত ছিল কমিটির। প্রথমদিকে এডিবি কমিটির মতামতের সঙ্গে একমত ছিল। কিন্তু পরে সর্বনিম্ন দরদাতাদের কার্যাদেশ দেয়ার কথা বলেছেন তারা। তবে তিনি জানান, এখনও এডিবির লিখিত নির্দেশ রাজশাহীতে আমাদের কাছে পৌঁছেনি।
এ ব্যাপারে রাজশাহী-২ সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা সাংবাদিকদের বলেন, এর আগেও সন্ত্রাস করে কিছু লোক ঠিকাদারি কাজ নিয়ে যেনতেন করে কাজ শেষ করেছেন। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় ও ক্ষতি হয়েছে। অস্বাভাবিক নিম্ন দরে কাজ দিলে কাজের মান খারাপ হবে, অতীতে এমন নজির অনেক আছে। ভালো প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।

Wednesday 29 December 2010

টিআইবির রিপোর্ট তথ্যভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত : দুদক চেয়ারম্যান

স্টাফ রিপোর্টার

বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টকে তথ্যভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত বলে অভিহিত করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছেন, এ প্রতিবেদনে অতিরঞ্জিত কিছু করা হয়নি। দেশের সব বিচারক দুর্নীতিবাজ নন। তবে কিছু কিছু বিচারক আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে মিলে দুর্নীতিতে লিপ্ত এটা ঠিক। বিচারক ও বিচার বিভাগের এসব দুর্নীতি নিয়ে এর আগেও প্রধান বিচারপতিসহ অনেক বিশিষ্ট নাগরিক বলেছেন। গোলাম রহমান গতকাল স্যাটেলাইট টেলিভিশন এটিএন বাংলাকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাত্কারে এসব কথা বলেন।
উল্লেখ্য, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত ২৩ ডিসেম্বর তাদের খানা জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে সেবাখাতগুলোর মধ্যে দেশের বিচার বিভাগকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। টিআইবির এ রিপোর্টের ব্যাপারে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা জনমত জরিপ চালায়। তাতে ৯৫ ভাগ মানুষ টিআইবির এ রিপোর্ট সঠিক ও বাস্তবসম্মত বলে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
টিআইবির এ রিপোর্ট সম্পর্কে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান আরও বলেন, রিপোর্টে আমার কাছে অতিরঞ্জিত কিছু হয়েছে বলে মনে হয়নি। দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে বিচারকসহ বিচার কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেকে চাকরিচ্যুত হচ্ছেন। কোনো কোনো বিচারক পেশকারের কাছ থেকে তোলা নিয়ে থাকেন—এটা প্রধান বিচারপতিই আক্ষেপ করে বলেছেন। কাজেই বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা যাবে না, এটা ঠিক নয়, যা সঠিক ও বাস্তবসম্মত সেটাই করেছে টিআইবি।

৫২ শতাংশ এমপি ব্যবসায়ী বলে দুর্নীতি বাড়ছে : টিআইবি

স্টাফ রিপোর্টার

বর্তমান জাতীয় সংসদের ৫২ শতাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় বেসরকারি খাতে দিন দিন দুর্নীতি বাড়ছে। রাজনীতিকরা প্রভাব খাটিয়ে বেসরকারি খাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দুর্নীতির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট দুর্নীতির ১৯ শতাংশ হয় বেসরকারি খাতে। দুর্নীতির হারের দিক থেকে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এরপর রয়েছে রাজনীতি। তবে ব্যবসা খাতের দুর্নীতির সঙ্গে রাজনীতির একটি যোগসূত্র রয়েছে।গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) মিলনায়তনে ‘ইউনাইটেড নেশন গ্লোবাল কম্পেক্ট প্রিন্সিপাল অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড এন্টিকরাপশন’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তিনি। টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন,
বেসরকারি খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরীক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। দুর্নীতি দমন কমিশন, কর কর্তৃপক্ষ ও অর্থ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে বেসরকারি খাতকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
বিইআই সভাপতি ফারুক সোবহানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য বিশিষ্ট পানিবিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল আহমেদ আতাউল হাকিম, প্রধান তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ জমির ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ড্যানিশ রাষ্ট্রদূত সেন্ট ওলিং।

১৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে : বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মচারীদের আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা

কাজী জেবেল

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় বীমা ট্রাস্ট (সিপিএফ) ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। টাকা আত্মসাতের দায়ে প্রধান অভিযুক্ত আবদুস সালাম খান এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এ ঘটনায় ৫ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলে তাদের মধ্যে চারজন আদালতের রায় নিয়ে কর্মস্থলে পুনর্বহাল হয়েছেন। এ অবস্থায় টাকা উদ্ধার ও দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ব্যাপারে তারা ৭ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন। পাশাপাশি কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, টাকা আত্মসাতের ঘটনা গত ২৯ নভেম্বর ফাঁস হয়। এরপর আত্মসাত্কৃত টাকা উদ্ধার ও দোষীদের গ্রেফতার না করায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা একাধিকবার সংস্থার চেয়ারম্যান আবদুল মালেক মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। ঘটনা ফাঁস হওয়ার প্রায় এক মাস হতে চললেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না—এমন অভিযোগ করছেন সংস্থাটির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এরই মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন, বিআইডব্লিউটিএ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, ফ্লোটিং ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, মাস্টার পাইলট ও স্টাফ ইউনিয়ন নেতারা বৈঠক করে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছেন। এ কমিটি গতকাল প্রতিবাদ সমাবেশ ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেছে। একইসঙ্গে ৭ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে। পাশাপাশি কালো ব্যাজ ধারণ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন এবং সংবাদ সম্মেলনের মতো কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংগ্রাম পরিষদ আহ্বায়ক ও বিআইডব্লিউটিএ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম আমার দেশকে বলেন, কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ঊর্ধ্বতন প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তছরুপকৃত টাকা উদ্ধার, তহবিল পুনর্ভরণ ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে। বিআইডব্লিউটিএ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন সভাপতি ও সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর রাজ্জাক বলেন, টাকা আত্মসাতের ঘটনায় আমাদেরকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছুই জানাচ্ছে না। সংস্থার চেয়ারম্যানের কাছে বীমা ট্রাস্টি বোর্ডে জমাকৃত কর্মচারীদের টাকা যে কোনো ফান্ড থেকে জমা দেয়ার কথা জানিয়েছি। তিনি দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
সূত্র আরও জানায়, এ ঘটনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তোপের মুখে রয়েছেন চেয়ারম্যান আবদুল মালেক মিয়া। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও টাকা ফেরত চেয়ে ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে বিআইডব্লিউটিএ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন বিক্ষোভ করেছে। এসময় কয়েকশ’ কর্মচারী চতুর্থ তলায় অবস্থিত চেয়ারম্যানের দফতরে হামলা চালায় এবং চেয়ারম্যানকে কিছু সময় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে চেয়ারম্যান আবদুল মালেক মিয়া পুলিশ ডাকেন। ওইদিন বিকালে তিনি কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসলে আবারও তোপের মুখে পড়েন তিনি। বৈঠকে কর্মচারীরা যে কোনো উপায়ে তাদের বীমা তহবিলের টাকা ফান্ডে গচ্ছিত করার দাবি জানান।
বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো চাকরি শেষ হওয়ার পর তারা অবসর ভাতা পান না। চাকরি থাকাকালে তাদের বেতন থেকে ১০ ভাগ এবং বেতনের বাইরে বিআইডব্লিউটিএ থেকে ১০ ভাগসহ মোট ২০ ভাগ সিপিএফে জমা হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে যাওয়ার সময় গ্রুপ বীমা ট্রাস্টি ফান্ড থেকে যত বছর চাকরি করেছেন, তত বছরের প্রতি মাসের বেসিকের দ্বিগুণ হিসেবে টাকা পেয়ে থাকেন। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্র্যাচুইটি পান। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেষ জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফান্ডের টাকা আত্মসাত্ করা হলেও কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় বীমা ট্রাস্ট (সিপিএফ) ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। বিআইডব্লিউটিএ পরিচালক (নিরীক্ষা) মো. ছিদ্দিকুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ টাকা আত্মসাত্ করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চেক জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বীমা ট্রাস্টি বোর্ডের টাকা আত্মসাত্ করা হয়েছে। বেশিরভাগ অর্থ উত্তোলন এবং স্থানান্তর হয় গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বরের মধ্যে। এসময় প্রায় ৯ কোটি টাকা তোলা হয় ব্যাংক থেকে। ট্রাস্টি বোর্ড সভাপতি গোপাল চন্দ্র সাহা এবং কোষাধ্যক্ষ মমিনুল হায়দার খানের স্বাক্ষর জাল করে এসব টাকা তোলা হয়। টাকা আত্মসাতের জন্য তদন্তে সহকারী হিসাব কর্মকর্তা আবদুস সালাম খান ও ব্যাংক ম্যানেজার জাহাঙ্গীর হোসেনসহ কয়েকজনকে দায়ী করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে সংস্থার চেয়ারম্যান আবদুল মালেক মিয়ার মোবাইল ফোনে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েকবার চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।

মহাজোট সরকারের দু’বছর : রাবিতে অর্ধশত সংঘর্ষ, নিহত ৩ : হামলার শিকার ১০ শিক্ষক ৩০ সাংবাদিক : বেপরোয়া চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য ভিন্নমতাবলম্বী দমন, ছাত্রী লাঞ্ছনা

এরশাদুল বারী কর্ণেল রাবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তার ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছে মহাজোট সরকার সমর্থিত বর্তমান প্রশাসনের গত দু’বছরে। বেপরোয়া চাঁদাবাজি, সংঘর্ষ, হত্যা, গণগ্রেফতার, নিয়োগবাণিজ্য, দলীয়করণ, বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট লঙ্ঘন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্যকরণ, ভিন্নমতালম্বী দমন, ছাত্রী ও শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক নির্যাতন, প্রেসক্লাবে হামলা এমন কোনো ঘটনা পাওয়া যাবে না যা গত দু’বছরে ঘটেনি। ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মহাজোট সরকার সমর্থিত ভিসি প্রফেসর এম আবদুস সোবহান ও প্রোভিসি প্রফেসর মুহম্মদ নুরুল্লাহর নেতৃত্বে বর্তমান প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে গত দু’বছরে অর্ধশতাধিক ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে ৩ মেধাবী ছাত্রকে। গ্রেফতার হয়েছে পাঁচ শতাধিক ছাত্র। এসব ঘটনায় ক্যাম্পাস বন্ধ থেকেছে শতাধিক দিন। নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৮৫ দলীয় শিক্ষককে। ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হয়েছে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, ১০
শিক্ষক ও কমপক্ষে ৩০ সাংবাদিক। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব। কোনো কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের পাশাপাশি প্রশাসন ও প্রক্টরিয়াল বডির জড়িত থাকারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব অপরাধমূলক ঘটনার অধিকাংশেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে।
সূত্রমতে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৪ ফেব্রুয়ারি সাময়িকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিসি প্রফেসর ড. মামনুনুল কেরামতকে অব্যাহতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর এম আবদুস সোবহানকে ভিসির দায়িত্ব দেয়া হয়। একইদিন মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও প্রগতিশীল শিক্ষক গ্রুপের সক্রিয় সদস্য প্রফেসর মুহম্মদ নুরুল্লাহকে প্রোভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভিসি-প্রোভিসির দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে শুরু হয় দলীয়করণের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। প্রশাসনিক সবগুলো পদে নিজেদের পছন্দের লোককে বসিয়ে পুরো প্রশাসন ঢেলে সাজানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি এবং অধিকাংশ হল প্রাধ্যক্ষদের ডেকে পদত্যাগের চাপ সৃষ্টি করা হয়। অব্যাহতি দেয়া হয় জোরপূর্বক।
সংঘর্ষে নিহত, গ্রেফতার, ক্যাম্পাস বন্ধ : গত দু’বছরে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৮ থেকে ১০ বার। অন্যদিকে শুধু ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৩৫ থেকে ৪০ বার। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যকার সংঘর্ষে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিবিরের রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান নোমানীকে প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে। ওই ঘটনায় উভয় সংগঠনের কমপক্ষে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়। ঘটনার দিনই পরিস্থিতি শান্ত করতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ক্যাম্পাস। তারই সূত্র ধরে বন্ধ হয়ে যায় রাজশাহী মহানগরীর প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর আগে ১১ মার্চ রাতে আবাসিক হলগুলো থেকে শতাধিক শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। চলতি বছর ৮ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ছাত্রলীগ-শিবির ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত হয় ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন। ফারুক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সরকারের নির্দেশে চিরুনি অভিযান শুরু হলে সারাদেশে কমপক্ষে দেড় হাজারের বেশি জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার পর শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা দায়ের হলে তার আত্মগোপন করে। ওই ঘটনায় রাবিতেই কমপক্ষে চার শতাধিক শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
১৫ আগস্ট শোক দিবসের টোকেন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে শাহ মখদুম হলের দোতলা ছাদ থেকে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিমকে ফেলে দেয় দলটির সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা। ৯ দিন মুমূর্ষু অবস্থায় ঢামেকে চিকিত্সাধীন থাকার পর ২৩ আগস্ট নাসিমের মৃত্যু হয়।
হলে সিট দখল, লুটপাট ও চাঁদাবাজি : ৮ ফেব্রুয়ারির রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে আবাসিক হলগুলোতে সিট দখল, লুটপাট ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও মারধরের কারণে পাঁচ শতাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী আতঙ্কে হলের আবাসিকতা বাতিল করে ক্যাম্পাসের বাইরে মেসগুলোতে অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন এমন তালিকার মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, সাংবাদিক, সাধারণ শিক্ষার্থী, ক্যাম্পাসের ব্যবসায়ী ছাড়াও খোদ ছাত্রলীগের কর্মীরাও।
আক্রমণের শিকার শিক্ষার্থী, ১০ শিক্ষক, ৩০ সাংবাদিক ও প্রেসক্লাব : চাঁদাবাজি, অবৈধ সিট দখল ও পরীক্ষার হলে বিশৃঙ্খলার ঘটনায় ছাত্রলীগের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষসহ লাঞ্ছিত হয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী, ১০ শিক্ষক এবং অন্তত ৩০ সাংবাদিক। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর চাঁদাবাজির সময় বাধাদানের ঘটনায় রাবি ছাত্রলীগের উপগণশিক্ষা সম্পাদক এমদাদুল হক কর্তৃক ফোকলোর বিভাগের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ড. অনুপম হিরা মণ্ডল প্রহৃত হন। ৭ এপ্রিল ছাত্রলীগের অবৈধ সিট দখলে বাধা দিতে গিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতিসহ নেতাকর্মীদের হাতে প্রহৃত হন শহীদ শামসুজ্জোহা হল প্রাধ্যক্ষ ড. মর্তুজা খালেদ। একাধিকবার ছাত্রলীগের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়া। ১০ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ক্যাডাররা অনলাইন সংবাদ সংস্থা রেডটাইমস বিডি ডটকমের সাংবাদিক মুনছুর আলী সৈকতকে পিটিয়ে আহত করে। ১১ ফেব্রুয়ারি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেলে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন চ্যানেল আইযের বিশেষ প্রতিনিধি মোস্তফা মল্লিক, ক্যামেরাম্যান মইন, আমার দেশ-এর রাজশাহী ফটোসাংবাদিক আসাদুজ্জামান আসাদ, প্রথম আলোর আজহার উদ্দিন, নিউ এজের সৌমিত্র মজুমদার, কালের কণ্ঠের নজরুল ইসলাম জুলু, সানশাইনের রুনি, জনকণ্ঠের রাবি প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম, যুগান্তরের সায়েম সাবু ও দি এডিটরের আতিকুর রহমান তমাল। এ ছাড়া ছাত্রলীগ কর্মীরা দৈনিক ইনকিলাব প্রতিনিধি সামসুল আরেফিন হিমেল, বাংলাবাজার পত্রিকার শাহজাহান বিশ্বাস, শীর্ষনিউজের লুত্ফর রহমান, যুগান্তরের সায়েম সাবু, ডেসটিনির আবদুর রাজ্জাক সুমন, বাংলাদেশ টুডের আওরঙ্গজেব সোহেল, আরটিএনএনের এসএম সাগরকে মারধর ও লাঞ্ছিত করে।
সাংবাদিক নির্যাতন ও নিপীড়নের সবচেয়ে বড় নিদর্শন সৃষ্টি হয় গত বছরের ২৪ এপ্রিল। ওইদিন প্রক্টর তাদের দলীয় ক্যাডারদের সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের প্রেসক্লাব সিলগালা করে দেন। এ ঘটনায় এখনও প্রেসক্লাব বন্ধ রয়েছে।
১৮৫ জন দলীয় শিক্ষক নিয়োগ : গত দু’বছরে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সাংগঠনিক অবস্থান মজবুত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় শিক্ষক নিয়োগের মহাযজ্ঞ শুরু হয়। চার শতাধিক দলীয় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার চার ধাপে এ পর্যন্ত ২৯টি বিভাগের বিজ্ঞাপিত ১০০ পদের বিপরীতে ১৮৫ শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ২০১০ সাল নাগাদ রাবিতে সব শ্রেণীর নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ওই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এ নিয়োগ দেয়া হয়। এসব নিয়োগের বেলায় বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি ও সভাপতির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ’৭৩-এর অ্যাক্ট লঙ্ঘনেরও গুরুতর অভিযোগ ওঠে। মেধাবীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া এবং বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে দ্বিগুণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণ দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘমেয়াদি একাডেমিক ঝুঁকিতে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ইউজিসির অনুমোদনহীন এসব নিয়োগের ফলে প্রায় ২০ কোটি টাকা ঘাটতিতে পড়ে প্রশাসন। তাছাড়া বর্তমানে আরও সহস্রাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

Tuesday 28 December 2010

টিআইবির রিপোর্টে সরকারে তোলপাড় : জনমনে নানা প্রশ্ন

এম এ নোমান

দেশে বিচার বিভাগ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাত হিসেবে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন বিচার বিভাগ নিয়ে মানুষের মনে এতদিন যে প্রশ্ন তৈরি হয়ে আসছিল টিআইবির রিপোর্টে তা ফুটে উঠেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন বিচার বিভাগ নিয়ে সত্য রিপোর্ট প্রকাশ করায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের দণ্ড হয়েছে। আমার দেশ প্রতিবেদক জেল খেটে এসেছেন। এখন দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে বিচার বিভাগ টিআইবির স্বীকৃতি পেয়েছে। অবশ্য প্রধান বিচারপতি নিজেও সম্প্রতি বলেছেন জেলাজজ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে পেশকারের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেন করার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে টিআইবির প্রকাশিত রিপোর্ট প্রসঙ্গে সরকারের মন্ত্রী ও সরকারদলীয় নেতারা নানা বিরূপ মন্তব্য করছেন। সরকারের মন্ত্রী ও শাসক দলের নেতারা এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন বলেও মন্তব্য করেন অনেকে।
টিআইবির রিপোর্টকে যথাযথ ও বাস্তবভিত্তিক বলে মনে করেন এ সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বিচার বিভাগ নিয়ে এর আগে প্রধান বিচারপতি ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন মহল যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন টিআইবির রিপোর্ট তারই বাস্তব প্রতিফলন মাত্র। বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, টিআইবির প্রতিবেদন বরাবরই সরকারি দল ‘ষড়যন্ত্রের অংশ’ মনে করে প্রত্যাখ্যান করে। আর বিরোধী দল তা গ্রহণ করে। এতেই প্রমাণ হয় টিআইবির রিপোর্ট হচ্ছে বাস্তবভিত্তিক।
টিআইবি গত বৃহস্পতিবার ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০১০’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। টিআইবির এ জরিপ অনুযায়ী দেশের বিচার বিভাগ হচ্ছে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। এর পরে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও ভূমি প্রশাসন। সেবাপ্রার্থী শতকরা ৮৪ ভাগ মানুষই দুর্নীতির শিকার। সেবাপ্রার্থীদের বছরে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়। দেশে দুর্নীতি বেড়েছে ৮৫ শতাংশ। টিআইবির এ জরিপ সম্পর্কে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছেন, দুর্নীতির এ চিত্র সার্বিক নয়। দুর্নীতির ব্যাপকতা এর চেয়ে অনেক বেশি।
বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া : সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক টিআইবির রিপোর্ট সম্পর্কে বলেন, রিপোর্টের যতটুকু অংশ আমি পড়েছি তাতে বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুষঙ্গগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিচারপ্রার্থীদের বিভিন্ন স্থানে ঘুষ দিতে হয়। জুডিশিয়াল সার্ভিস সম্পর্কেও বলা হয়েছে। বিচার বিভাগের অনিময় সম্পর্কে টিআইবির রিপোর্টেই শুধু বলা হয়নি, এর আগে বর্তমান প্রধান বিচারপতি, সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ অনেকেই বলেছেন। তবে আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে—দেশের মানুষ এখনও বিচার বিভাগকে তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করে থাকে। এটাই হচ্ছে বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় ভরসা। বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগেরই। বিচার বিভাগের মর্যাদা যাতে আর ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবারই নজর দেয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, টিআইবির রিপোর্টে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকেই এর আগে বিচার বিভাগ নিয়ে তাদের আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রায় একই বক্তব্য দিয়েছেন। টিআইবির রিপোর্ট প্রকাশের দিন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান রিপোর্ট সম্পর্কে বলেছেন, এ রিপোর্টে যা প্রকাশ হয়েছে, বাস্তবচিত্র আরও ভয়াবহ। দুর্নীতি আরও বেশি ও ব্যাপক। টিআইবির এ রিপোর্ট সম্পর্কে শাসক দলের মন্ত্রী ও নেতারা যেভাবে কথা বলছেন তা দুর্ভাগ্যজনক ও অনভিপ্রেত। তিনি বলেন, টিআইবি এ ধরনের রিপোর্ট এর আগেও দিয়েছে। বরাবরই ক্ষমতাসীনরা এ রিপোর্ট তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রত্যাখ্যান করছে। আর বিরোধী দল তা গ্রহণ করছে। বাস্তব কথা হলো—দুর্নীতি বাড়ছে। দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। টিআইবিকে জরিপ চালানো ও রিপোর্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।
টিআইবির প্রতিক্রিয়া : টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মোজাফ–র আহমদ ‘সেবাখাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০১০’ সম্পর্কে আমার দেশকে বলেন, এটি কোনো মতামত কিংবা মন্তব্য নয়। এটি একটি জরিপের ফলাফল। এ ফলাফলের ভিত্তি নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন তাদের উচিত এটি সম্পূর্ণ পড়ে নেয়া। এ জরিপের ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে জরিপের পদ্ধতিও উল্লেখ করা হয়েছে। যারা এটি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছেন তারা হয়তো প্রতিবেদনটি এখনও পড়েননি। জরিপ কাজে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বাস্তবভিত্তিক জ্ঞানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাই জরিপ করেছেন। বিচারপ্রার্থী জনগণের বাস্তব উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে এ জরিপে। বিচারপ্রার্থীরা বিচারাঙ্গনে গিয়ে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন তারই প্রতিফলন ঘটেছে এ জরিপ রিপোর্টে। এটি কোনো টেবিল মেকিং কিংবা কাল্পনিক জরিপ নয়। অধ্যাপক মোজাফ–র বলেন, দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বিচারকদের এক অনুষ্ঠানে তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা পেশকারদের কাছ থেকে তোলা নেবেন না।’ বিচারকদের সংশোধনের জন্যও তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বিচার বিভাগ সম্পর্কে বলেছেন, বিচার বিভাগ এখন কাচের ঘরে অবস্থান করছে। যে কোনো সময় তা ভেঙে পড়তে পারে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বিচার বিভাগ সম্পর্কে বলেছেন, গরিবদের জন্য ন্যায়বিচার দুরাশা ছাড়া কিছুই নয়। বিচার এখন ধনীদের জন্য। বিচার বিভাগ নিয়ে তাদের এ উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা টিআইবির রিপোর্টের সঙ্গে মিলে গেছে। তাই বলে এটা বলা যাবে না যে, তাদের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এ জরিপ হয়েছে। তাদের বক্তব্যের অনেক আগে থেকেই টিআইবি জরিপ কাজ শুরু করেছে। টিআইবির এ জরিপ বাস্তবভিত্তিক। এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মোজাফ–র বলেন, বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশে টিআইবি এ জরিপ করেনি। বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব হচ্ছে বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিতরা যদি তাদের মর্যাদা রক্ষা করতে না চান, সেক্ষেত্রে দেশের সব মানুষ একত্র হয়েও বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করা যাবে না। কাজেই টিআইবির রিপোর্টে বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক নয়।
মন্ত্রী ও নেতাদের প্রতিক্রিয়া : গত বৃহস্পতিবার টিআইবির এ রিপোর্ট প্রকাশের পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও শাসক দলের নেতারা এর তীব্র সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের এমপি বলেছেন, বিচার বিভাগ সম্পর্কে টিআইবির রিপোর্ট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করেছে। তিনি গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বঙ্গবন্ধু সমাজকল্যাণ পরিষদ আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে টিআইবির রিপোর্ট সম্পর্কে বলেন, দুর্নীতির বিকাশ ও অস্তিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু টিআইবি যে জরিপ চালিয়েছে তা বাস্তবভিত্তিক নাও হতে পারে। কেননা দেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে ১৬ হাজার লোকের মতামত গ্রহণ করলে সেখানে সমগ্র জাতির মতামতের সঠিক প্রতিফলন নাও হতে পারে।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, বিচার বিভাগ সম্পর্কে টিআইবি প্রকাশিত রিপোর্ট বিভ্রান্তিকর। এতে বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তিনি গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নবনির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির অভিষেক ও শ্রেষ্ঠ রিপোর্ট পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে টিআইবির রিপোর্ট সম্পর্কে এ মন্তব্য করেন। টিআইবি রিপোর্ট সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, এ ধরনের রিপোর্ট দেশের জন্য ক্ষতিকর। বিচার বিভাগের দুই-একজনের অসাধুতার জন্য সবার ওপর ঢালাওভাবে দোষ চাপানো ঠিক নয়। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করতেই টিআইবি দুর্নীতিবিষয়ক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা দেশের বিচার বিভাগকে বিতর্কিত, কলঙ্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এই মুহূর্তে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ রিপোর্টের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। তিনি গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় টিআইবির রিপোর্ট সম্পর্কে আরও বলেন, দুর্নীতির রিপোর্ট পেশ করে রাজনীতিবিদদের হেয় করা এখন টিআইবিসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়া বলেছেন, টিআইবির প্রতিবেদনে ব্যক্তিবিশেষের দায় পুরো বিচার ব্যবস্থার ওপর যেভাবে চাপানো হয়েছে তা যুক্তিযুক্ত হয়নি। এতে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশের জনগণ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে উত্সাহিত হবে। টিআইবির রিপোর্টের ভিত্তি সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমদ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এ রিপোর্ট প্রতিনিধিত্বমূলক কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। যারা এ রিপোর্ট তৈরির আগে জরিপ করেছেন তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা রয়েছে কিনা তাও দেখার বিষয়।
টিআইবির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে সুপ্রিমকোর্টের আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ২৩ ডিসেম্বর টিআইবি বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তা সঠিক নয়। এ রিপোর্ট যথাযথ হয়নি। বিচার বিভাগ সম্পর্কে ঢালাওভাবে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এ রিপোর্টে বিচারক ও বিচার বিভাগের সমস্যা সম্পর্কে কোনো সুপারিশ করা হয়নি। ফলে এ রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য নয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম ফজলুল হক খান ফরিদ, অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান খান হিরু, আফরোজা মুন, আবুল কালাম খান দাউদ, সুপ্রিকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ.ম. রেজাউল করিম প্রমুখ।

৫০ লাখ একর খাসজমির বেশির ভাগই ভূমিদস্যুদের দখলে

স্টাফ রিপোর্টার

দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ একর সরকারি খাসজমি রয়েছে। এর একটি বড় অংশ রয়েছে দখলদার বা ভূমিদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে। সরকারি দলের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ভূমিদস্যুরা এ জমি দখল করে রেখেছে। এসব উদ্ধারে প্রশাসন কোনো ভূমিকা রাখছে না।
রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে গতকাল এক গোলটেবিল আলোচনায় এ তথ্য দেয়া হয়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড ও সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক’ যৌথভাবে ‘খাসজমি, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও জনস্বার্থ’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, দেশের মোট খাসজমির প্রায় ২৫ শতাংশই জলাভূমি। আর ৩২ শতাংশ জমি হচ্ছে কৃষি। বাকি জমিগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাসের উপযোগী হলেও তা বর্তমানে কারও না কারও দখলে রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ও ভূমিদস্যুদের জন্য এসবের ওপর দরিদ্র মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি খাসজমির ব্যবস্থাপনা দ্রুত ডিজিটালাইজ করার তাগিদ দিয়ে বলেন, এটা যত দ্রুত হবে, ততই লাভ।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোলাম রব্বানী এই গোলটেবিল আলোচনায় বলেন, ‘শহরনির্ভর সমাজব্যবস্থার জন্য আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারগুলো কার্যকর না হওয়ায় ভূমি দখল এবং দুর্বলদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে। অন্যায় ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে আমাদের অবশ্যই সামাজিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে ও মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, বিচারব্যবস্থা দিয়ে দেশের সামাজিক অন্যায় ও অনাচারগুলো দূর করা সম্ভব হবে না। কারণ বিচারকদের হাতে অনেক মামলা। তারা এসব সময়মতো শেষ করতে পারছেন না। আর জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে জমির চাহিদাও বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করা যাবে না।
বেসরকারি সংস্থা এএলআরডির শামসুল হুদা বলেন, দেশে মোট জমির ১০ শতাংশ দখলদারদের হাতে রয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি বা ব্যক্তিমালিকানার জমিও রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ভূমিদস্যুরা এসব দখল করে নিচ্ছে। প্রশাসন জনগণের পরিবর্তে দস্যুদের সহায়তা করছে। এ জন্য খাসজমি নীতিমালার বদলে পূর্ণাঙ্গ আইন প্রয়োজন।
‘নিজেরা করি’র খুশী কবির বলেন, খাসজমি ব্যবস্থাপনায় পূর্ণাঙ্গ নতুন আইন, নীতিমালা ও এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, খাসজমির তালিকা করার পাশাপাশি আমাদের ভূমিহীনের তালিকাও তৈরি করতে হবে। খাসজমি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় দরিদ্র মত্স্যজীবী ও ভূমিহীনদের রাখতে হবে।
সাপ্তাহিক-এর সম্পাদক গোলাম মোর্তুজার সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য রাখেন অ্যাকশন এইডের আবাসিক প্রতিনিধি ফারাহ কবির। এতে গবেষণাধর্মী নিবন্ধ উপস্থাপন করেন শুভ কিবরিয়া ও শমসের আলী।

Tuesday 21 December 2010

শেয়ারবাজারে ধসের নেপথ্যে সিন্ডিকেটের কারসাজি : ২৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ

কাওসার আলম

সরকারের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। রোববার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ সূচকের পতন হয়েছিল ৫৫১ পয়েন্ট। রেকর্ড দরপতনে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। সুযোগ কাজে লাগিয়ে কয়েকটি সিন্ডিকেট চক্র বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেছেন, পরিকল্পিতভাবে দরপতন ঘটিয়ে চিহ্নিত কয়েকটি সিন্ডেকেট চক্র বাজার থেকে ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে এসব সিন্ডিকেট চক্রের গভীর সম্পর্ক থাকায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। উপরন্তু এসইসির বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে এসব সিন্ডিকেট চক্রের যোগসাজশ রয়েছে। তাদের সুযোগ করে দিতেই এসইসি ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯৬ সালে বিপর্যয় ঘটলে স্থবির হয়ে পড়ে দেশের শেয়ারবাজার। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং মাত্র কয়েক হাজার ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে লেনদেন। ধীরে ধীরে শেয়ারবাজারে গতি সঞ্চারিত হয়। ২০০৪ সালে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। তবে শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক গতি ফিরে আসার সূচনা হয়েছে গত জরুরি সরকারের আমলে। ওই সরকারের নানামুখী অভিযানে দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতে বিনিয়োগের সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও সংকুচিত হয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকে লাভজনক মনে করতে শুরু করেন। তাছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও জরুরি সরকারও শেয়ারবাজারে কালো টাকার প্রশ্নহীন বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়। ফলে চাঙ্গা হয়ে ওঠে শেয়ারবাজার।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর শেয়ারবাজারে লেনদেন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। বিপুলসংখ্যক নতুন বিনিয়োগকারী যুক্ত হওয়ায় বেড়ে যায় লেনদেনের পরিমাণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আবারও শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ায় শেয়ারবাজারে লেনদেনের পালে আরও জোরে হাওয়া লাগে। ২ জুলাই দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন ১ হাজার কোটি টাকার মাইলফলক স্পর্শ করে। লেনদেন যতই বাড়ছিল ততই সক্রিয় হয়ে ওঠে সিন্ডিকেট চক্র। বাজার থেকে ফায়দা লুটতে তারা কারসাজির মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর বাড়াতে শুরু করে। দরবৃদ্ধির কারণে শেয়ারবাজারে প্রতিদিনই যোগ হতে থাকে নতুন নতুন মুখ। শেয়ারবাজার সম্পর্কে এদের অধিকাংশেরই কোনো ধারণা না থাকলেও শুধু মুনাফা লাভের আশায় বিনিয়োগ শুরু করে। বিদ্যুত্, গ্যাস ও অবকাঠামো সমস্যার সমাধান করতে না পারার কারণে দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় শিল্প উদ্যোক্তারাও ধীরে ধীরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো আমানত ও সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমিয়ে দেয়ায় সাধারণ মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। পেনশনভোগী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, ছাত্র-যুবকসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। অফিসের কাজকর্ম ফেলে রেখে শেয়ারবাজার নিয়ে মেতে ওঠেন অনেকে। নতুন বিনিয়োগ না থাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথও রুদ্ধ হয়ে পড়ে। বেকার যুবকরাও শামিল হয় শেয়ারবাজারে। ব্যাংক ও বিভিন্ন উত্স থেকে ঋণ নিয়ে তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। নতুন নতুন বিনিয়োগকারী যুক্ত হওয়ায় বাজারে তারল্য প্রবাহ বেড়ে যায়। শেয়ারবাজারে একদিনে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের ঘটনাও ঘটে। লেনদেনের পরিমাণ যতই বাড়তে থাকে ততই বাড়তে থাকে শেয়ারের চাহিদা। দুই বছর আগেও শেয়ারবাজারে বিও অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখের নিচে। বর্তমানে সে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩ লাখে। বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে শেয়ারের জোগান বাড়েনি। বাজার বিশ্লেষকরা সব সময়ই বলে আসছিলেন, সরবরাহ না বাড়ানোর কারণে বাজার ক্রমেই ঝুঁকির দিকে চলে যাচ্ছে। অল্প কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার বার বার হাতবদলের কারণে অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে বেশিরভাগ শেয়ার। তবে কয়েকটি কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট কম। একই সময় মিউচুয়াল ফান্ডের একের পর এক অনুমোদন দেয়ার কারণে বাজারে শেয়ারের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। এতে শেয়ারের মূল্যস্তর আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় বাড়তি মুনাফা করতে ব্যাংকগুলোও আইনি সীমা লঙ্ঘন করে শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ শুরু করে। ব্যাংকের ভল্টের টাকাও শেয়ারবাজারে চলে আসে। শিল্প গড়তে ব্যাংক ঋণ নিয়েও কোনো কোনো উদ্যোক্তা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। ফলে সামগ্রিকভাবে শেয়ারবাজারে তারল্য প্রবাহের ঢেউ আছড়ে পড়ে। তারল্য প্রবাহ বাড়তে থাকায় শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা তুলে নেয়ার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে সিন্ডিকেট। নানা কারসাজি করে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলে নিতে কৌশলের আশ্রয় নেয়। একেক সময় একেক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করে ওইসব চক্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (এসইসি) চাপে ফেলে সিন্ডিকেট চক্র বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সংস্থাটি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে কোম্পানির শেয়ারের দাম কমতে শুরু করলে সে সুযোগে স্বল্পমূল্যে শেয়ার কিনে নিত তারা। পরে আবার দাম বাড়তে শুরু করলে চড়া দামে সেসব শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তের কারণে বড় ধরনের পতন হলে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় বিক্ষোভ বা আন্দোলন করলে এসইসি দু্রত সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে এসইসির কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়নি বরং তা বারবার বাজারকে অস্থির করে তোলে। অভিযোগ রয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কয়েকটি সিন্ডিকেট চক্রের কাছে নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ায় বাজারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এসইসির দুর্বল নেতৃত্বকেও এ জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। উপরন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে কমিশনে রয়েছে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন চক্রের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই এসইসি কর্মকর্তাদের মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ তৈরি হয়েছে। তবে কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে হাত না মেলানোর কারণে তাদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আর এসব অপপ্রচারের পেছনে কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ ডিসেম্বর চেক ক্লিয়ারিং ছাড়া শেয়ার কেনার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়ে ডিএসইর এক পরিচালক এসইসির ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। বাজারের অতিমূল্যায়ন ঠেকাতে তিনি তা কার্যকরের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেন। তার পীড়াপীড়িতে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল এসইসি। কমিশনের চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। নির্দেশনার কারণে গত ৮ ডিসেম্বর পুঁজিবাজারের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। ওইদিন মাত্র সোয়া ঘণ্টার ব্যবধানেই ডিএসইর সাধারণ সূচকের পতন ঘটে ৫৪৭ পয়েন্ট। দরপতন ঘটে প্রায় সবকয়টি কোম্পানির। পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ফলে এসইসি এ নির্দেশনাটির কার্যকারিতা স্থগিত করে। চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে নির্দেশনা জারি করার কারণে কমিশনের সিনিয়র সদস্য মনসুর আলমকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয় এবং পরবর্তী সময়ে অফিস আদেশের মাধ্যমে তাকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য কমিশন বাজারের স্বার্থে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি মূলত সিন্ডিকেট চক্রের কারণে। সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করা ডিএসইর এক পরিচালক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন বলে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। তার সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি সক্রিয় সিন্ডিকেট চক্র বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পেছনে রয়েছে ওইসব সিন্ডিকেট চক্রের হাত। আর সিন্ডিকেট চক্রটির কাছে অনেক সময়ই অসহায় আত্মসমর্থন করতে হচ্ছে কমিশনকে। এমনকি ডিএসই পরিচালনা পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো বিষয়েও কমিশনের ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছিল মূলত প্রভাবশালী মহলের চাপে। আর এসব চক্র নানাভাবেই কারসাজি করে বাজার থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। গত ৮, ১২ ও ১৯ ডিসেম্বরের দরপতনে সিন্ডিকেট চক্রটি বাজার থেকে ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে বাজারে ব্যাপক গুজব রয়েছে।
অপরদিকে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি এবং চাহিদা বাড়লেও সরকারের বেশ কিছু অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ে। আর অতিমূল্যায়িত বাজারে দরপতন ঘটিয়ে সে সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে সিন্ডিকেট চক্রটি। ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে শেয়ার সরবরাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই— বাজার বিশ্লেষকদের এমন অভিমতের বিপরীতে সিদ্ধান্ত নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় গত বছরের মার্চে এসইসির কাছে একটি সুপারিশ করে। সুপারিশে ৪০ কোটি টাকার কম পরিশোধিত মূল্যের কোম্পানির শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর ফলে বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো পরিশোধিত মূলধন জটিলতায় শেয়ারবাজারে আসতে পারেনি। একদিকে চাহিদা বৃদ্ধি অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। অবশেষে সম্প্রতি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৩০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আবার বেসরকারি খাতের কোম্পানির সরাসরি তালিকাভুক্তি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমেও শেয়ার সরবরাহের পথে বাধা তৈরি করা হয়।