Wednesday 20 July 2011

সরকারি প্রকল্পের টাকা যাচ্ছে আ’লীগ নেতাকর্মীদের পকেটে













ডেস্ক রিপোর্ট
বিভিন্ন স্থানে সরকারি প্রকল্পের টাকা, গম ও চাল নিয়ে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। কাগজে প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবতার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি এসব প্রকল্পের টাকা যাচ্ছে আ’লীগের নেতাকর্মীদের পকেটে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, টিআর প্রকল্প ও কাবিখা প্রকল্পসহ সরকারি সব ধরনের প্রকল্পেই এই দুর্নীতি ও লুটপাট চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিস্তারিত খবর পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা।
বাগেরহাট : বাগেরহাট সদর উপজেলায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ করা গাভী ক্রয়ের টাকার অর্ধেক দামে ক্রয় করা হয়েছে। বাকি টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। গত শনিবার এ প্রকল্পের সাড়ে তিন শতাধিক সুফলভোগীর মধ্যে গাভী, টিন, গাছের চারা ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে। শনিবার দুপুরে সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এ উপকরণ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সদর আসনের সংসদ সদস্য মীর শওকাত আলী বাদশা। জেলা বিআরডিবি কর্মকর্তা শান্তিরাম দত্ত জানান, গত ৩০ জুন সদর উপজেলার ৭০ জন সুফলভোগীকে ১৯ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয় গাভী ক্রয়ের জন্য। এর আগে আরও ৩০ জনকে একই পরিমাণ টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ১২০ জনকে বীজ, ৯০ জনকে ২১টি করে গাছের চারা, ১৩০ জনকে হাঁস, ১৪ জনকে টিনসহ মোট ৩৮৪ জনকে বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হয়, যা দিয়ে সুফলভোগীরা ক্রমেই স্বাবলম্বী হবেন।
সরেজমিন শনিবার গাভী ও টিন হস্তান্তর অনুষ্ঠানের সময় টাকাপ্রাপ্তরা যে গাভী এনেছেন তা ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে ক্রয় করা গাভী। বরাদ্দকৃত বাকি টাকার কোনো হদিস নেই। এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় সুফলভোগী প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার টাকা। এ থেকে ভ্যাট বাদ দিয়ে প্রত্যেককে ১৯ হাজার টাকা করে দিয়ে তাদের গরু কেনার জন্য বলা হয়েছিল। সুফলভোগীরা নিজেদের পছন্দমত গাভী কিনেছেন। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ হয়তো কিছু কম দামে গাভী কিনতে পারেন। বাকি টাকা তারা নিজেদের কাজেই ব্যবহার করেছেন। এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা অর্থের কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি বলে তিনি জানান।
কালিয়াকৈর (গাজীপুর) : গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প সচিব ও পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই প্রকল্পের প্রতিটি উপকারভোগী সদস্যের মধ্যে ২০ হাজার টাকার সমমূল্যের গাভী (গরু) ক্রয় এবং উন্নতমানের ঢেউটিন ক্রয় করে বিতরণ করার কথা থাকলেও ওই প্রকল্প কর্মকর্তা তা করেননি। ওই প্রকল্প কর্মকর্তা একটি বাড়ি একটি খামারের বরাদ্দ করা অর্থ ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে হাজার হাজার টাকা আত্মসাত্ করেছেন বলে উপকারভোগীরা একাধিক অভিযোগ করেছেন। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের উপকারভোগী সদস্য ও পল্লী উন্নয়ন অফিস থেকে জানা গেছে, সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল কবীর মুরাদকে আহ্বায়ক ও পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা রেজাউল করিমকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রকল্প সচিব রেজাউল করিমের একক সিদ্ধান্তে নিজের লোকজন দিয়ে গত এপ্রিল মাসে সরকারের বরাদ্দ করা টাকা থেকে প্রতি গাভী (গরু) ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকায় ক্রয় করে ৩০টি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়। পরে ওই প্রতিটি গাভী (গরু) ১৯ হাজার ২০০ টাকা ভাউচার করে উপজেলা পরিষদের সমন্বয় মিটিংয়ে পেশ করলে সভার অন্য সদস্যরা প্রতিবাদ করেন। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল কবীর মুরাদ জানান, ভ্যাট বাদে ১৯ হাজার ২০০ টাকার নিচে ক্রয়কৃত গরুর মালিককে বাকি অর্থ বিতরণ করার জন্য প্রকল্প সচিবকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নরসিংদী : নরসিংদীর শিবপুরে টিআর প্রকল্পে চলছে লুটপাট। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৯ ইউনিয়নে ১৪৪টি প্রকল্পের বিপরীতে ১৮৭ টন গম ও ২৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে উপজেলা পরিষদ থেকে ৪৮টি প্রকল্পের বিপরীতে ৮৭ টন গম এবং সংসদ সদস্য বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে ৯৬টি প্রকল্পে ১০০ টন গম ও ২৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিবপুর পৌরসভাসহ ১০টি ইউনিয়নের বিভিন্ন মসজিদ, সমাজ উন্নয়ন সংস্থা, সমবায় সমিতি, মাদ্রাসা, বিদ্যালয়, শ্মশানঘাট, মন্দিরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের নামে গত অর্থবছর প্রায় ১৬ লাখ টাকা মূল্য মানের ১০০ টন গম গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের (টিআর) জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এসব বরাদ্দ উত্তোলনের শেষ তারিখ ছিল গত ২৭ জুন, যা এরই মধ্যে দলের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ করা হয়নি বলেও জানা গেছে।
শিবপুর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের নামে পাঁচ টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন তো দূরের কথা, বরাদ্দের ব্যাপারে মসজিদ কর্তৃপক্ষ অবগত নন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর মৃধা নামের এক ব্যক্তিকে দেখানো হয়েছে। এ ব্যাপারে শিবপুর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন খান সেজু বলেন, এ মসজিদের নামে বরাদ্দ দেয়ার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। আর মসজিদের উন্নয়নের নামে কোনো বরাদ্দ পায়নি বলে নিশ্চিত করেছেন মসজিদের ইমাম মো. আশরাফ আলী। জাহাঙ্গীর মৃধা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আঙ্গুর মৃধার ছোট ভাই। তিনি বলেন, ‘আমি মসজিদ কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নই, বাজারে ব্যবসা করি। আমি মসজিদের কোনো টিআর উত্তোলন করিনি। দত্তেরগাঁও মধ্যপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ উন্নয়নের নামে দুই মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যার প্রকৃত চেয়ারম্যান হচ্ছেন হান্নান খান, কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ উত্তোলন করা হয়েছে আবদুল হাই নামের এক ব্যক্তির নামে।’ এ ব্যাপারে নরসিংদী-৩ আসনের (শিবপুর) স্থানীয় সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভুঞা মোহন বলেন, এটা তো আসলে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা করেন। হয়তো ভুল হতে পারে। পরে এটা সংশোধনের ব্যবস্থা করব। এদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছোট ভাই জোনায়াইদ হোসেন ভুঞা জুনু বলেন, সব সরকারের আমলেই টিআরের কিছু অংশ স্থানীয় নেতাকর্মীদের ঘরে যায়, কিন্তু এবার যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে বিতরণ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আবদুস সাত্তার খান বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের তালিকা ও প্রকল্প কমিটি মোতাবেক টিআর বিতরণ করা হয়েছে। টিআর ও কাবিখা পর্যবেক্ষণ কমিটির প্রধানও তিনি। সুতরাং এগুলো দেখার দায়িত্বও তার। জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ বাবু সূর্যকান্ত দাস বলেন, টিআর ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মোটাতাজা করার প্রকল্পে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে সরকারি কর্মকর্তারা টিআরে অনিয়মের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
ভুরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম) : ভুরুঙ্গামারীতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তিন দিনের মধ্যে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষ করে তার দফতরকে অবহিত করার নির্দেশ দিলেও অদ্যাবধি অধিকাংশ প্রকল্পের কাজের সিকি ভাগও হয়নি। কিন্তু প্রকল্প কমিটি রেজুলেশন করে জানিয়ে দিয়েছে প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। গত ৩০ জুন টাকা উত্তোলনের আগেই সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসাররা সন্তোষজনক কাজ হয়েছে মর্মে মাস্টাররোলে স্বাক্ষর করার পরই পিআইও অফিস থেকে খাদ্যশস্য ও অর্থের চেক প্রদান করা হয় প্রকল্প চেয়ারম্যানদের নামে। ডিও এবং চেকে স্বাক্ষর নিয়ে প্রকল্প চেয়ারম্যানদের পরে টাকা বুঝিয়ে দেয়া হবে বলে সদর ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান জানিয়ে দেন।
জলঢাকা (নীলফামারী) : নীলফামারীর জলঢাকায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চলছে লুটপাট। ১ম পর্যায়ে উপজেলার শিমুলবাড়ী, শৌলমারী, ডাউয়াবাড়ী ও কৈমারী—এই ৪টি ইউনিয়নের প্রতিটি সমিতির ৬০ জন করে সদস্য বিভিন্নভাবে বরাদ্দ পান।
এর মধ্যে প্রতি সমিতির ১০ সদস্য ১টি করে গরু, ১০ সদস্য ২ বান্ডিল করে টিন, ১০ সদস্য হাঁস-মুরগির খামার ও বাকি ৩০ জন সদস্য ১ হাজার করে টাকা বৃক্ষ রোপণ ও সবজি বাগানের জন্য বরাদ্দ পাচ্ছেন। উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক নিযুক্ত প্রতিনিধিরা বিভিন্ন বাজার থেকে গরু ও টিন ক্রয় করেন। আর এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে অতি কম মূল্যে রুগ্ণ কঙ্কালসার গরু ও কম দামি টিন ক্রয় করে সুবিধাভোগীদের ধোঁকা দেয়া হচ্ছে

Saturday 9 July 2011

দুর্নীতি : সড়ক ও রেল খাতে অর্থ দিতে চায় না বিশ্বব্যাংক











কাদের গনি চৌধুরী
দুর্নীতির কারণে সড়ক এবং রেল উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রতিশ্রুত অর্থ দিতে চাইছে না বিশ্বব্যাংক। ফলে ৩০টিরও বেশি প্রকল্প অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার চেষ্টা করেও অর্থছাড় করানো সম্ভব হয়নি। এমন একটি প্রকল্প হচ্ছে রেলওয়ের ‘আখাউড়া- লাকসাম সেকশন ডাবল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্প। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে। কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক এ খাতে প্রতিশ্রুত অর্থ দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে।সড়ক ও রেল বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান এম. এমদাদুল হক সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়াকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে মডার্নাইজেশন’ শীর্ষক আমব্রেলা প্রকল্পের আওতায় ‘আখাউড়া-লাকসাম সেকশন ডাবল লাইন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংক থেকে ২২ মে ২০১১ তারিখের চিঠিতে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে মডার্নাইজেশন’ প্রকল্পটির জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন সম্ভব হবে না মর্মে অবহিত করে এর যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য বলা হয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকা-চট্টগ্রাম সেকশনটি সম্পূর্ণ ডাবল লাইনে উন্নীত করার গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রকল্পটির জন্য অন্য কোনো আগ্রহী দাতা সংস্থার অর্থায়ন সংগ্রহের লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রস্তাব পেশ করেছে। গত ৯ জুন চিঠিটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবের হস্তগত হয় বলে সূত্র জানায়। রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের জন্য ৮০০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক।
রেলওয়ের আরেকটি প্রকল্প ছিল ধীরাশ্রম (টঙ্গী) আইসিডি উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পটিও বাস্তবায়নের কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক এ খাতেও প্রতিশ্রুত অর্থ দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ সড়ক দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প নেয়া হয় বিশ্বব্যাংকের অর্থ সাহায্যে। ৮৭ দশমিক ১৮ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করার জন্য বিশ্বব্যাংক ৮শ’ কোটি টাকাও দেয়। পরবর্তী সময়ে শুরুতেই দুর্নীতি দেখে বিশ্বব্যাংক এ টাকা ফিরিয়ে নেয়। শুধু তাই নয়, এ প্রকল্পের জন্য ৩৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় পরামর্শকের পেছনে। এ অর্থ বিশ্বব্যাংকের দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়নি। বিশ্বব্যাংক অর্থ প্রত্যাহার করে নেয়ায় সরকার নিজস্ব ৯০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ সড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ হাতে নেয়। কাজ শেষ করার জন্য ৩০ মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়। এর মধ্যে ৬ মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু কাজের তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। এমনকি চার অংশে বিভক্ত এই কাজের তিনটি অংশের কাজে হাতই দেয়া হয়নি। রায়মনি থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ২৭ দশমিক ৩২৯ কিলোমিটার অংশে ৩টি সেতু, ৩৫টি বক্স কালভার্ট, ২টি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের কথা। কয়েকটি স্থানে পাইলিং কাজ হচ্ছে ধীর গতিতে। কোথাও কোনো মালামাল নেয়া হয়নি। জয়দেবপুর থেকে রাজেন্দ্রপুর অংশে ১২ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার কাজে এখনও হাত দেয়নি ঠিকাদার। সালনা রেলওয়ে ওভারব্রিজ, ২৬টি বক্স কালভার্ট নির্মাণের কাজ জরুরি হলেও সার্ভের কাজই এখনও শেষ করা হয়নি। যন্ত্রপাতি ও মালামাল নেয়া হয়নি। গাছ অপসারণের কাজেও হাত দেয়া হয়নি। অথচ সওজ কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারকে অর্থের ৬০ শতাংশ অগ্রিম পরিশোধ করে দিয়েছে। রাজেন্দ্রপুর থেকে মাওনা অংশে ১৭ দশমিক ৬০ কিলোমিটারের কাজও শুরু হয়নি। তারা এখনও বেইজ ক্যাম্প স্থাপন, সড়ক সার্ভে ও গাছ অপসারণের কাজ করেনি। একমাত্র মাওনা থেকে রায়মনি পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটার অংশের কাজ শুরু করা হযেছে। চারটি অংশে বিভক্ত এই কাজে নিয়োজিত চারজন ঠিকাদারের প্রত্যেককে ষাট শতাংশ অর্থ অগ্রিম দেয়ার পরও কাজের হতাশাজনক অগ্রগতিতে মন্ত্রণালয় থেকে অসন্তোষ প্রকাশ করে সওজ কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদার ও সওজের ইঞ্জিনিয়ারদের যোগসাজশেই কাজে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানের সড়ক যোগাযোগ সহজতর ও উন্নত করার জন্যই প্রকল্পটি নেয়া হয়। প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনায় বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু এ প্রকল্পের টেন্ডার নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সরকারের একটি প্রভাবশালী মহলকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এ কাজ বাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়ায় বিশ্বব্যাংক তাদের অর্থ ফিরিয়ে নেয় বলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে।এদিকে বহুল আলোচিত পদ্মাসেতু নির্মাণ নিয়েও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েন চলছে সরকারের। সম্প্রতি যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন অর্থমন্ত্রীকে লিখা তিন পৃষ্ঠার চিঠিতে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আনেন। আবার বিশ্বব্যাংক প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিক স্বচ্ছতা দাবি করেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, অনিয়ম ও দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় এ পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রতিশ্রুত প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা দিতে বিশ্বব্যাংক অপারগতা প্রকাশ করেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত হওয়া সাপেক্ষেই তারা এ খাতে ঋণ দেয়ার কথা বলেছে। এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চল ও জেলার আওতায় সড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ৩০টিরও বেশি প্রকল্পে অর্থ ছাড় করাই সম্ভব হয়নি।এদিকে অর্থের অভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার সড়ক উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তির জন্য জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করাসহ ২৫টি প্রকল্প রয়েছে এ মহাপরিকল্পনায়। বার বার উপস্থাপন করা হলেও এসব প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিশ্বব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা। এদিকে মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পও ফাইলবন্দি হয়ে আছে। এ কারণে ২৬ জুন ঘটা করে উদ্বোধন করা হলেও সুলতানা কামাল সেতু দিয়ে অবাধে চলাচল করতে পারছে না পর্যাপ্ত যানবাহন।সূত্রে জানা গেছে, ১৭টি জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করাসহ ২৫টি প্রকল্পের পরিকল্পনা হাতে নেয় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। সওজ তার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২৫০ প্রকল্পের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ ২৫ প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে এ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর থেকেই সরকার প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরে অর্থায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে যাচ্ছে। জানা গেছে, বিভিন্ন সড়ক প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে সড়ক ও সেতু প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে বিশ্বব্যাংক। গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত উন্নয়ন ফোরামের বৈঠকে এসব প্রকল্পে অর্থ চাওয়া হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এ কারণে এসব প্রকল্প নিয়ে বিপাকে রয়েছে কর্তৃপক্ষ।সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানিয়েছে, ১৭ প্রকল্পের মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও বহদ্দারহাট-তৃতীয় কর্ণফুলী সংযোগ সড়ক চার লেন প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এছাড়া নবীনগর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অন্যগুলোর মাঠপর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প ছক (ডিপিপি) তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পথে। অনেক প্রকল্পে আবার সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রাথমিক প্রস্তাবনা তৈরির কাজ চলছে। মূল্যায়নের জন্য এগুলো যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।জানা গেছে, ১৭ জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা, গাজীপুর-আজমতপুর-ইটাখলা, যাত্রাবাড়ী-ডেমরা, টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড ও ফরিদপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা সড়কের ডিপিপি তৈরির কাজ মাঠপর্যায়ে শুরু হয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যেই ডিপিপি তৈরি হবে ময়মনসিংহ-জামালপুর-শেরপুর, দৌলতদিয়া-মাগুরা-খুলনা, হাটিকামরুল-রংপুর, খুলনা-মংলা সড়কের। টঙ্গী-জয়দেবপুর, হাটিকামরুল-বনপাড়া-রাজশাহী, কাঁচপুর-সিলেট-তামাবিল, বনপাড়া-ঈশ্বরদী, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-যশোর সড়কেরও ডিপিপি তৈরির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সওজের একটি সূত্র জানায়, এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতেই এসব জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ৪ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ-এশীয় অঞ্চলের সহ-সভাপতি ইসাবেল গুয়েরেরো অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে করে বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করে এই খাতে তারা আর বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয় বলে জানিয়ে দেন।
তবে বিশ্বব্যাংক দক্ষিণাঞ্চলের নৌ খাতের উন্নয়নে সহায়তা দিতে আগ্রহী। বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এমন অভিযোগ করার পর অর্থমন্ত্রী বলেন, এসব দুর্নীতির সঙ্গে বিশ্বব্যাংকও জড়িত। কারণ তারা এসব কাজ অনুমোদন করেছে। এরপরও বিশ্বব্যাংককে এই খাতে অর্থায়ন করার আহ্বান জানান তিনি।