Friday 31 December 2010

টেন্ডার কমিটিকে পাশ কাটিয়ে ১৪ কোটি টাকার কাজ দেয়ার অভিযোগ

রাজশাহী অফিস

রাজশাহীতে পদ্মার বামতীর সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের ১৪ কোটি টাকার কাজ অস্বাভাবিক নিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার সিদ্ধান্তের অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে বলেও অভিযোগে প্রকাশ। অস্বাভাবিক নিম্ন দর ও অস্বচ্ছ মূল্য ধারণার কারণে কাজের মান খারাপ হবে—এমন মতামত দিয়ে সমন্বিত দ্বিতীয় শহর বন্যা প্রতিরোধ প্রকল্প-২-এর আওতায় রাজশাহীতে পদ্মার বামতীর সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের এ কাজটির জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করেছিল দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। কিন্তু এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঢাকা অফিস থেকে অগ্রহণযোগ্য দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যাদেশ দেয়ার নির্দেশ পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর একটির বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডে ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগও রয়েছে। এ কারণে একাধিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অভিযোগও দেয়া হয়েছে প্রকল্প পরিচালকের কাছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী শহর রক্ষাবাঁধের পুনর্বাসনে গৃহীত তিনটি প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ধৃত দরকে অস্বাভাবিক ও অস্বচ্ছ উল্লেখ করে এডিবি কর্তৃপক্ষের কাছে পুনঃদরপত্র আহ্বানের অনুমতি চেয়ে সুপারিশ করেছিল। মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ প্রতিবেদনটি উপেক্ষা করে সম্প্রতি এডিবির ঢাকা অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যাদেশ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এ প্রকল্পের টাকা এডিবি দিচ্ছে তাই তাদের নির্দেশ আমাদের মানতে হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক স্বীকার করেন, অস্বাভাবিক নিম্ন দরে প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ সম্পন্ন করবে—এ প্রশ্ন আমাদেরও। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর দরপত্রে উদ্ধৃত কাজের মূল্যের শতকরা ৪০ ভাগ টাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে অগ্রিম জমা দিতে রাজি হয়েছে। কাজের মান খারাপ হলে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। তিনি এও মনে করেন, এ কৌশলই কাজের মান নিশ্চিতের একমাত্র শর্ত নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বরে মূল প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী শহর রক্ষাবাঁধের তিনটি গ্রোয়েন টি-বাঁধ সংস্কার ও পদ্মার বামতীর সংরক্ষণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থ সহায়তায় গৃহীত তিনটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনটি প্যাকেজের দরপত্র দাখিলের শেষদিনে ৫০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহাতাব উদ্দিনকে প্রধান করে দরপত্রগুলো মূল্যায়নে ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। কমিটি দরপত্রগুলোতে উদ্ধৃত দর ও শর্ত বিশ্লেষণ করে ২৫ নভেম্বর একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকল্প পরিচালকের দফতরে পাঠান।
টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনের শেষে তাদের সুপারিশ বা অভিমত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। এতে বলা হয়, উদ্ধৃত এবং দেয় দরের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকায় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় কাজের মান খারাপ হতে পারে এবং এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে প্যাকেজগুলোর পুনঃদরপত্র আহ্বানই যুক্তিযুক্ত। তারা এ অভিমত দেন সরকারি সংশোধিত সংগ্রহ নীতিমালা-২০১০-এর আলোকে।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহাতাব উদ্দিন বলেন, আমরা দরপত্রগুলো মূল্যায়ন করে একটি প্রতিবেদনে কাজগুলোর জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বানের সুপারিশ দিয়েছিলাম। এডিবির উপদেষ্টারাও আমাদের মতামতের সঙ্গে একমত ছিলেন। আমরা মনে করি, উদ্ধৃত ও দেয় দরের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য হয়েছে। এত বেশি নিম্ন দরে এসব কাজের গুণগতমান সংরক্ষণ সম্ভব নয়। বিদেশি অনুদানের কাজে দরের চেয়ে মাননিয়ন্ত্রণকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। কাজের গুণগত মান এখানে অধিক বিবেচ্য। তাই পুনঃদরপত্র আহ্বান করা উচিত ছিল।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় প্যাকেজ নং-১৫-এর দরপত্র মূল্য ৬ কোটি ৩৭ লাখ ১ হাজার ৪২৬ টাকা। এ দরের বিপরীতে মেসার্স র্যাব-এমই-এবি নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দর উদ্ধৃত করেছে। প্রতিষ্ঠানটি শতকরা ২৫ দশমিক ৬৪ ভাগ নিম্ন দর দিয়ে তালিকায় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। প্যাকেজ নং-১৬-এর মূল্য ৩ কোটি ১৮ লাখ ২৮ হাজার ৭৬৯ টাকা। এ প্যাকেজের সর্বনিম্ন দরদাতা মেসার্স নিমিতি-কেএসএ শতকরা ২৬ ভাগ নিম্ন দর দিয়ে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা দর উদ্ধৃত করেছে। প্যাকেজ নং-১৭-এর মূল্য ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬৪ হাজার ৩৮২ টাকা। এ প্যাকেজের সর্বনিম্ন দরদাতা মেসার্স আলম শতকরা ২৮ দশমিক ২৫ ভাগ নিম্ন দর দিয়ে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ৬৯৬ টাকা দর উল্লেখ করেছে।
এ তিনটি প্যাকেজে অংশগ্রহণকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অভিযোগ করে বলেন, প্যাকেজ নং-১৫-এর নিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ২২ এপ্রিল রাজশাহী পাউবোতে ব্যাপক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের পর বিপুল পরিমাণ কাগজপত্র পুকুরে নিক্ষেপ করে বিনষ্টের অভিযোগ রয়েছে। বিগত দিনে এরাই পাউবোতে সন্ত্রাস করে টেন্ডার বাগিয়ে নিত। এরাই প্রকল্প পরিচালককে ফোনে হুমকি দিয়ে কাজ তাদেরই দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, আলোচিত প্যাকেজগুলোর পুনঃদরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত ছিল কমিটির। প্রথমদিকে এডিবি কমিটির মতামতের সঙ্গে একমত ছিল। কিন্তু পরে সর্বনিম্ন দরদাতাদের কার্যাদেশ দেয়ার কথা বলেছেন তারা। তবে তিনি জানান, এখনও এডিবির লিখিত নির্দেশ রাজশাহীতে আমাদের কাছে পৌঁছেনি।
এ ব্যাপারে রাজশাহী-২ সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা সাংবাদিকদের বলেন, এর আগেও সন্ত্রাস করে কিছু লোক ঠিকাদারি কাজ নিয়ে যেনতেন করে কাজ শেষ করেছেন। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় ও ক্ষতি হয়েছে। অস্বাভাবিক নিম্ন দরে কাজ দিলে কাজের মান খারাপ হবে, অতীতে এমন নজির অনেক আছে। ভালো প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।

No comments:

Post a Comment