Tuesday 6 April 2010

বিনা টেন্ডারে সামিটকে দেয়া হচ্ছে বিবিয়ানা বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ


এম আবদুল্লাহ
এবার বিনা টেন্ডারে বিবিয়ানায় ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ দেয়া হচ্ছে বাণিজ্যমন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিটকে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আগ্রহে বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এ বিষয়ে সায় দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। প্রস্তাবটি যে কোনো দিন অনুমোদন পেতে পারে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি বিনা টেন্ডারে দেয়া হলে এটাই হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের বড় অনিয়মের প্রথম দৃষ্টান্ত। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মোড়কে এটা করার কথা বলা হলেও বস্তুত এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। কোনো নীতিমালাও অনুমোদিত হয়নি। দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৫ মাসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে সরকার এখন ৮/৯ মাস সময় সাশ্রয়ের কথা বলে বিনা টেন্ডারে কাজ দেয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রস্তাব আহ্বানকৃত বিবিয়ানা-২ বিদ্যুত্ কেন্দ্রটির স্থলে একই ক্ষমতার কেন্দ্র স্থাপনের কাজ সামিটকে দেয়ার জন্যই সিরাজগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কেন্দ্র সংক্রান্ত প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
পিডিবি চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, বিদ্যমান বিধি-বিধান অনুযায়ী বিনা টেন্ডারে বিবিয়ানায় ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কেন্দ্রের কাজ দেয়ার সুযোগ নেই তা আমরা জানি। তবে সরকার চাইলে পন্থা বের করতে পারে। চলমান বিদ্যুত্ সঙ্কটের প্রেক্ষিতে সামিটকে বিবিয়ানায় বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন করতে দিতে চাইলে সরকারকেই পন্থা বের করতে হবে। ঘরে চাল না থাকলে এবং পরিবারের সদস্যরা না খেয়ে থাকার উপক্রম হলে যে কোনো উপায়ে চাল যোগাড় করা যায় বলেও মত প্রকাশ করেন পিডিবি চেয়ারম্যান।
সামিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড মার্কেন্টাইল কর্পোরেশন লি.-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, সিরাজগঞ্জ বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থানান্তর করে বিবিয়ানা বা অন্য যে কোথাও নেয়া হলে আমরা স্থাপন করতে প্রস্তুত আছি। বিদ্যমান আইনে তা বৈধ হবে কিনা জানতে চাইলে আজিজ খান বলেন, রিলোকেশন করতে চাইলে তা করা যাবে।
পিডিবি’র চিঠিতে যা বলা হয়েছে : পিডিবি সচিব মোঃ আজিজুল ইসলামের স্বাক্ষরে গত ১ এপ্রিল বিদ্যুত্ বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো পত্রে (সূত্র নং-৩৫৩ বিউবো (সচি)/উন্নয়ন-১৫৭/২০০২) বলা হয়, ‘সিরাজগঞ্জ এলাকায় বর্তমানে গ্যাসের অপ্রতুলতা রয়েছে। যে কারণে বাঘাবাড়িতে স্থাপিত বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বিবিয়ানা ও সিলেটে গ্যাসের সহজলভ্যতার কারণে বিবিয়ানা-২ বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য এর মধ্যে প্রি-কোয়ালিফিকেশন (পিকিউ) আহ্বান করা হয়েছে এবং বিবিয়ানা-১ বিদ্যুত্ কেন্দ্রের রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল (আরএফপি) ইস্যুর পর্যায়ে রয়েছে। গ্যাসের মজুদ অনুযায়ী ওই স্থানে দু’টির বেশি বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না। বিবিয়ানা-২ প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রায় ৮/৯ মাস সময়ের প্রয়োজন হবে। সিরাজগঞ্জ এলাকার গ্যাসের স্বল্পতার কারণে বিবিয়ানা-২ প্রকল্পের পরিবর্তে সামিট কর্তৃক প্রস্তাবিত প্লান্টটি বিবিয়ানাতে স্থাপন করা হলে উল্লেখিত ৮ থেকে ৯ মাস সময় সাশ্রয় হবে’।
পিডিবি’র চিঠিতে আরও বলা হয় ‘বিদ্যমান আইন-নীতি ও বিধি-বিধান অনুসরণ করে বিওও ভিত্তিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে বিবিয়ানা-২-এর পরিবর্তে আলোচ্য কম্বাইন্ড সাইকেল প্লান্ট নির্মাণের সামিটের প্রস্তাব সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত হলে বিবিয়ানা-২-এর জন্য আহ্বানকৃত প্রি-কোয়ালিফিকেশন বাতিল করতে হবে এবং একই সঙ্গে সিরাজগঞ্জ ডুয়েল ফুয়েলভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রের জন্য প্রি-কোয়ালিফিকেশন আহ্বান করা যেতে পারে’। পিডিবি’র পত্রের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদ্যুত্ বিভাগের সচিবের মৌখিক নির্দেশে সামিটের পত্রের ব্যাপারে তারা বর্ণিত মতামত দিয়েছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে বিবিয়ানা : বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ২০০২ সালের ১৫ আগস্ট একনেকের বৈঠকে সিরাজগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুত্ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। একই বছরের ১৪ অক্টোবর পিডিবি রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল (আরএফপি) আহবান করে। ৬টি প্রতিষ্ঠান আরএফপি দলিল ক্রয় করলেও দাখিলের শেষ তারিখ ২০০৩ সালের ৩১ মে কেবলমাত্র সামিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড মার্কেন্টাইল কর্পোরেশন প্রস্তাব জমা দেয়। প্রস্তাবে বিদ্যুতের মূল্য প্রতি ইউনিট ২ দশমিক ৭৮৯৫ মার্কিন সেন্ট এবং গ্যাসের মূল্য ২ দশমিক ৪ গিগাজুল উল্লেখ করা হয়। একক প্রস্তাবটি পিডিবি ও মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য গেলে একক প্রস্তাবে কাজ দিতে অসম্মতি জানান তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। নির্দেশ দেয়া হয় পুনঃ দরপত্র আহ্বানের। পাওয়ার সেল পুনঃদরপত্র আহবান করলে ভারতের ইসার পাওয়ার লি. একক প্রস্তাব দাখিল করে। সেটাও বাতিল হয়। ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর পাওয়ার সেল তৃতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করলে তাতেও একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সময় বাড়িয়েও সাড়া না পাওয়ায় ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর পুরো প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৩১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জ বিদ্যুত্ কেন্দ্রের কাজটি ৭ বছর আগে তাদের দাখিল করা প্রস্তাব অনুযায়ী দেয়ার জন্য সামিট প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে পিডিবি’র মতামত চাওয়া হয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পিডিবি’র বোর্ড সভায় সামিটের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। এর পর ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে বিবেচনার জন্য পাঠানো হয় প্রস্তাব। গত রোববার ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে সিরাজগঞ্জের প্রস্তাব উত্থাপন ও নাকচ হওয়ার আগেই গত ২৮ মার্চ সামিটের পক্ষ থেকে বিদ্যুত্ সচিব বরাবর আরেকটি চিঠি দেয়া হয়। এই চিঠিতে সামিট আগের প্রস্তাব থেকে সরে এসে সিরাজগঞ্জের পরিবর্তে গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা আছে এমন অন্য কোনো স্থানে সিরাজগঞ্জের সমান ক্ষমতার বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব করে। সিরাজগঞ্জের অনুরূপ শর্ত ও দরে কেন্দ্র স্থাপনে তারা রাজি আছে বলে চিঠিতে জানায়।
সামিটের উল্লেখিত পত্রের প্রেক্ষিতে বিদ্যুত্ সচিবের নির্দেশে পিডিবি ১ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। পিডিবি’র প্রস্তাবে সিরাজগঞ্জের পরিবর্তে সামিটকে বিবিয়ানা-২ বিদ্যুত্ কেন্দ্রের স্থলে সমান ক্ষমতার কেন্দ্র স্থাপনের কাজ দেয়ার পক্ষে মত দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুত্ সচিব আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পিডিবিকে মতামত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে সিরাজগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কেন্দ্র সামিটকে দেয়ার প্রস্তাব নাকচের আগে ওই নির্দেশ দেয়া হয় এবং পিডিবি’র চিঠিও তার আগে মন্ত্রণালয়ে আসে।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/07/26298

No comments:

Post a Comment