Sunday 28 March 2010

এলজিইডির ১০১ গাড়ি ক্ষমতাধরদের সেবায়



কাদের গনি চৌধুরী | ঢাকা, সোমবার ২৯ মার্চ ২০১০, ১৫ চৈত্র ১৪১৬, ১২ রবিউসসানি ১৪৩১
সরকার ও সরকারি দলের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের গাড়ি সেবা দিচ্ছে সরকারি সংস্থা এলজিইডি। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর অর্থাত্ এলজিইডি নামের এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পের ১০১টি গাড়ি বর্তমানে মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালীরা ব্যবহার করছেন। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ঠিক মতো পরিচালনা করা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয় এসব গাড়ির তেল খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, ড্রাইভারের বেতন সবই দিতে হচ্ছে এলজিইডির প্রজেক্ট থেকে। এ খাতে বছরে সরকারের অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে প্রায় ৯ কোটি টাকা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের গাড়ি ব্যবহারকারীদের তালিকায় মন্ত্রী, এমপি, অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কর্মকর্তা, আমলা এমনকি সরকার সমর্থক কলামিস্টের নামও রয়েছে। একইভাবে মন্ত্রণালয়ের পিও ব্যবহার করছেন এলজিইডির গাড়ি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে ওইসব ব্যক্তিকে ব্যবহারের জন্য এলজিইডিকে গাড়ি সরবরাহ করতে বাধ্য করেছে। ওইসব গাড়ি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনের ব্যবহারের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এই ১০১টি গাড়ির অধিকাংশই টয়োটা, টয়োটা ভিএক্স এবং টয়োটা প্রাডো।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর সূত্র জানায়, এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ব্যবহারের জন্য নিয়েছেন দুটি টয়োটা ভিএক্স। গাড়ি দুটির নম্বর হচ্ছে ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৩৭৭৯ ও ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৬০৯৯। প্রথম গাড়িটি চালান এলজিইডির ড্রাইভার খালেদ এবং দ্বিতীয়টি চালান ড্রাইভার মজনু। মন্ত্রী হিসেবে তাকে বরাদ্দ দেয়া পরিবহন পুলের গাড়িটি তিনি ফেরত দিয়েছেন বলে ড্রাইভার খালেদ জানান।
সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মাহবুবে আলম গাড়ি নিলেও এলজিইডির কাছ থেকে ড্রাইভার নেননি। গাড়িটির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-৫১৬৩। আইন মন্ত্রণালয় অফিশিয়াল চিঠি দিয়ে এলজিইডির কাছ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের জন্য গাড়িটি নিয়েছেন বলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) জানান।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম নিয়েছেন ৩টি গাড়ি। একটি ব্যবহার করেন প্রতিমন্ত্রী নিজে। ওই গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-৩৭৭৮। এ গাড়ির ড্রাইভার খালেদ জানান, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিমন্ত্রীকে দেয়া গাড়িটি তিনি ফেরত দিয়েছেন। বাকি দুটির একটি ব্যবহার করেন প্রতিমন্ত্রীর পিএস সাইফুল ইসলাম বাদল (গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-৬৪৭০)। আরেকটি ব্যবহার করেন প্রতিমন্ত্রীর এপিএস (গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-১২৬১)।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক নিয়েছেন ৩টি। একটি ব্যবহার করেন প্রতিমন্ত্রী নিজে। ওই গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-১৮৯৪। এ গাড়ির ড্রাইভার কামরুজ্জামান জানান, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিমন্ত্রীকে দেয়া গাড়িটি তিনি ফেরত দিয়েছেন। বাকি দুটির একটি ব্যবহার করেন প্রতিমন্ত্রীর পিএস মিজানুর রহমান (গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-২২৮৬)। আরেকটি ব্যবহার করেন প্রতিমন্ত্রীর এপিএস (গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১৯-১৩৫০)।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ৪ বিশেষ কর্মকর্তাকেও দেয়া হয়েছে এলজিইডির গাড়ি। তারা হলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল আলম হানিফ (গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-৮০৪৫), প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপ (গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-৮০৪৬), প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম শাকিল (গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-২১-৯১৬৫), প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমেদের পিএস মান্নান (গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-৬৩৪৯)। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের জন্য দেয়া হয়েছে আরও তিনটি গাড়ি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানও নিয়েছেন এলজিইডির প্রজেক্টের গাড়ি। বাণিজ্যমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল ফারুক খানকে দেয়া হয়েছে একটি নতুন গাড়ি। দুজন সংসদ সদস্যকেও প্রজেক্টের গাড়ি দিতে হয়েছে। তারা হলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপি ও রহমত উল্লাহ এমপি।
সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মাহবুবে আলম গাড়ি নিলেও এলজিইডির কাছ থেকে ড্রাইভার নেননি। গাড়িটির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-৫১৬৩। আইন মন্ত্রণালয় অফিশিয়াল চিঠি দিয়ে এলজিইডির কাছ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের জন্য গাড়িটি নিয়েছেন বলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) জানান।
এলজিইডির প্রজেক্টের আরেকটি গাড়ি দেয়া হয়েছে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে। গাড়িটির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-১১-৭০৯৮। এ গাড়ির ড্রাইভার আমিরুল জানান, গাফ্ফার চৌধুরী দেশের বাইরে থাকলে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশ মতো অন্যদের ডিউটি করেন তিনি। বর্তমানে গাফ্ফার চৌধুরী দেশের বাইরে থাকায় নজির চৌধুরী নামের প্রবাসী এক বাংলাদেশীকে গাড়িটি ব্যবহারের জন্য দেয়া হয়েছে। নজির চৌধুরীকে এ গাড়িটি গাফ্ফার চৌধুরীর কথামতো দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পিও আবদুল খালেকও সরকারি গাড়ি পেয়েছেন।। মন্ত্রীর দফতরে কাজ করেন তাই তারও একটি সরকারি গাড়ি চাই। মন্ত্রীর দফতরের চাপে পিও খালেককেও দিতে হয়েছে প্রজেক্টের একটি গাড়ি। যে গাড়িটির জন্য সরকারের অহেতুক ব্যয় হচ্ছে বছরে সাড়ে ৭ লাখ টাকা। এ টাকা ব্যয় হচ্ছে তেল, রক্ষণাবেক্ষণ ও ড্রাইভারের বেতন বাবদ। গাড়ির ক্ষয়ক্ষতির হিসাব যোগ করলে এ ব্যয় দ্বিগুণ হবে। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, তাদের পিএস-এপিএস ছাড়াও যুগ্মসচিব থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যন্ত ২৯ কর্মকর্তা বিভিন্ন প্রজেক্টের গাড়ি ব্যবহার করছেন।
এছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৪৯ কর্মকর্তাকে এলজিইডির বিভিন্ন প্রজেক্টের গাড়ি দেয়া হয়েছে। সরকারের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সার্ভিস দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে আরও ২৮টি গাড়ি। এলজিইডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার একাই ব্যবহার করেন ৫টি গাড়ি। গাড়িগুলো চালান ড্রাইভার কুদ্দুস, আলীম ও মনসুরুল। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ব্যবহার করেন দুটি, বাকি তিনটি ব্যবহার করেন চিফ ইঞ্জিনিয়ারের পরিবারের সদস্যরা।
এলজিইডি সূত্র জানায়, প্রতিটি গাড়ির জন্য দৈনিক ২০ লিটার অকটেন দিতে হয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরকে। মাসে ৬০০ লিটার অকটেন বাবদ দিতে হয় ৪৪ হাজার টাকা। এছাড়াও ড্রাইভারের বেতন বাবদ ১০ হাজার টাকা, রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি ধরা হয় মাসে ৬০ হাজার টাকা। এ হিসাবে গাড়িগুলোর পেছনে বছরে ৯ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়। আর এ টাকা অঘোষিতভাবে আদায় করা হয় প্রজেক্টগুলো থেকে। ফলে তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয়। বর্তমানে এলজিইডিতে অর্ধশতাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের পিপি অনুযায়ী জেলা পর্যায়ে প্রকল্পের কাজে গাড়িগুলো বরাদ্দের কথা থাকলেও সরকারের বিভিন্ন লেভেলের লোকজনকে খুশি রাখতে চিফ ইঞ্জিনিয়ার গণহারে গাড়ি বরাদ্দ দিচ্ছে। অথচ গাড়ির অভাবে অনেক স্থানে প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো পরিদর্শন করতে পারছেন না কর্মকর্তারা। কোথাও কোথাও মোটরসাইকেলে চড়ে কর্মকর্তাদের প্রকল্প পরিদর্শনে যেতে হয়। সূত্র জানায়, গাড়ি ব্যবহারের প্রথম শর্ত হলো, প্রকল্পের উন্নয়ন কাজে ব্যবহৃত হবে। প্রজেক্ট শেষ হলে গাড়ি পরিবহনপুলে ফেরত দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে কাকে কোন গাড়ি দেবে। কিন্তু এলজিইডি এর কিছুই করছে না। যিনি গাড়ি বরাদ্দ পেতে পারেন তাকে যেমন দেয়া হচ্ছে, তেমনি সরকারি গাড়ি পাওয়ার অধিকার যাদের নেই তাদেরও বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) জাহাঙ্গীর আলম আমার দেশকে জানান, সরকার চাইলে আমরা তো গাড়ি বরাদ্দ না দিয়ে পারি না। এলজিআরডি মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রজেক্টের গাড়ি বরাদ্দ দেয়া যৌক্তিক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অফিশিয়াল চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়গুলো আমাদের কাছ থেকে গাড়ি নিয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেলের জন্য এলজিইডির গাড়ি বরাদ্দ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয় অফিশিয়াল চিঠি দিয়ে গাড়িটি বরাদ্দ নিয়েছে। সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে কোন যুক্তিতে গাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার চাইলে আমরা দিতে বাধ্য।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, আগেও এলজিইডির বিভিন্ন প্রজেক্টের গাড়ি মন্ত্রী ও সচিবরা ব্যবহার করতেন। কিন্তু এবারের মতো গণহারে প্রজেক্টের গাড়ি বাইরে কখনও বরাদ্দ দেয়া হয়নি।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/03/29/24889

No comments:

Post a Comment