Friday 23 July 2010

তদবিরে বিলম্বিত শিক্ষক নিয়োগ

সাবি্বর নেওয়াজ | Shamokal শনিবার | ২৪ জুলাই ২০১০ | ৯ শ্রাবণ ১৪১৭ | ১১ শাবান ১৪৩১

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৩৪ হাজার সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে। চলতি মাসেও এ পরীক্ষার ফল চূড়ান্ত হচ্ছে না। সরকারি চাকরিতে এটিই স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিয়োগ। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সারাদেশের লাখো চাকরিপ্রার্থী এখন এ পরীক্ষার ফলের দিকে চেয়ে রয়েছেন। এ নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আমলাদের চাপ ও তদবির। নানামুখী তদবিরে এ পরীক্ষার ফল প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে। গত ১৫ জুন মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও প্রায় ১৪টি জেলার পরীক্ষার ফল এখনও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরে এসে পেঁৗছেনি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করতে পারছে না প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দাবি করেছে, মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের চেয়ারম্যান ছিলেন জেলা প্রশাসকরা। প্রচণ্ড তদবিরের কারণেই ১৪টি জেলার প্রশাসকরা এখনও তাদের জেলার প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার ফল চূড়ান্ত করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে পাঠাতে পারেননি। তবে আগস্টের
মাঝামাঝি উত্তীর্ণ প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোঃ মোতাহার হোসেন সমকালকে জানান, 'চলতি মাসে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হচ্ছে না। কারণ তিন-চার জেলার প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার ফল আমাদের কাছে এখনও আসেনি। প্রার্থীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফল একসঙ্গে যোগ করে আগামী মাসে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।'



প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ঢাকায় পাঠাতে জেলা প্রশাসকদের দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'স্থানীয় পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা গ্রহণ কমিটির কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অসুস্থ, কেউবা পারিবারিক এবং অন্যান্য সমস্যা থাকার কারণে চূড়ান্ত করা ফল ঢাকায় পাঠাতে পারছেন না।' প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ ফসিউল্লাহ অবশ্য বলেন, 'বেশিরভাগ জেলার প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার ফল আমাদের কাছে এসেছে। তবে কবে নাগাদ উত্তীর্ণ প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না।'
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এখনও ১৪টি জেলার প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার ফল ঢাকায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে আসেনি। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দিতে চাপ প্রয়োগ করার কারণেই জেলা প্রশাসকদের ঢাকায় ফল পাঠাতে বিলম্ব হচ্ছে। অনেক জেলায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে। সব মিলিয়ে চলতি মাসে এ নিয়োগ পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার কথা থাকলেও শেষতক তা হচ্ছে না।
'প্রাথমিকের শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ঘুষ লেনদেন হচ্ছে না। এমনকি কোনো রাজনৈতিক তদবিরও কাজে আসছে না। লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় যারা বেশি নম্বর পাবেন, কেবল তারাই চূড়ান্ত ফলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে চাকরি পাবেন।' গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এ দাবি করলেও প্রকৃত চিত্র যে ভিন্ন তা তিনিও জানেন।
কয়েকজন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে তদবির সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে সঙ্গত কারণেই তারা তাদের নাম প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন। এক জেলা প্রশাসক সমকালকে জানান, 'আমার ওপর চাপ থাকা সত্ত্বেও মোটামুটিভাবে চেষ্টা করেছি মেধাবী প্রার্থীদের ভালো নম্বর দিতে। নইলে ভালোমানের প্রাথমিক শিক্ষক এ জেলায় থাকবে না। ফল হিসেবে কোমলমতি শিশুরা মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।' জানা গেছে, চাঁদপুরের এক সংসদ সদস্য তার প্যাডে তার নির্বাচনী উপজেলার সর্বমোট ১১৪ জন প্রার্থীর নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে ডিও লেটার দেন। একইভাবে যশোরের এক সংসদ সদস্য ১৮ জনের নামের তালিকা দিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠান মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দিতে। ওই সংসদ সদস্য তালিকার ব্যক্তিদের বর্তমান সরকারের দলীয় আদর্শের কর্মী এবং তারা অতীতে নির্যাতিত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি এ তালিকা প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফছারুল আমিনের কাছেও দেন। জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে সবচেয়ে বেশি চাপ রয়েছে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, বগুড়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফেনী, নোয়াখালী, রাজশাহী, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া. নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, কক্সবাজার, বরিশাল, বাগেরহাট, দিনাজপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকের ওপর।
গত ৮ জানুয়ারি সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। লিখিত পরীক্ষায় কোন প্রার্থী কত নম্বর পেয়েছেন, তা সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। গত ১৫ জুন মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ শেষ হয়। এখন সবাই ফলের অপেক্ষায় দিন পার করছেন। মোট ১০০ নম্বরের শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার নম্বর ৮৫ এবং মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১৫।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়ার সময় সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল ২৫ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে পরে গত মে মাসে পদ বাড়িয়ে সর্বমোট ৩৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবার প্রতি উপজেলায় গড়ে ৭০ থেকে ৭৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার শিক্ষক অবসরে যান। তাদের স্থানে যোগ্য শিক্ষক হিসেবে গড়ে উঠতে অন্যদের বেশি সময় লাগে। তাই একসঙ্গে বেশি শিক্ষক নিয়োগ করা হবে।

No comments:

Post a Comment