Wednesday 29 June 2011

মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ দেয়া ১৯০ জনই ভুয়া





শামসুস সালেহীনমুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সাব-রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেয়া ১৯০ জনই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তারা মুক্তিযোদ্ধার জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। ১৯৭১ সালে ১৯০ জনের অনেকেই ছিলেন দুধের শিশু। তখন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন মায়ের কোলে। মুজিবনগর কর্মচারী কোটায় সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরি পাওয়া ১৯ জনকে এরই মধ্যেই সাসপেন্ড করা হয়েছে। আরও ১১ জনকে সাসপেন্ড করার লক্ষ্যে তাদের নাম পাঠানো হয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতামতের জন্য। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। উচ্চ আদালতের রায়ে ২০০৯ সালে ১৯০ জনকে মুজিবনগর কর্মচারী কোটায় চাকরি পাওয়া কর্মকর্তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বয়স ছিল ৩ থেকে ৭ বছর। চাকরি দেয়ার সময় তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে, মুজিবনগর কর্মচারীরা কেউ কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে পানি খাইয়েছেন, এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে খবর পৌঁছানো ইত্যাদি নানান কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন ছিলেন তিন বছরের শিশু। সে কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পানি খাওয়ালেন অথবা খবর পৌঁছালেন এই নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বিস্মিত হয়েছেন। ওই সময়ের এমন শিশু অনেক রয়েছেন, যারা মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী পরিচয়ে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি পেয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মামলায় যে যার মতো নাম বসিয়ে উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সাব-রেজিস্ট্রার আমার দেশকে জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নয় এমন ১৯০ জনের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা করে মোট ৫৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এদের মধ্যে আছেন নকলনবিস, দলিল লেখক, হোমিও চিকিত্সক, পল্লী চিকিত্সক, শিক্ষক, মুদি দোকানি ইত্যাদি পেশার মানুষ। মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী পরিচয়ে সাব-রেজিস্ট্রার পদে আত্তীকরণকৃতদের মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নিবন্ধন অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিআর) মুন্সী নজরুল ইসলামের নিজ জেলা নড়াইল ও বরিশালের। অন্য জেলার মাত্র দু’একজন রয়েছেন। গত ১৯ মে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটি ও অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কমিটির সভা হয়। সভায় মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ১৯০ জন সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে নিয়োগের অভিযোগ তোলা হয়। এটা বিধি মোতাবেক নিষ্পত্তি করতে বলে সংসদীয় কমিটি ২০০৯ সালের ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করেছে বলে সূত্র জানায়। সভায় আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও উপস্থিত ছিলেন। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী পরিচয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়া সাব-রেজিস্ট্রারদের ৩ জনকে প্রথম সাসপেন্ড করা হয়। তারা হলেন হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার আবুল বাশার, যার জন্ম তারিখ ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তার চাকরিতে যোগদানের তারিখ ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর। বরগুনার পাথরঘাটার সাব-রেজিস্ট্রার নুরুল হকের জন্ম তারিখ ১৯৬৮ সালের ১৫ জুন। তিনি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ভোলা জেলার রাধাবল্লভের সাব-রেজিস্ট্রার বাদল কুমার বিশ্বাসের জন্ম ১৯৬৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর। তিনি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর। ভূমি রেজিস্ট্র্রেশন বিভাগেও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো অনেক সাব-রেজিস্ট্র্রার অবসরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবার চাকরিতে ফিরেছেন। দুই বছর চাকরির মেয়াদ বাড়ার সুযোগে তারা ভালো সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসে পোস্টিং নিয়ে ঘুষসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দেখিয়ে তারা চাকরির মেয়াদ দু’বছর বাড়িয়ে নেন। পাশাপাশি অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তারা এটাকে সরকারের একপেশে সিদ্ধান্ত বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন, এটা প্রশাসনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তাদের অভিযোগ, প্রশাসনে এক সময়ের উচ্চমান সহকারী পরবর্তীতে মুজিবনগর স্টাফ কোটায় সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদানকারী আই,জি,আর, (চলতি দায়িত্ব) মুন্সী নজরুল ইসলাম। তার আপন ছোটভাই প্রায় তিন বছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। অথচ আই,জি,আর পদে জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে জেলা জজ বা যুগ্ম সচিব পদের কর্মকর্তারাই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মুন্সী নজরুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় দু’বছর চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে আই,জি,আর-এর পদ দখল করে আছেন। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করে আদালতের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করেছেন মাসদার হোসেন। তিনি আইজিআর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দুই মাস। ২০০৭ সালের ১২ এপ্রিল থেকে একই বছরের ৩ জুন পর্যন্ত আইজিআর-এর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বর্তমানে আইজিআর-এর চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মুন্সী নজরুল ইসলাম। তার ভাতিজা বর্তমানে কর্মরত ঢাকার সদর সাব-রেজিস্ট্রার মুন্সী রুহুল ইসলাম। তারা চাচা-ভাতিজা দু’জনেই মুজিবনগর সরকারের উদ্বৃত্ত হিসেবে চাকরি নিয়েছেন। ভাতিজা মুন্সী রুহুল ইসলামের জন্ম হয় ১৯৫৯ সালের ৩০ নভেম্বর। অর্থাত্ ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত তার বয়স ১১ বছর ৩ মাস ২৬ দিন। চাকরিতে চাচা আইজিআর মুন্সী নজরুল ইসলাম সাব-রেজিস্ট্র্রার পদে যোগ দেন ১৯৭৮ সালের ১০ অক্টোবর। পাশাপাশি ঢাকা সদরে মুন্সী রুহুল ইসলাম সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন ১৯৯৭ সালের ২৩ জুলাই। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন মেয়াদে নিবন্ধন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (আইজিআর) পদে দায়িত্ব পালন করেন ২৭ জন। সাব-রেজিস্ট্রার মাত্র দু’জন আইজিআর (মহাপরিদর্শক, নিবন্ধন অধিদফতর) পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তদের একজন এ,ওয়াই,এ,ম, আনোয়ারুল হক এবং বর্তমানে এই পদে প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মুন্সী নজরুল ইসলাম। মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে সাব-রেজিস্ট্রার পদে ২০০৯ সালে ১৯০ জন ছাড়া আরও ৮০ জন সাব-রেজিস্ট্রার দেশের বিভিন্নম্ন সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসে কাজ করছেন। তাদের অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। যাদের বয়স মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ থেকে ১০ বছর ছিল। ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ দু’টি সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসে রয়েছেন, তাদের একজন বর্তমান আইজিআরের আপন ভাতিজা মুন্সী রুহুল ইসলাম। অপরজন হলেন তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্র্রার আবুল কালাম আজাদ। তার জন্ম তারিখ ১৯৬০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি এই পদে যোগ দিয়েছেন ১৯৯১ সালের ২ মার্চ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তারা দু’জনই মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী ছিলেন না বা মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। অথচ তারা মুক্তিযোদ্ধা সনদ দাখিল করেছেন কর্মস্থলে।মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বা সহায়তার নামে যারা চাকরি পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই ভুয়া। জাল সনদ ও কাগজপত্র দাখিল করে এবং প্রকৃত তথ্য গোপন করে তারা সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরি পেয়েছেন। তাদের অধিকাংশেরই মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ৩ থেকে ১১ বছর। এ ব্যাপারে নিবন্ধন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (চলতি দায়িত্ব) মুন্সী নজরুল ইসলাম আমার দেশকে জানান, এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না

No comments:

Post a Comment